সেই ছোট বেলায় যখন প্রথম পড়তে শিখি তখন থেকেই পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি পত্র পত্রিকাও পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। বাড়িতে মা-বাবা
কাকা ও স্বজনগণ এবং স্কুলে আমাদের মহান শিক্ষক শীতেন বাবু ও আবদুল মজিদ স্যার আমাকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে যখন পড়তাম তখন পত্রিকা সংগ্রহ করার অভ্যাস গড়ে উঠে। আব্বা আমাকে কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন । আমি নিজেও কিছু মাসিক পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলাম আব্বার অনুপ্রেরনায়।
মোশারফ সাহেব পত্রিকা বিতরণ করতেন। তার দোকানের নাম ছিল ‘জাহান বুক ষ্টল’। প্রায় বিকেলেই ঐ দোকানে যেতাম পত্রিকা কেনার জন্য। ঐ দোকানে কাজ করতেন ইকবাল , তিনি আমাকে নতুন নতুন রুচিশীল পত্র পত্রিকার সন্ধান দিতেন এবং এসব পত্রিকা আমার জন্য রেখে দিতেন । সময় মতো আমি তা সংগ্রহ করে নিতাম।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ঐ দোকানে ‘গণস্বাস্থ্য’ নামে একটি পত্রিকা ঝুলিয়ে রাখা অবস্থায় দেখলাম। ইকবাল আমাকে বললেন সুন্দর একটি নতুন পত্রিকা বের হয়েছে ; ব্যতিক্রমধর্মী , রুচিশীল ও শিক্ষনীয় অনেক তথ্য সম্বৃদ্ধ। পত্রিকাটি আমি সংগ্রহ করলাম । আমার সঙ্গীদের অনেকেই আমার সাথে সাথে পত্রিকাটি সংগ্রহ করলো। পত্রিকাটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়লাম।
খুবই ভালো লাগলো , আব্বা মা ও বোনদেরও দেখালাম। সবাই পত্রিকাটির প্রশংসা করলেন। আব্বা বললেন এসব পত্রিকাই যেন পড়ি , কারণ এতে অনেক কিছু জানা ও শেখার আছে , যা জীবনে চলার পথে অনুসরণ করা উচিত। বন্ধুদের ভিতরেও দেখলাম একই অনুভূতি। ইকবালকে বলে দিলাম পত্রিকা আসলে আমার জন্য যেন তা রেখে দেওয়া হয় ।
স্বাস্থ্য চিকিৎসা অপ-চিকিৎসা , ঔষধ ও তার ব্যবহার এবং অপ-ব্যবহার সম্পর্কে অনেক তথ্যই এই পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধ এবং এতে ডাঃ জাফরুল্লা চৌধুরীর ভূমিক অনেক আগ্রহ সহকারে পড়েছি। মুক্তি যুদ্ধকালে ডাঃ চৌধুরীর সাথে তার মায়ের যোগাযোগ এবং তাদর মধ্যেকার কথোপকথন পড়ে তা স্মৃতিতে পরম শ্রদ্ধাভরে নিজের মনে ধারন করে রেখেছি। বন্ধু মহলে আলোচনা করেছি। এই পত্রিকার বিষয়বস্তু আমার বন্ধু মহলে এবং পারিবারিক পরিমন্ডলে আলাপ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।
আমি রসায়নের ছাত্র। এই পত্রিকায় ঔষধের জেনেরিক নাম ও ব্যবসায়িক নাম সম্পর্কে প্রবন্ধ সমূহ পড়ে এ বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য জেনেছি । আমার আরেক মহান শিক্ষক অধ্যাপক মুজবর রহমানের ক্লাসের পড়ার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পেয়েছি। ক্লাসে এই পত্রিকার উদাহরণও দিয়েছি। এই বিষয়টি আমার জানা মতে জনগণের মনে প্রবল প্রভাব পড়ে।
তার ফলশ্রুতিতেই এখন ঔষধের বোতল বা মোড়কের গায়ে জেনেরিক নামটা বাধ্যতামূলকভাবে লেখা থাকতে দেখা যায়। এতে করে ঔষধ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে। ডাক্তার না থাকলে কি ভাবে চিকিৎসা নিতে হবে বা কিভাবে অসুস্থ রোগীকে সেবা দিতে হবে সেটাও এই পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি।
কর্ম জীবনে প্রবেশ করলেও ‘গণস্বাস্থ্য’ পত্রিকা নিয়মিত পাঠ করা থেকে বিরত হই নাই। জেলা ও দায়রা জজ ও সম পদ মিলিয়ে এগার বৎসরেরও অধিককাল দায়িত্ব পালন করেছি।
এই সময়ে অনেক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ , মুখ্য বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেট ( Chief Judicial Magistrate ) , যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ , অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেট , জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ , জ্যেষ্ঠ বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেট সহ সহকারী জজ ও বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেটগণ আমার অধীনে চাকুরী করেছেন । তাদের সাথে আমি সপ্তাহে দুদিন সাধারণতঃ মিলিত হতাম এবং বিচারিক বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষা ও নির্দেশনামূলক আলাপ আলোচনা করতাম। এই আলোচনার মধ্যে ‘গণস্বাস্থ্য’ পত্রিকার উল্লেখযোগ্য নিবন্ধগুলোও আমাদের আলোচনার বিবিধ পর্যায়ে স্থান পেয়েছে। সুন্দর ও সুস্থ্যভাবে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এই পত্রিকায় অবদান রেখে চলেছে তা সকলেই অকুন্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছে। পত্রিকায় নতুন কোন গুরুত্বপূর্ণ , শিক্ষনীয় ও অনুসরনীয় প্রবন্ধ বা তথ্য থাকলে দেরী না করে টেলিফোনে তা একে অন্যকে জানিয়েছে।
আমাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই পত্রিকার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা সেবার নামে অপ-চিকিৎসা ও অপ্রয়োজনীয় ঔষধ ‘প্রেসক্রাইব’ করে জনগণকে সর্বশান্ত করার বহুদিনের ব্যবসা সম্পর্কে জনগণের চোখ খুলে দিয়েছে এই পত্রিকা। সে কারণেই এই এতো জনপ্রিয় , তবে স্বাস্ব্য সেবার নামে অসৎ ও কপট ব্যবসায়ীদের কাছে এই পত্রিকা যে মূর্তিমান আতংক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।