সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ-৩
লাহোর আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর
আমরা চলছি শিয়ালকোটের পথে। কূয়াশায় সামনে পাঁচ ফুট দুরেও কিছু দেখা যায়না! এই এলাকায় দিনে ঝকঝকে পরিস্কার-কিন্তু রাত নামার সাথেসাথেই কুয়াশায় ঢেকে যায় এবং প্রচন্ড শীত। পথে আমাদেরমতো প্রাইভেট যান খুব একটা চোখে পরেনি। তবে অনেক মালবাহী ট্রাক আর সেনা সাঁজোয়া যান। পথে পথে আত্মঘাতি বোমায় বিদ্ধস্ত যান বাহন পুলিশের রেকার দিয়ে টেনে নিতে দেখি।
মাঝেমাঝে আমাদের বহনকারী গাড়ির সাথে রেঞ্জার/আর্মীর টহল জীপ-দেখে একটু ভরসা পাই। গাড়িতেই নাসের মাহমুদ আমাকে ও ইডি সাহেবকে দুটো ফোন দিলেন-পাকিস্তানে অবস্থানকালীন ব্যাবহারের জন্য।
লাহোর আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পাব্লিক ফোন বুথ
পরিকল্পনামত আমরা ২ দিন আগেই শিয়ালকোট এসেছি -পূর্ব প্রস্তুতির জন্য। রাত সাড়ে তিনটার সময় আমরা শিয়ালকোট তাজ প্যালেস হোটেলে পৌঁছি। অত্যন্ত অভিযাত হোটেল।
এই হোটেলে আমি আগেও থেকেছি। আমাদের দুজনের আলাদা রুম। নাসের ভ্রাতৃদ্বয় চলে যায়-ওদের বাড়িতে। আমি ফ্রেশ হয়ে মাগরিব ও এশার নামায কাজা নামাজ আদায় করি। যোহর ও আসর নামায পড়েছিলাম করাচী এয়ারপোর্টে।
গতকাল সারা দিন রাতের ক্লান্তির পর ফজর নামাজ শেষে ঘুমিয়ে সকালে বেশ লেট করেই ঘুম ভাংগে। জানালাদিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি-কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে শিয়ালকোট শহর। ইডি সাহেব জিম সেরে রেডি হয়ে আছেন জানালেন। নাসের মাহমুদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন-আমাদের নিয়ে ফ্যাক্টরীতে যাবে। আমরা কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং এ যাচ্ছি।
শিয়ালকোট তাজ প্যালেস হোটেল
রুম থেকে বেড়িয়েই দেখি সশস্র নিরাপত্তা রক্ষী দাঁড়িয়ে। একটি আন্তর্জাতিক হোটেলের ভিতরও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা! সব লবীর সামনে সশস্র নিরাপত্তা রক্ষী, লিফটের দড়জায় নিরাপত্তা রক্ষী! ডাইনিং এর সামনে নিরাপত্তা রক্ষী! বাইরে প্রতিদিনই আত্মঘাতি বোমায় মানুষ মরছ নাসের জানালেন- শহরের বড় বড় ব্যবসায়ী কিম্বা টাকাওয়ালা লোক/তাদের বাচ্চা ধরে নিয়ে তালেবানী ছাড়াও বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন মোটা অংকের টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে! শিয়ালকোটে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী ব্যাবসায়ী আছেন। এখানকার ইন্টারন্যাশনাল চেইন স্টার হোটেলগুলোই এখন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অফিস কাম বাসস্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজনও মোটেই উদ্ববিগ্ন নয়! এদের কাছে অমন পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক!
আমাদের সাথে এখানে চারটা কোম্পানী/ফ্যাকটরী কাজ করছে। নাসের মাহমুদের কোম্পানীর নাম Demsel Surgical Co. অন্য তিনটি কোম্পানীর নাম যথাক্রমে Truck Of Surgical, Quayum & Elahee Co ও AIZ Co.নাসের মাহমুদ চারটি কোম্পানীর পক্ষে বায়ার ও সংশ্লিষ্টদের প্রটোকল ও কোর্ডিনেটরের দ্বায়িত্ব পালন করছে।
ঐ চারটা কোম্পানীর সাথে নির্ধারিত প্রোগ্রাম ছাড়াও আমাদের আরো কিছু বিজনেস প্লান নির্ধারন করাছিল। ঢাকা থেকে আসার আগেই এখানে আরো অনেক ব্যবসায়ীদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে-সেই সব ব্যাবসায়ীদের সাথে মিট করবো, ওদের ফ্যাক্টরী ভিজিট করবো, নতুন কোনো বিজনেস ডেভেলপমেন্ট করবো। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে সকল প্রোগ্রাম নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু যাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়নি-তেমন অনেকেই আমাদের আসার প্রোগ্রাম জানে শিয়ালকোট চেম্বার্স অব কমার্সের সৌজন্যে। তাই অনেক ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে-ব্যবসায়ীক স্বার্থে।
আমাদের সাথে নাসের মাহমুদের সেই শস্রু মন্ডিত দুই পাঠান শার্দূল “রাজাকার”(বডি গার্ড) আছে-ওদের হাতে অত্যাধুনিক একে ফোর্টি ফাইফ। গত রাতে এই সিকিউরিটি গার্ডদের চেহারা ভালকরে লক্ষ করিনি। এখন দেখে চক্ষু চড়ক গাছ! পুরা “আবদুর রহমান”(সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইয়ের আফগান ভৃত্য আবদুর রহমানের কথা বলছি)! ওরা লম্বায় সাড়ে ছয়ফিটের কমনা-বয়স ৩০/ ৪০ কিম্বা ৫০ হতে পারে। পড়নে জল্লাদের মতো কালো সালওয়ার-কূর্তা, এমন জল্লাদের ড্রেস স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত আল বদর বাহিনীর সদস্যরা পরতো! কোয়ান্টম মেথড খ্যাত 'মহা জাতক' সাহেবও একই ড্রেস পরেন । যতদিন পাকিস্তানে ছিলাম দুই বডি গার্ড রাজাকার আমাদেরকে “আচ্ছালামু আলাইকুম”("সালাম ছাব")-বলা ভিন্ন ওদেরকে আরকোনো কথা বলতে দেখিনি-তবে কিছু জিজ্ঞেশ করলে ১/২ শব্দেই জবাদ দিত।
আমি তালেবানী সন্ত্রাসীদের ভয় নাপেলেও অজানা কারনে জুম্মন-হিকমতকে ভয়পাচ্ছি! মনে হচ্ছে ওরাই ৭১ এর আলবদর। আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের পাশে হিকমত, পিছনের সীটে জুম্মন। ওদের দুইজনের বন্দুকের মাঝে আমরা তিন জন।
নাসের মাহমুদ ছাড়াও শিয়ালকোটে আমার অনেকজন ব্যবসায়ীর সাথে দীর্ঘদিনের ব্যাবসায়ীক সম্পর্ক আছে। ব্যাবসায়ীক সম্পর্কের বাইরে অনেকজন পরিচিত মানুষও আছেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম আলীম ভাই। যিনি ঢাকাস্থ্য শাহ স্পোর্টসের মালিক। বাংলাদেশেই উনি আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। এখন ঢাকাতে মাঝে মাঝে যান-তবে শিয়ালকোট নিজ বাড়িতে এবং দুবাইর বাড়িতে বেশীর ভাগ সময় থাকেন। ঢাকাতে ওনার ভাইর ছেলেরা শাহ স্পোর্টস চালায়।
আলীম ভাই শিয়ালকোটেই নয় সারা পাকিস্তানেও শাহ স্পোর্টসের মালিক এবং বিখ্যাত স্পোর্টস গুডস ব্যবসায়ী হিসেবে ওয়ার্ড ওয়াইড পরিচিত। পাকিস্তানের বাইরেও শাহ স্পোর্টের শাখা/এজেন্ট আছে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া,দুবাই, স্পেন, ইতালী, লন্ডন ও জার্মানীতে। চার জন বিবির মালিক ৭৫ পেরুনো ইয়াং আলীম ভাই! আলীম ভাইর চার বিবির মধ্যে একজন গত হয়েছেন। ছোট বিবির বয়স ৩০ এর বেশী নাহবার সম্ভাবনা -তিনি ছোট বিবিকে নিয়ে বেশীর ভাগ সময়ই দুবাই থাকেন! আলীম ভাইর হাত ধরেই পাকিস্তানের বেশীরভাগ কৃকেট, হকির তারকা প্লেয়ার বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের হয়ে খেলার পথ খুঁজে পেয়েছিল। তার হাতধরেই অনেক পাকিস্তানীই বাংলাদেশে ব্যাবসায় প্রশার লাভ করেছেন-নাসের মাহমুদও তাদের মধ্যে একজন।
প্রথমেই আমি আলীম ভাইকে কল দেই। উনি বললেন-আগে ওনার বাড়ি হয়ে তারপর অন্য যেসকল প্রোগ্রাম আছে-তা শুরু করার জন্য।
হোটেল তাজ প্যালেস থেকে শিয়ালকোট সিটির রোড ধরে আমরা যাচ্ছি আলীম ভাইর বাড়ি
আমরা আলীম ভাইর সাথে দেখাকরে চলে যাই ট্রাক অব সার্জিক্যাল ইন্ডাস্ট্রীজ,টাংগো স্পোর্স্ট (পাকিস্তান), এডিডাস (পাকিস্তান) সহ অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের এর মালিক মিঃ সফদার বাট’'র অফিসে, যার সাথে আগে থেকেই আমাদের এপয়েনমেন্ট করাছিল। মিঃ সফদার বাট-ইনিই পাকিস্তান কৃকেটবোর্ডের চেয়ারম্যান ইজাজ বাটের বড় ভাই। মিঃ বাট একসময় সাধারন শ্রমিক থেকে এখন শিল্পপতি।
অর্থাভাবে ছেলেবেলায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু ব্যাবসায়ীক মেধা, সততা আর পরিশ্রমে আজ শুধু শিয়ালকোটের নয়, তিনি এখন পাকিস্তানের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যাক্তি। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নানিতে পারলেও পরিবারের অন্যদের নিজের শ্রমের উপার্জনে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। শরীয়তমতে উনারও চারজন বিবি(৬০ পেরুনো পাকিস্তানীদের মধ্যে অনেকেরই একাধিক বিবি)। দুই বিবি বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন ইংল্যান্ড।
এক বিবি লসএঞ্জেলস এবং এখানেও একজন বিবি নিয়ে মাঝে মাঝে থাকেন। উনার ১৮ জন সন্তান সন্ততি।
মিঃ সফদার বাট এর কর্পোরেট অফিস, শিয়ালকোট। (ছবিটি ওনার ওয়েব সাইট থেকে নেয়া)
মাত্র কিছুদিন আগেই মিঃ বাটকে তালেবানী সন্ত্রাসীরা অপহরন করে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের সব পত্রিকায় খবরে প্রকাশ-কোটি ডলার মুক্তিপন দিয়ে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন।
এখন তাঁর সাথে এক কোম্পানী প্রাইভেট রাজাকার(সিকিউরিটি গার্ড) ছারাও VIP হিসেবে সরকার থেকেও বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করেন।
আমারমত ব্যাবসায়ীকে তিনি কেয়ার নাকরলেও পারেন। কিন্তু তিনি জাত ব্যাবসায়ী। তাই সকল ব্যাবসায়ীদেরকেই সমান সম্মান ও গুরুত্বের সাথে দেখেন। আমার প্রতি স্নেহ এবং উনার কোম্পানীর পন্যের প্রচারের জন্যই নামমাত্র মূল্যে আমাদের সাথে ব্যাবসা করছেন এবং আমার কোম্পানীর মাধ্যমেই ইউনাইটেড, স্কয়ার, এপোলো হাসপাতালের সিংহ ভাগ সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস প্রোভাইড করেছেন।
ব্যাবসায়ীক কারনে তিনি একবার ঢাকাতে এসেছিলেন-আমার অতিথি হয়ে।
আমাদের ব্যাবসায়ীক আলোচনা শেষে গেস্ট/হোস্ট মিলে আমরা ২০ জনেরমত মিঃ বাট এর দেয়া লাঞ্চ পার্টিতে অংশ নেই শিয়ালকোটের আর এক বিখ্যাত “সিলভার স্পুন হোটেল”এ।
২য় পর্বের লিংকঃ- Click This Link
(পরের পর্বে.........) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।