মাথায় অনেক গল্প আসে; কিন্তু লেখার মত পর্যাপ্ত ধৈর্য-শ্রম-অধ্যবসায় নেই। গল্পগুলোকে তাই ছোট করে কবিতা বানাই....
রবিবার, সাপ্তাহিক ছুটি'র দিন। দুপুর থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে একটানা। কফি বানিয়ে হোটেলরুমের জানালার পাশে এসে বসলাম - দেখতে লাগলাম বৃষ্টিভেজা এই অচেনা শহর আর শহরের মানুষগুলোকে। হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, এখন পিসারো উপস্থিত থাকলে তিনি কিভাবে দেখতেন এই জনজীবন? আর কিভাবেই বা এঁকে রাখতেন? যে মানুষটার প্রায় একক প্রচেষ্টায় পৃথিবীর পুরো চিত্রশিল্পের ইতিহাসই পাল্টে যেতে শুরু করেছিল, তার চোখে এক-পৃথিবী দেখার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
কামিল পিসারো (Camille Pissarro) - তাকে বলা হয় 'ইম্প্রেশনিজম'-এর জনক। তবে এমন জনক না, যে জন্ম দেয়ার পরই সন্তানকে ছেড়ে-ছুড়ে চলে যায়; কামিল পিসারো ইম্প্রেশনিজমকে গড়েছেন, লালন-পালন করেছেন, আর শুধু 'শিল্প' না - সব 'শিল্পী'দের প্রতিও তিনি সবসময় থেকেছেন এক নিরলস অভিভাবকের মত। পিসারো যেন আরেক ক্লাসিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র! ব্যক্তিগত জীবনে তাকে প্রচুর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সারাটা জীবন; তাই যখনই কোনও শিল্পীকে তার মত সংগ্রাম করতে দেখেছেন, তিনি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন ছায়ার মত। অথচ শিল্প-আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবে তার মত একজনের আগমনটা ছিল আর্টের জগতে সবচেয়ে অদ্ভূতুরে ঘটনাগুলো'র মধ্যে একটা ! অদ্ভূত বলছি তার ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে ! একেবারে অকল্পনীয় একটা জায়গা থেকে উঠে এসে একটা ছেলে কিভাবে আর্টের ইতিহাস পাল্টে দিল - আজ বলব সেই গল্প ! ইম্প্রেশনিস্টদের ঝলমলে দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগতম !
কামিল পিসারো
যে লোকটার হাত ধরে প্যারিসে শিল্পজগতের সবচেয়ে নাটকীয় বিপ্লবটা হয়ে যাচ্ছিল, তার জন্মস্থান কোথায় - এটা আপনাকে অনুমান করতে দিলে আমার ধারণা আপনি কিছুতেই তার জন্মভূমি দেশ'টার কথা ভাবতে যাবেন না ! প্যারিস থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে - 'ওয়েস্ট ইন্ডিজ'এর ভার্জিন আইল্যান্ডে ! শিল্পের দুনিয়া থেকে একেবারে যতটা দূরে জন্মানো সম্ভব ! এমনকী তার বেড়ে ওঠাও প্যারিসে না ! তার ওপর, পিসারো'র জন্ম এক ইহুদী পরিবারে ! আপনাকে যদি বলা হয়, পিসারো'র আগের কোনও ইহুদী গ্রেট আর্টিস্টের নাম খুঁজে বের করতে, আপনি পাবেন না ! তেমন কেউ ছিলেনই না ! ইহুদীদের মাঝে শিল্পচর্চার ব্যাপারটা একেবারেই দেখা যেত না। কে জানে, এর কারণটা হয়তো ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ~
হিব্রু বাইবেলের সেকেন্ড কমান্ডমেন্ট, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে কোনও জীবন্ত কিছুর কোনও রকম প্রতিকৃতি তৈরি করা যাবে না।
যে কারণে, দেখা যায় খ্রিস্টানদের চার্চে জিসাস-মেরী-জোসেফের ছবি'র ছড়াছড়ি থাকলেও, ইহুদী'দের সিনাগগ'গুলোর দেয়াল সবসময় নিরেট সাদা।
ধর্মীয় বাঁধা থাকুক বা না থাকুক, পিসারো'র ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি'র অভ্যাস ছিল। তার উপর পারিবারিক একটা বিব্রতকর কাহিনী'র জন্যে তার ফ্যামিলি ছিল স্থানীয় ইহুদী সমাজে রীতিমত একঘরে (ওই বিব্রতকর কাহিনীটা এখানে বলতে চাইছি না, সেটা পোস্টের উদ্দেশ্য না)। যাই হোক, এসব কারণে ধর্মের টান প্রবল থাকার কথা না। কিশোর বয়সে বাবা তাকে ফ্রান্সের এক বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন।
ক্রমেই আর্টের প্রতি তার আকর্ষণ আর দক্ষতা বাড়তে থাকে, শুধু ছবি আঁকার জন্য এক আর্টিস্ট বন্ধুর সাথে তিনি বছরদুয়েক ভেনেজুয়েলাতেও কাটিয়ে আসেন। বয়স যখন পঁচিশ, কামিল পিসারো প্রথমবারের মত পা রাখেন চিত্ররূপময় জগৎ প্যারিসে ! তখনকার সময়ের গ্রেট আর্টিস্ট গুস্তাভ ক্যুরবে', জাঁ ফ্রাঁসোয়া মিল্যে, কামিল করোট'দের সংস্পর্শে এসে পিসারো আরো পরিণত হয়ে উঠতে থাকেন। এ কিন্তু সেই 'কামিল করোট', যিনি বার্থ মরিস' আর তার বোন এডমা'কেও শিল্পীসমাজে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন।
সিনিয়র এসব শিল্পীদের সাথে আউটডোরে ল্যান্ডস্কেপের কাজ করলেও, একটা দিক থেকে পিসারো'র সাতন্ত্র্য ঠিকই তাকে আলাদা করে ফেলছিল। অন্য শিল্পীরা আউটডোরে ছবির থিমটা তুলে নিয়ে গেলেও, পরে স্টুডিওতে গিয়ে নিখুঁত ফিনিশিং-এর কাজ করতেন, ব্যাপারটা পিসারো'র মোটেও পছন্দ হল না।
তার নিয়ম ছিল, বাইরে ঠিক যা দেখবেন, সেখানেই সেটা এঁকে শেষ করবেন, তাতে দৃশ্যের প্রাথমিক ইম্প্রেশনটুকু অটুট থাকে। পরে তিনি তার ছাত্রদেরও বলেছিলেন,
"Work at the same time upon sky, water, branches, ground, keeping everything going on and equal basis and unceasingly rework until you have got it. Paint generously and unhesitatingly, for it is best not to lose the first impression."
[ Rewald, John. The History of Impressionism, Harry Abrams, (1990) p. 458]
কোনও রকম দ্বিধা ছাড়া, উদার মনে ব্রাশ চালিয়ে যেতে। দৃশ্যটা মনের মাঝে যে প্রাথমিক ইম্প্রেশন তৈরি করে - সেটাকেই ধরে রাখতে ! পরে আবার ঘরের মাঝে গিয়ে কল্পনার রং মিশিয়ে ছবিকে 'পারফেক্ট' করার চেষ্টা তার কাছে ছিল একেবারেই অনর্থক একটা কাজ - "It is absurd to look for perfection."
এসব কারণে করোট এবং অন্যান্যদের সাথে তার মতপার্থক্য দেখা দেয়। কারণ অন্যদের মত কল্পনার রং চড়িয়ে পিসারো প্রকৃতির 'গৌরবময় গাম্ভীর্য'কে ফুটিয়ে তুলছিলেন না, তার ছবিতে ছিল চলমান বাস্তবতা। এবং তার মতের আর পথের লোকজন হিসেবে তিনি দেখা পেলেন কয়েকজন কমবয়সী তরুণ শিল্পী'র - এদের ব্রাশের কাজও অবাধ্য আর জোরালো, এদের ছবিগুলোও জীবন্ত আর চঞ্চল, এদের নামগুলো - ক্লদ মনে', ফ্রেড বাযিল, রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলী... শুরু হল এক নাটকীয় ইতিহাস ! আমি আগে থেকেই বলে আসছি, 'ইম্প্রেশনিজম'-এর ইতিহাস নিয়ে আলাদা করে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে আছে।
তার আগে আলাদা আলাদা করে এর শিল্পীদের গল্প বলে যাচ্ছি। যুদ্ধের গল্প শুরু করার আগে এর সৈনিকদের পরিচিত করিয়ে নিই, তাহলে পরে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বুঝতে সুবিধা হবে ! তাই 'ইম্প্রেশনিজম'-এর পুরো গল্পটা স্থগিত রেখে এখন আমরা চলে যাব পিসারো'র ছবির জগতে !
পিসারো যখন প্যারিসে এসে পৌঁছান, তখন এই উন্মাদনা'র শহরে যেন মহামারী লেগে গেছে ! সবকিছু অস্থির, ভয়ানক গতিশীল - প্যারিসের জীবনযাপন পাল্টে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। পরিসংখ্যান যদি চান, ১৮৫০-এ প্যারিসের লোকসংখ্যা ছিল লাখদশেক, আর ১৮৭০-এ সেটা বিশ লক্ষ ছাড়িয়ে যায় ! মাত্র দুই দশকে এই বিশাল পরিবর্তন পাল্টে দিচ্ছিল মানুষের লাইফস্টাইল, আর সেটা গাঢ় ছাপ ফেলেছিল আমাদের শিল্পীদের ওপরও... মনে' বা রেনোয়া'র প্রায় সব ছবিতে দেখা যায় আনন্দ-উৎসব, জীবনকে উপভোগের গল্প। কিন্তু ছোট গ্রাম-সমাজ থেকে আসা পিসারো'র চোখে বুর্জোয়াসমাজের এই ভোগ-বিলাসিতা বা ছেলে-মেয়েদের অবাধ উদযাপনের সাথে মানিয়ে নেয়া অত সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই দেখা যায়, পিসারো'র অধিকাংশ ছবি প্যারিসের আশেপাশের গ্রামগুলোকে ঘিরে !
প্যারিসের পত্রিকায় তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছিল, "The brightness of his palette envelops objects in atmosphere. . . He paints the smell of the earth"
লাইফস্টাইলের ক্ষেত্রেও - রেনোয়া'র ছবিতে নিখুঁত এক্সপ্রেশনে যখন নাগরিক মানুষের উচ্ছাস-চঞ্চলতা ধরা পড়ছে, ঠিক তখন পিসারো'র ছবির লোকগুলোকে দেখা যায় কাজে-কর্মে ভয়ানক ব্যাস্ত !
শুধু কর্মব্যস্ততা নয়, তার উৎসবমুখরতাও ছিল পরিশ্রমী মানুষগুলোকে নিয়ে...
প্যারিসে পিসারোকে পুরোটা সময় যেতে হয়েছে অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে।
মা এবং সৎবোনসহ এগার জনের বিশাল সংসার চালাতে হত তাকে শুধু ছবি-আঁকার পেশায়। এর মাঝে হঠাৎ ভালবেসে বিয়ে করে বসেন মায়ের এক পরিচারিকা'কে। মায়ের কাছে এ বিয়ে গ্রহনযোগ্য হয়নি, ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু পাওয়ার আশাও ছেড়ে পিসারোকে চলে যেতে হল 'ল্যুভসিয়েন' অঞ্চলে। ল্যুভসিয়েনের গ্রামীন সৌন্দর্যের কারণে নয়, পিসারো ওখানে গেলেন, কারণ ওই অঞ্চলে বাড়িভাড়া তখন সবচেয়ে কম। স্ত্রী জুলি ছিলেন নিখাদ লক্ষী ঘরণী, ফুলে-ফসলে ভরিয়ে তুললেন বাড়ির আঙ্গিনা।
সরল গ্রামীন নারীদের নিয়ে আঁকা পিসারো'র ছবিগুলোতে সেই জীবনের গল্পগুলো কি স্পষ্ট নয়?
এভাবে পিসারো অন্য এক জীবনের গল্পে ভরিয়ে তুলতে লাগলেন ক্যানভাস, কিন্তু নিখাদ 'ইম্প্রেশনিস্ট' স্টাইলে ! এবং অন্যান্য ইম্প্রেশনিস্টদেরও তিনি একতাবদ্ধ করে রাখতে লাগলেন, উৎসাহ এবং সমর্থন দিয়ে যেতে লাগলেন ক্রমাগত। প্যারিসের স্যালন এক্সিবিশন থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ইম্প্রেশনিস্ট'রা নিজেদের আলাদা প্রদর্শনী'র আয়োজন করেছিল। পিসারো ছিলেন একমাত্র শিল্পী যিনি ইম্প্রেশনিস্টদের সবক'টা শো'তেই অংশ নিয়েছিলেন এবং সর্বোতভাবে জড়িত ছিলেন। শুধু নিজে আঁকেন নি, অন্য সব শিল্পীকে সমর্থন দিয়ে গেছেন বাবা'র মত। বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মানো পল সেজান যখন একের পর এক অন্ধকার জগৎময় ছবি এঁকে যাচ্ছিলেন, পিসারো তাকে নিয়ে আসেন আলো-ঝলমলে পৃথিবীতে।
এরপর তো সেজান নিজেই একসময় হয়ে ওঠেন তার নিজস্ব ধারা'র আইকনিক ফিগার। সেজান কখনও অস্বীকার করেননি পিসারো'র অবদান, পিসারো সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন - "he was a father for me. A man to consult and a little like the good Lord"
আরেক ইম্প্রেশনিস্ট তরুণী মারি কাসাট'ও (Mary Cassatt) আর্টের সকল ক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ বন্ধু আর শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন পিসারো'কে। দেগা'র সাথে বন্ধুত্বে যখন টানা-পোড়েন চলছিল, কাসাট তখন পরম অভিভাবকের মত কাছে পান পিসারো'কে। শুধু মানসিক সমর্থন না, আর্টের জ্ঞানটুকুও পিসারো উদারভাবে বিলিয়ে যেতেন ওদের মাঝে। কাসাটের ভাষায় - "such a teacher that he could have taught the stones to draw correctly"
শুধু মূল ধারার ইম্প্রেশনিস্টরা না, পিসারো নিবিড় অভিভাবক ছিলেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম, অর্থাৎ পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট যুগের অন্য প্রধান শিল্পীদেরও - ভিনসেন্ট ভ্যান গফ, পল গগ্যাঁ আর জর্জ স্যুরা' ! স্যুরা'কে তিনিই এই গ্রুপে নিয়ে আসেন, আর তার স্টাইলে আকৃষ্ট হয়ে তিনিও স্যুরা'র পদ্ধতিতে ছবি আঁকা শুরু করেন ! তার 'ইগো'-টাইপের কোনও সমস্যাই কখনও ছিল না, দলের নবীনতম সদস্যটার কাছ থেকেও তিনি আগ্রহ নিয়ে শিখতেন, আর সেটা নিজের ছবিতে ব্যবহার করে দেখাতেন ! একটা নতুন ছেলের জন্য এর চেয়ে উৎসাহের আর কী হতে পারে? এক চিত্র সমালোচক পিসারোকে নিয়ে লিখেছিলেন~
"It is difficult to speak of Camille Pissarro . . . What we have here is a fighter from way back, a master who continually grows and courageously adapts to new theories."
তার যেন শেখার ক্ষেত্রে কোনও কৃপনতা নেই, উদারতার কোনও সীমা নেই ! এসব পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল, পিসারো যেন সত্যি কোনও উপন্যাসের মহৎ চরিত্র ! তিনি নিজে সারাটা জীবনের চরম অভাবের মধ্যে শিল্পচর্চা করেছেন, তাই কোনও শিল্পীকে সংগ্রাম করতে দেখলে তিনি তার সবটুকু সমর্থন ঢেলে দিতেন।
'ডট' বা 'পয়েন্ট' পদ্ধতি ব্যবহার করে আঁকা ছবি
তবে, স্যুরা'র এই স্টাইল অর্থাৎ 'নিও-ইম্প্রেশনিজম'এর ধারা তিনি বছর-চারেক পর ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার মনে হচ্ছিল - এতে আলোক-বর্ণালী'র জাদু দেখা গেলেও, জীবনের চঞ্চলতা নেই ! তার উদ্দেশ্য তো নিখুঁত-শিল্প নয়, তার উদ্দেশ্য বাস্তব এবং গতিশীল জীবনের 'ইম্প্রেশন' ! পিসারো আবার আগের স্টাইলে ফিরে গিয়ে সৃষ্টি করতে লাগলেন একের পর এক মাস্টারপিস !
শহুরে মানুষের ফূর্তিময় জীবন না আঁকলেও, বিশাল-পরিসরে শহরের উদ্দাম-জীবন তিনি ঠিকই আঁকছিলেন ! তিনি একই স্থানের দৃশ্য বারবার এঁকেছেন, তবে কাইবট'এর মত বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে নয়, বরং বিভিন্ন সময় এবং আব-হাওয়া থেকে !
মঁমার্ত্রে'র সড়কপথের এই চিত্রমালা দেখুন, একটাই ছবি অথচ ভিন্ন সময় আর ভিন্ন ঋতুতে~
বৃষ্টিভেজা দিনে
অথবা বিকেলের আলোয়
ঘোর আঁধার দিনে
মিস্টি কুয়াশার ওপর হালকা রোদে
শীতের সকালে
বসন্তকালে
সূর্যাস্তে
কিংবা ভেজা রাতে
এবং আরও ক'টা আব-হাওয়ায় তিনি তুলে ধরছিলেন প্রাকৃতিক পালাবদলের রূপ। আর এই নিরীক্ষা তিনি করে গেছেন আরও অনেকগুলো লোকেশনে। শহুরে রাজপথের ওপর ঋতুবদল নিয়ে এমন গবেষণার চিন্তা ক'জনের মাথায় আসে? কিন্তু তারা এসেছিলেন সবকিছু ভিন্নভাবে চিন্তা করতে !
পিসারো'র ল্যান্ডস্কেপে অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ছায়া'র রং ধরতে পারা ! ছায়া যে শুধু রং গাঢ় করলেই হয় না, বরং এতে আলোক-বর্ণালীর অন্যান্য রংও ছরিয়ে পড়ে - মনে' এবং সিসলীদের সাথে পিসারোও সেই প্রকৃত রং খুঁজে যাচ্ছিলেন ক্রমাগত ! তবে এসব দেখে ভাববেন না, পিসারো শুধু ল্যান্ডস্কেপ বা পরিশ্রমী মানুষদের ফিগার নিয়েই কাজ করেছেন; তার আঁকা পোর্ট্রেটও কিন্তু গাঢ় মমতার। আগেই বলেছি, ছোট-গ্রামীন সংস্কার এবং সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন পিসারো; তাই নারী পুরুষের অবাধ উদযাপন বা এমনকী ন্যুড-স্টাডিতেও তার তেমন চর্চা দেখা যায় না।
তিনি পোর্ট্রেট এঁকে গেছেন চেনা-পরিচিত আপন মানুষগুলোর। তার আদুরে ছেলে-মেয়েদের কিছু ছবি নিচে দিলাম~
আর নিজের চোখে নিজেকে -
সেল্ফ-পোর্ট্রেট
কামিল পিসারো - ইম্প্রেশনিস্ট আর্টিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কেউ না, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি তিনি - অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বভাবে আর আচরণে, সাহায্য এবং সমর্থনে, উদারতা এবং আন্তরিকতায় তিনি ছিলেন সমস্ত শিল্পীদের অলিখিত পিতা বা "Père Pissarro" (ফাদার পিসারো)। অসাধারণ প্রতিভাবান একদল শিল্পী সেদিনের প্যারিসে শিল্পচর্চা শুরু করছিল, কিন্তু পিসারো না থাকলে এই ক্ষ্যাপাটে ছেলের দল কখনও একত্রিত হতে পারত কি না বলা যায় না। BBC'র ডকুমেন্টারীতে তাকে নিয়ে বলা হয়, "Pissarro was the glue that held Impressionism together" তার পেইন্টিংসগুলো দেখলেই মনে হয়, শুধু শিল্পের ক্ষেত্রে না, বাস্তব-জীবনেও সহজ-সরল আর পরিশ্রমী মানুষগুলোর প্রতি ছিল তার গভীর মমতা আর শ্রদ্ধাবোধ।
তার ছবিকে কটাক্ষ করে লেখা হয়েছিল - "Pissarro’s paintings, for instance, showed scenes of muddy, dirty, and unkempt settings"। তারপরও তিনি ট্র্যাডিশনাল ফিলসফিতে মহাপুরুষদের ছবি না এঁকে তার ক্যানভাসে ক্রমাগত জায়গা দিয়ে গেছেন চাষা-মজুর-কাঠুরেদের। পিসারো জীবনকে দেখেছিলেন সাধুপুরুষের উদারতায়, আর এঁকেছিলেন সাহসী শিল্পীর দক্ষতায়। অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনী'র আরও অনেক বলার মত গল্প বাকি থেকে যায়। ওসব আগ্রহী পাঠকের তদন্তের ওপর ভরসা করে আপাতত নিশ্চিন্ত হলাম।
আমি জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাই। বৃষ্টি থেমে এসেছে। নরম সূর্যের আলোয় শহরটা দেখে আমি এবার ভাবতে থকি, বৃষ্টিশেষে আবার পথে নেমে আসা জীবনের এই চঞ্চলতাকে কামিল পিসারো ঠিক কিভাবে দেখতেন...?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।