মাথায় অনেক গল্প আসে; কিন্তু লেখার মত পর্যাপ্ত ধৈর্য-শ্রম-অধ্যবসায় নেই। গল্পগুলোকে তাই ছোট করে কবিতা বানাই....
ফ্রান্সের ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প নিয়ে একেকটা চমৎকার উপন্যাস লিখে ফেলা যায়; এই আন্দোলন নিয়ে বানানো কোনও সিনেমার কথা কেন শুনিনি - এটাই আমার কাছে এখন বিস্ময়কর লাগছে ! ক'টা তরুণ ছেলে-মেয়ের অদ্ভূত অ্যাডভেঞ্চার আর তারপর পৃথিবীর চিত্রশিল্পের ইতিহাসকে চিরতরে পাল্টে দেয়ার এক গল্প - ইম্প্রেশনিজম ! এদের মাঝে সাত জনের গল্প এই সিরিজ বলা হয়ে গেছে। আজ বলব ইম্প্রেশনিজমের প্রধানতম এক শিল্পীর গল্প - যিনি ছিলেন এই ধারার সবচেয়ে ধারাবাহিক আর গুরুত্বপূর্ণ একজন, ক্যানভাসের বুকে নতুন ঝলমলে জগৎকে গড়ে তোলার এক অন্যতম কারিগর, 'ইম্প্রেশনিজম' নামটাই এসেছে যার পেইন্টিংস থেকে, আমাদের আজকের শিল্পী - ক্লদ মনে' (Claude Monet)
সেল্ফ পোর্ট্রেট
ক্লদ অস্কার মনে'র জন্ম ১৮৪০-এর নভেম্বরে, প্যারিসে। বাবা'র নাম ক্লদ অ্যাডল্ফ মনে', তাই আমাদের শিল্পী মনে'কে বাড়িতে ডাকা হত 'অস্কার' নামে। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে তার মতই মুদি'র দোকানদার হয়ে সুখে-শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দিবে, কিন্তু অস্কারের স্বপ্ন ছিল ছবির জগতে।
বালক বয়সেই স্থানীয় পর্যায়ে নানারকম সামাজিক-রাজনৈতিক কার্টুন-ক্যারিক্যাচার এঁকে বেশ নাম কামিয়ে ফেললেন মনে'। বয়স যখন ষোল, একদিন সাগর-সৈকতে শিল্পী ইউজিন বডিন (Eugène Boudin)-এর পেইন্টিংস দেখে দারুণ অনুপ্রাণিত হলেন, বডিনের কাছ থেকেই তারপর শিখে নিলেন তেলরং-এর ব্যাপার-স্যাপার। ওই বয়সেই মনে'র মায়ের মৃত্যু হয়। ঘরের বাঁধন আলগা হয়ে গেল, তার ওপর অমন অনর্থক স্কুলে আসা-যাওয়া ছেড়ে দেওয়াটাই কর্তব্য - এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে' চলে গেলেন তার এক নিঃসন্তান খালার বাড়িতে।
স্কুল পালালেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না, তবে রবীন্দ্রনাথ টাইপের কিছু হতে হলে মনে হয় স্কুল পালানোটাও জরুরী।
মনে' চলে গেলেন ল্যুভ'রে, অন্যান্য শিক্ষানবীশদের সাথে ছবি আঁকতে। তবে নিজের ইতিহাসের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই মনে' এখানেও পলাতক। সবাই যখন ওল্ড মাস্টারদের অসাধারণ সব পেইন্টিংস প্র্যাকটিস করছে, ক্লদ অস্কার মনে' তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে যা দেখা যায় তা-ই এঁকে ফেলার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। এসব ক্ষ্যাপাটে কার্যকলাপের মাঝেই একসময় পরিচিত হলেন আরও বেশ ক'জন শিল্পী'র, যাদের মাঝে আছেন ইম্প্রেশনিজমের এক পথিকৃৎ - এদুয়ার্দ মানে' (Édouard Manet)।
১৮৬২ সালে চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এল এক মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ - মনে' গিয়ে উপস্থিত হলেন চার্লস গ্লেয়ারের আর্ট স্কুলে।
ঠিক সেই সময় সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জুটছিলেন তার মত আরও ক'জন ক্ষ্যাপাটে তরুণ, এই সিরিজের সাথে থাকলে নামগুলো চেনার কথা - পিয়ের-আগুস্তে রেনোয়া, ফ্রেডরিখ বাযিল এবং আলফ্রেড সিসলী ! এই চার বন্ধু ব্রাশ-স্ট্রোক এবং রং-এর ব্যবহারের ভিন্নতায়, ফর্ম আর টেকনিকের নতুনত্বে সৃষ্টি করতে লাগল এক অভিনব শিল্পের ধারা; যেই ধারা আজ পৃথিবী'র লোকে চেনে 'ইম্প্রেশনিজম' নামে ! তবে গল্পটা অত সহজ ছিল না অবশ্যই। মনে'র পথচলা এখন সবে শুরু !
এই নতুন শিল্পীরা সাথে পেল তাদের মত চিন্তাধারার আরও ক'জনকে, যেমন কামিল পিসারো, এদগার দেগা। তবে ক্লাসিক্যাল একাডেমি এই ধরণের শিল্পকে মোটেই ভাল চোখে দেখল না। এরা প্রথাগত শিল্পের নিয়মে পৌরাণিক কাহিনী বা ধর্মতত্ত্বের কোনও মহান প্লট নিয়ে ছবি আঁকে না! এদের ছবিতে ক্রসবিদ্ধ জীসাস বা মাউন্ট অলিম্পাসের দেব-দেবী'রা নেই, এমনকী কোনও রাজ-দরবার বা ঐতিহাসিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটও নেই - বরং কারও ছবিতে আছে ধানক্ষেতে কাজ করা কিষাণীর গল্প, কারও ক্যানভাসে কাঠমিস্ত্রীদের কার্যকলাপ, কেউ আবার দেখা যায় ছবিতে নিজের বান্ধবী'র সাথে নাচ-গানে ব্যস্ত ! শিল্পের মত একটা বিশুদ্ধ বিষয়ে এসব হালকা বিষয় এনে ফাজলেমি করার কোনও মানে হয়? তাই দূর্দান্ত পান্ডিত্যপূর্ণ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে একাডেমি তাদের পেইন্টিংসগুলো স্যালন এক্সিবিশন থেকে বাতিল করতে লাগল। মনে'র প্রথমদিকের কিছু কিছু কাজ স্যালন এক্সিবিশনে গ্রহন করা হলেও ধীরে ধীরে বাতিলের সংখ্যাই বাড়তে লাগল (একই অভিজ্ঞতা এই গ্রুপের সকল শিল্পীর জীবনে)।
প্রথমদিকের গ্রহনযোগ্যতা পাওয়া কাজগুলোর মাঝে ছিল তার মডেল কামিল দঁস্যিয়ু'র ছবি, এই মডেলকে মনে' পরে বিয়ে করেছিলেন।
কামিল দঁস্যিয়ু। মনে'র ছবিতে বারবার দেখা যায় তাকে।
তবে মনে' তার অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা দেখাতে লাগলেন ল্যান্ডস্কেপে। তার তুলিতে প্রকৃতি যেন প্রথমবারের মত সত্যিকারের জীবন পাচ্ছিল ! আর সেই জীবন কোনও স্থিরচিত্র না, চলমান এবং প্রাণবন্ত জীবন!
এবং মনে'র ছবিগুলো দেখলে আমি সবসময় অবাক হয়ে যেটা দেখি, সেটা হল পানির চিত্ররূপ ! পানি কখনই কোনও স্থির বস্তু না, একে মুঠোয় ধরেও রাখা যায় না, এর নিজের রং নেই - যখন যেই পরিবেশে রাখা হবে, তখন সেখানে পানির সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ।
আর এমন দুঃসাধ্য একটা কাজ মনে' করতে শুরু করলেন চরম অবলীলায় !
মনে'র ক্যানভাসে পানি যেন শুধু একটা উপস্থিতি নয়, পানিই ছবির মূল বিষয় আর অনুঘটক !
পানিতেই বুর্জোয়া নাগরিক জীবনের প্রতিফলন
এই শিল্পী জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন পানির খুব কাছাকাছি। সাগর হোক কিংবা লেক; পরম সৌভাগ্যবতী সীন নদী তো আছেই ! পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনও নদীকে শিল্পীর চোখে এতটা পর্যবেক্ষণ করা হয়নি, এতটা আঁকা হয়নি - যতটা করে গেছেন ইম্প্রেশনিস্টরা !
পানির প্রশান্ত ভাব কিংবা উচ্ছ্বাস জাগা, স্থিরতা বা প্রবাহমানতা - সব যেন মনে' ধরে রাখবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ! আর এতটা বাস্তব হওয়ার কারণ - ইম্প্রেশনিস্টরা কোনও ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে ঘরে ফিরে গিয়ে কল্পনার রঙে ফিনিশিং দিতেন না, বাইরে বাস্তব আলোয় যা দেখা যায় তাই এঁকে রাখতেন শুধু !
এই জায়গাটার ছবি ওখানে গিয়ে আঁকতে যাওয়াটা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না ! একবার ওখানে মনে' ছবি আঁকায় এতই মগ্ন ছিলেন, জোয়ার-ভাটা'র সময়জ্ঞান আর ছিল না। হঠাৎ চমকে দেখেন জলের প্রবল উচ্ছাসে তার ক্যানভাস-রং-ব্রাশ সব ভেসে যেতে লাগল, পানির টানে ভেসে গেলেন শিল্পী নিজেও ! এরকম পাথুরে সৈকতে ব্যাপারটা চূড়ান্ত ভয়াবহ হতে পারত; মনে' নিজেও অক্ষত অবস্থায় ফিরেননি। ছেঁড়া-ফাটা কাপড়-জামায় কোনও মতে পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে ফেরেন। এবং তারপর সময় করে আবার ওখানে গিয়েই ছবি আঁকতে শুরু করেন ! স্পটের ছবি তাকে ওই স্পটে বসেই আঁকতে হবে !
ফ্রান্সে তখন ট্রেন আসলো নতুন।
মনে'র ছবিতে তার প্রভাব দেখা যায়, তবে পানিকে বাদ দিয়ে নয় অবশ্যই !
মনে'র ছবিতে এর গবেষণা ছিল ভিন্ন আলোয়, তবে আরও স্পষ্ট করে বললে, মনে'র গবেষণা ছিল মূলত ভিন্ন ছায়ায়।
মনে' আর রেনোয়া'রা দেখাতে লাগলেন, শুধু রং গাঢ় করে দিলেই ছায়া হয়ে যায় না, বরং ছায়ারও নিজস্ব রং আছে। এমনকী বরফের ওপর যে ছায়া পড়ে তার রংও বেরসিক ধূসর না ! সেই ছায়া নীল, বেগুনী, পার্পল, সবুজাভ আরও কত রং হতে পারে, যেগুলো আমরা কখনও খেয়াল করেই দেখি না !
অথবা দেখতে পারেন বনের মাঝে শেষ বিকেলের শেষ ছায়াটার খেলা !
বনের মাঝে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে পিকনিক~
এই ছবির সামান্য ইতিহাস আছে। মনে'র খুব ঘনিষ্ট বন্ধু বাযিল'এর মাথায় এই আইডিয়া আসে - আউটডোরে গিয়ে বাস্তব মডেলদের নিয়ে লাইফ-সাইজ ফিগার পেইন্টিং আঁকার। মাত্র ২৮ বছর বয়সে যুদ্ধে মারা যাওয়ায় বাযিল কখনই সেই সময় পাননি।
মনে পেয়েছেন দীর্ঘ সময়, তিনি এঁকে বসলেন একেবারে ডাবল-লাইফ সাইজ ফিগার পেইন্টিং ! তবে, পাগলের মত যতই ছবি নিয়ে মেতে থাকুন, তার ছিল টাকা-পয়সার সার্বক্ষণিক অনটন। বকেয়া ভাড়ার দায়ে বাড়িওয়ালার কাছে বন্ধক রাখলেন তার বিশাল পরিশ্রমের এই মাস্টারপিস। অনেক পরে যখন টাকা হাতে ছবি ফিরিয়ে নিতে আসলেন, এসে দেখেন ছবির অনেক জায়গাই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে ! বেঁচে যাওয়া দুটো টুকরোই এখন পরম যত্নে রক্ষিত আছে মিউজিয়ামে।
আর ওপরে পিকনিকের যে পূর্ণাঙ্গ ছবিটা দেখলেন, সেটা পরবর্তীতে তার আঁকা অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের একটা পেইন্টিং।
পেইন্টিং ছিল মনে'র জীবন।
শুধু দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ না, এই পেইন্টিঙের জন্য মনে' অনেকবার জীবনের ঝুঁকিও নিয়েছেন। পাথুরে সৈকতে ওই পানিপথের যুদ্ধের গল্প তো বললাম, স্থলপথেও তার ঝুঁকি নেয়ার ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য দেখা যায় না। তার বিখ্যাত স্টেশন চিত্রমালার গল্পটা শুনুন তাহলে~
আগেই বলেছি, ফ্রান্সে ট্রেন তখন নতুন। আর নতুন আর অভিনব সবখানেই ইম্প্রেশনিস্টদের যাওয়া চাই ! মনে'র ইচ্ছা হল, স্টেশনের ভেতরের অংশ থেকে ছবি আঁকবেন। ওসব জায়গায় তখন সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু মনে'কে ওখান থেকেই আঁকতে হবে।
রেনোয়া ঘোষণা করে বসলেন, মনে' পাগল হয়ে গেছেন; তবে পাগলামীর তখন সবে শুরু। স্টেশনের অভ্যন্তরে ওই কারিগরী স্থানগুলোতে যেতে হলে ওপরের নির্দেশ লাগত, বিশাল ফর্মালিটির ব্যাপার-স্যাপার - অন্তত মাসখানেরকের ঝক্কি। মনে' সবটা করলেন একদিনে, কারও সাহায্য ছাড়া ! মনে' সেদিন তার সবচেয়ে পশ জামা-কাপড় পড়ে রওনা হলেন স্টেশনের দিকে। সরাসরি গিয়ে তিনি স্টেশন ডিরেক্টরের সাতে দেখা করতে চাইলেন, নিজের পরিচয় দিলেন জগদ্বিখ্যাত শিল্পী ক্লদ মনে' বলে। স্টেশনের লোকজন মাথা চুলকে 'কত মণ কয়লায় কতখানি বাষ্প' এসব হিসাবে ব্যস্ত, তাই এই জগদ্বিখ্যাত শিল্পীকে চেনে না বলে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না।
তা কী চান তিনি? মনে' এক চমকপ্রদ প্রস্তাব করলেন - একদিনের জন্য কয়েকটা ট্রেন কিছুটা দেরীতে ছাড়তে হবে, এবং ওই ট্রেনগুলো সব এক করে একসাথে ইঞ্জিন চালু রাখতে হবে, যাতে বাষ্পে ঢেকে যায় চারপাশ ! মাথা খারাপ? সরাসরি জবাব এল, 'অসম্ভব'। মনে তখন গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, 'তাহলে মনে হচ্ছে এই পেইন্টিংটা গার ড্যু-নর স্টেশনেই করতে হবে। ওখানকার স্টেশন-ডিরেক্টরকে বেশ আগ্রহীই মনে হচ্ছিল...' দ্বন্দ্বে পরে গেলেন এই ডিরেক্টর। তার স্টেশনকে জগদ্বিখ্যাত হবার এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে কিনা ভেভে উঠতে পারছিলেন না...
পরদিন দেখা গেল, রং-ব্রাশ-ক্যানভাস হাতে ক্লদ অস্কার মনে' স্টেশনে প্রবেশ করছেন!
এই ছিলেন মনে'। অনেকটা ক্ষ্যাপাটে কিন্তু ভয়ানক স্মার্ট ! তবে ভয়-ডরহীন।
ঝুঁকি'র কথা তো বলা হল না, এই স্টেশনে সবকটা ইঞ্জিন একসাথে চালু করে তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকার ঝুঁকি শুধু পাগলের মাতায় আসবে। কিন্তু মনে' ছিলেন ছবির জন্য সত্যিকারের পাগল! বাকিটা BBC'র ডকুমেন্টারী'র ভাষায় শুনুন,
"Monet could have died painting his station pictures, choking on carbon-monoxide and smoke. But he was an Impressionist. And Impressionists dont take shortcuts."
এসব পাগলামীর মাঝেও স্ত্রী কামিল ছিলেন মনে'র জীবনের সত্যিকারের প্রেম। ছবিতে তিনি কামিলকে ধরে রেখেছিলেন গাঢ় যত্নে~
কামিল এবং তাদের পুত্র জাঁ মনে'
১৮৭৯-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে কামিল যক্ষায় মারা গেলে মনে' শোকে ভেঙে পড়েন। কামিলের মৃত্যুর পর তার পাশে বসে আঁকেন কামিলের ডেথবেড-এর ছবি... এই লোকটার জীবন কি ছবির মাঝেই ছিল না? কামিলের মৃত্যুর প্রায় ১৩-১৪ বছর পর মনে' আবার বিয়ে করেন বিধবা অ্যালিস'কে। কামিলের মৃত্যুর পর এই অ্যালিস'ই মনে'র ছেলেদের লালনপালন করেছিলেন।
সে আরেক দীর্ঘ গল্প, ওদিকে যাব না।
ব্যক্তিগত গল্প ছেড়ে আবার মনে'র ছবির জগতে যাই, চলেন। ইম্পরেশনিজম আন্দোলনের প্রথম এক্সিবিশনেই মনে' এক অদ্ভূত ছবি দিয়ে বসলেন। মূলত, এই এক্সিবিশন তখনও 'ইম্প্রেশনিজম' নামে পরিচিত ছিল না। শুধুমাত্র এই একটা ছবির কারণেই ওই নামের উদ্ভব, আর এই একটা পাগলাটে ছবির জন্যেই এই ধারার শিল্পীরা আজ বিশ্বে ইম্প্রেশনিস্ট নামে পরিচিত ! ছবিটা একবার দেখুন~
সত্যি অদ্ভুতূরে একটা ছবি, কিছুই তো বোঝা যায় না - এসব কী? এই ছবি'র একটা ব্যতিক্রম ইতিহাস আছে।
'ইম্প্রেশনিজম' আন্দোলন নিয়ে একটা আলাদা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে আমার। সেই পোস্টে এই ছবি নিয়ে অনেক কথা বলতে হবে, তাই আজ আর বলছি না। এক কষ্ট দু'বার করার কোনও মানে হয় না !
ক্লদ মনে'র ছবি নিয়ে গল্প করতে বসলে তো আলিফ লায়লা'র কাহিনী হয়ে যাবে, এক রাতে শেষ হবে না ! অতশত না বলে তাই আরেকটা মাত্র ছবির গল্পে যাব আজ। এক ক্যানভাস মহাকাব্য। তার আগে বলে রাখি, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিশ-শতকের শুরুতে মনে একের পর এক মাস্টারপিসে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
সেই সাথে তিনি শুরু করলেন 'সিরিজ-পেইন্টিংস'। একই দৃশ্যের ছবি কিন্তু বিভিন্ন ঋতুতে এবং সব ঋতুতে দিনের বিভিন্ন সময়ে, সূর্যের আলোর বিভিন্ন পজিশনে তিনি এঁকে যেতে লাগলেন অপূর্ব দক্ষতায় ! এর আগে অন্যান্য ইম্প্রেশনিস্টদের গল্পেও এমনটা পড়েছিলেন, না? তবে, মনে' ছিলেন সবটাতেই ইউনিক, সবার ওপরে একজন ! অতসব ছবি তো আমি দিতে পারব না, উইকি লিঙ্ক দিচ্ছি, সবকটা লিঙ্কে গিয়ে একটু স্ক্রল করলেই দেখতে পাবেন সিরিজ ছবিগুলো।
> Houses of Parliament series (Monet)
> Haystacks (Monet)
> Water Lilies
> Poplar Series (Monet)
> Rouen Cathedral (Monet)
সবশেষে আসি মনে'র শেষজীবনের এক বিস্ময়কর সৃষ্টিকর্মে। জলপদ্ম ! মনে'র 'ওয়াটারলিলি'গুলো ছিল সত্যিকারের ক্যানভাস মহাকাব্য ! ছবিতে কোনও কাহিনী নেই, বিষয় নেই, আবেগ-এক্সপ্রেশন নেই, আছে শুধু জলপদ্ম !
আর এই ছবি এঁকে মনে' দেয়ালের পর দেয়াল ভরিয়ে ফেললেন !
জলের মাঝেই প্রকৃতির রূপ, রৌদ্র-ছায়া-মেঘ-কুয়াশা-স্বচ্ছতা সব ওই জলে আর পদ্মে !
বিশ বছর ধরে মনে' এঁকে চললেন পেইন্টিংসের বিস্ময়কর এক জগৎ ! মনে' তার শেষ জীবনটা পুরোপুরি কাটিয়েছেন এই বাগানবাড়িতে। আর অমর করে গেছেন তার নিজের ডিজাইন করা এই বাগানের শান্ত-স্নিগ্ধতা !
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপরটা এবার বলি।
এই ছবিগুলো আঁকার সময় মনে'র বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। ছানি পড়ায় চোখে দেখতেন না ভাল, সব কেমন হলুদাভ দেখতেন - আর সেই সময়টায় মনে' 'নীল' এবং 'সবুজ' রংদুটো তেমন দেখতেই পেতেন না ! টিউবের গায়ে লেবেল দেখে বুঝতেন কোনটা নীল আর কোনটা সবুজ ! আর তাতেই ক্যানভাস ভাসিয়ে দিয়েছেন সত্যিকারের জলে আর পদ্মে !
'ওয়াটারলিলি'র বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আমি যেতে পারব না। শাহেদের ব্যাখ্যা শাহেদের কাছে থাকুক, আপনি আপনার মুগ্ধতায় মনে'র জলপদ্মকে নতুন করে আবিষ্কার করবেন, এই আশা রাখছি। একই আশা রাখছি মনে'র সারা জীবনের অসাধারন সব চিত্রকর্মের ব্যাপারেও !
ক্লদ অস্কার মনে' - ইম্প্রেশনিস্টদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিভাবান, এবং সৌভাগ্যের ব্যাপার সবচেয়ে দীর্ঘজীবিও ছিলন তিনি। ৮৬ বছরের জীবনের সমস্তটাই তিনি ঢেলে দিয়েছেন ক্যানভাসে।
ক্ষ্যাপাটে স্বভাব, বুনো সাহস, ভালবাসার প্রতি তীব্র স্পর্শকাতরতা, রং আর ব্রাশের ব্যবহারে বিরল প্রতিভা, প্রকৃতি আর জলের জীবন্ত উপস্থিতি - সবটা মিলে মনে'কে করে গেছে এক অনন্য অসাধারণ শিল্পী ! সেই ক্ষ্যাপাটে তরুণের দেখা হয়তো আমরা কখনও পাবো না, তবে আমরা চাইলেই হারিয়ে যেতে পারি তার রেখে যাওয়া আলো-ঝলমলে এক দুনিয়ায় - যে দুনিয়া সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল, যে দুনিয়া নিখাদ রঙে পরিপূর্ণ !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।