বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া হোস্টেলের খোলা জানালা দিয়ে, বৃষ্টির পানি রুমের ভেতর এনে ছিটকে ফেলছে। ওপরে ফুটোয় ভর্তি টিনের চালের পানিও শিলিংয়ের ছিদ্র দিয়ে ইচ্ছে মতো ভেতরে ঢুকছে।
এ অবস্থায় আমার বন্ধুরা বিছানা উল্টায়, এদিকের চেয়ার ওদিকে সরায়, বইগুলো গামছা দিয়ে ঢেকে রাখে। পানি থেকে রক্ষা করার যত উপায় আছে, তার সবগুলোই করে দিচ্ছে।
আর আমি ভাবছি, এই ভাঙাচোরা হোস্টেলের মধ্যে স্যারের কি করুণ জীবন-যাপন। দেখে মায়া না হয়ে পারেই না। আমি আর রিজোয়ান মিলে, এদিকে স্যারের শিলিং ফ্যানটা ফিটিং করে দিচ্ছি। মাঝে মাঝেই আড় চোখে দেখি- দূরে মসজিদের বারান্দায় অন্তু একা দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত সে আমাদের সাথেই ছিল।
কিন্তু আমরা স্যারের রুমে ঢুকতেই বাঁধে বিপত্তি। সে বাধ্য হয়ে চলে যায় মসজিদের বারান্দায়। কারণ সে স্যারের তিন মাসের বেতন মেরে খেয়ে ফেলেছে। আমরা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছি দেখে- সে সুযোগ বুঝে মসজিদের বারান্দার পাথর তুলে চালের ওপর ঢিল মারছে।
মনে মনে ভাবছে হয়তো, আমাদের ওপর ইচ্ছে মতো শোধ তুলছে।
আমরা বরং ভাবছি অন্য কথা। এখন ওকে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলি দেই, কেমন।
কাজের ফাঁকে স্যারের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলি- স্যার, অন্তু যে আপনার পেছনে লেগেছে, তা কী জানেন?
স্যার বই থেকে মাথা তুলে কিছুক্ষণ ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বলেন-
বল কী মিয়া? অন্তু আমার পেছনে লাগতে যাবে কেন?
সে তো এতক্ষণ ধরে আপনার চালে ঢিল মারছে। ফঁন্ধি করেছে, বৃষ্টির শব্দে যেন আপনি ব্যাপারটা টের না পান। আর সেই সুযোগে আপনার চাল ফুটো।
তাই তো মিয়া। এতক্ষণ ধরে ঢিলের আওয়াজই তো শুনতে পাচ্ছি। আমি আরো ভাবছি কোত্থেকে আসছে সেসব। অন্তু মিয়া কোথায়?
ওই যে স্যার, মসজিদের বারান্দায়। এদিকে আমার কাছে আসুন।
এখান থেকে দেখা যায়।
তারপর স্যার কাছে আসতেই আমি আঙুল দিয়ে অন্তুকে দেখিয়ে দেই। অন্তু সেই মুহুর্তে আর একটা ঢিল মারতে যাচ্ছে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে স্যারকে দেখেই, সে চুপসে যায়। এখন ঘাড় ঘুরিয়ে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
স্যার তখন ভারি চিন্তিত হয়ে জানতে চান-
আচ্ছা বলতে পার, অন্তু মিয়া কেন এমন করছে?
আমি বলি-
স্যার, আপনি যে তাঁকে অন্তু মিয়া বলে ডাকেন- সেজন্য। নামের সাথে মিয়া উচ্চারণ করলেই ওর মাথা ঠিক থাকে না।
তাই নাকি? আমি তো তাঁকে আদর করে মিয়া বলে ডাকি মিয়ারা। কী বল- স্যার সবার দিকে মিটি মিটি হেসে তাকান। মূখে সমর্থন আদায়ের আকাক্সক্ষা।
তারপর বলেন-
তোমাদেরও তো মিয়া বলেই ডাকি।
কী আর বলব স্যার। কিছু কছিু ছেলেদের স্বভাবই ভাল না। সে তো রাতেও আপনার চালে ঢিল মারে। একা ঘরে আপনি গান ধরলেই ওর মেজাজ চড়ে যায়।
বলে বেসুরোকে এটাই ঢিল মারার সঠিক সময়। সরি স্যার, ক্ষমা করবেন।
কেন?
ওই যে বেসুরো বললাম। আসলে ও বলে তো। তাই আপনাকে জানালাম।
ক্ষমা করবেন।
স্যার ক্ষমা করেছেন কিনা জানি না। তবে, কথা শুনে তিনি যথেষ্ট বিব্রত হয়েছেন, বুঝতে পারছি। সাথে সাথে গলা খাকারি দিলেন।
হয়তো আমাদের উপস্থিতি টের পেলে এ জনমে আর গান ধরবেন না।
যদি তিনি নিজের গানের গলা সুন্দর বলে নিশ্চিত থাকেন- তবুও না।
একটু পরই রিয়োজন বলে-
স্যার, অন্তু এখানে কেন আসেনি বলতে পারেন?
কেন?
ওর কাছে যে আপনি টাকা পান।
কথা শুনে স্যার লজ্জিত হয়ে হাসেন। বলেন-
আরে বোকা তাতে কী? ওকে এসব মাথায় রাখতে কে বলেছে? মানুষের সমস্যা তো থাকতেই পারে। বলে দিয়ো, ওসব কিছু না।
যেকোনো সময় আমার কাছে আসবে। সংকোচের কী আছে?
আমি চোখ বড় বড় করে বলি-
সে কী স্যার? ও তো এখন ব্যাচ ধরে ধরে ছেলে পড়াচ্ছে। সব সাবজেক্ট পড়ায়। আর একটা পড়লে সাথে আর একটা সাবজেক্ট ফ্রি পর্যন্ত পড়াচ্ছে। তা ছাড়া লোকের কাছে অহরহ বলে বেড়াচ্ছে, যে আপনি একটা ধান্ধাবাজ শয়তান।
কথা শুনে স্যার আবার বিব্রতবোধ করে গলা খাকারি দিলেন। তবে, আমার আর থামার নাম নাই। বলেই চলছি-
ঠকবাজ। মানুষকে ঠকানোই কাজ। এক ঘন্টার বদলে কোনোমতে হাসি-ঠাট্টা করে ৪৫ মিনিট কাটিয়ে দিলেই বার দিন পর টাকা।
কী জঘন্য! ছিঃ ছিঃ ছিঃ যদি শুনতেন স্যার।
আরো বলে আপনি নাকি ইংরেজী গ্রামার ভাল করে বুঝেনই না। বই দেখে দেখে পড়ান।
নির্ঝর এই শেষটুকু যোগ করে।
স্যার প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চান-
বলো কী? তাই নাকি ব্যাপার? সত্যি বলে তো?
রিজোয়ান হেসে বলে-
আপনার বিশ্বাস হয় না? রাস্তায় এক-দুজনকে জিগ্যেস করে দেখবেন।
ঘটনা কতদূর গড়িয়েছে।
না না, আমি কাউকে জিগ্যেস করব না। অন্তু মিয়া আমার ছাত্র হয়ে এমন একটা কাজ করতে পারল? কাজটা আজব না মিয়া’রা?
আজব না মানে?
নির্ঝরের কন্ঠে তীব্র জোর। সে আরো যোগ করে-
স্যার, আপনি চাইলে এখন একটা প্রতিশোধ নিতে পারেন। কাজটা আপনি করলে- আমরা প্রচারের কাজটা সেরে দেব।
ক্লাসে ওকে একটু ইংরেজির টেষ্টটা নিয়ে নেবেন। জানি সে পারবে না। তখন আমরা একেবারে লিফলেট ছাপিয়ে দেব।
স্যার কথা শুনে মিষ্টি হাসেন।
কী যে বল, মিয়ারা।
অন্তু কী আমার প্রতিপক্ষ নাকি। ছাত্রের সাথে এমন করতে পারি না।
মুনির বলে-
না স্যার, আপনি এমন কথা বলবেন না।
স্যার আবারো হাসেন-
আচ্ছা দেখব নে।
এবার মনে হয়, আইডিয়াটা তিনি গ্রহণ করেছেন।
এই সব কথা বলতে বলতে আমরা ফ্যানটা ফিটিং করে ফেলেছি। তখন নিচে নেমে এসেই রিজোয়ান বলে-
স্যার একটা কথা বলার ছিল।
স্যার গম্ভীর গলায় জানতে চান-
কী?
আপনার খাটের নিচে বোয়ামে গুঁড় দেখেছিলাম। কিছু গুঁড় খেতে ইচ্ছে করছে।
স্যার অপ্রস্তুত হেসে বলেন-
আচ্ছা খাও, কোনো কিছু ছাড়াই কী খাবে?
সমস্যা নেই স্যার।
অভ্যাস আছে।
তারপর রিজোয়ান খাওয়া শুরু করে। ওদিকে দ্বাদশ শ্রেণীর খাতা দেখতে দেখতে আদিত্য খাতার ভেতর বিশটা টাকা পেয়ে, লুকিয়ে ফেলতে যেয়ে ধরা পড়ে গেছে। কী বিশ্রী কান্ড। কোন কৃপণ যে রেখেছিল এই বিশটা মাত্র টাকা।
তবে, আদিত্য তাতেই খুশী হয়ে খাতার মালিককে বেশি বেশি মার্ক দিতে শুরু করেছে। আর বদিউল ঠিক বদের মতোই ৩১ পাওয়া একটা পরীক্ষার্থীকে চূড়ান্ত মার্ক ৩১ই দিয়ে, ফেল করিয়ে দিয়েছে। পাশের অন্যরা তখন ওকে সে কি তিরষ্কার। আর এখানেই ওর খাতা দেখায় ইস্তফা। তবে, দেখে মনে হয় সে তাতে খুশীই হয়েছে।
ফ্যান ফিটিং করতে করতে আমার আর রিজোয়ানের হাতে কালি লেগেছে। তাই আমরা খাতা দেখছি না। তাও শান্তি নেই। স্যার এখন আমাদের লাগিয়ে দিয়েছেন অন্য কাজে। ঠিক লাগিয়ে দিয়েছেন নয়; আমরাই স্যারের দুঃখ বুঝে, স্যারের অভিপ্রায় শুনেই রুমের ভেতরের সামান্য আসবাবগুলো পরিষ্কার করে জায়গামতো সেট করে দিচ্ছি।
বদিউলকেও শান্তি না দিয়ে সাথে নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আর ফাঁকে ফাঁকে স্যারের সাথে জমিয়ে আলাপ করছি।
টিনের চালে ছন্দময় বৃষ্টির শব্দে এসব ভালই লাগছে। তবে, স্যারের রুমের দুরবস্থার জন্য সত্যিই মাঝে মাঝে খারাপ লাগছে। এক সময় বলেই ফেলি-
স্যার আপনি এই ভেজা নরকে আছে কী করে?
স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন-
কী আর করা? কোনো এক রকমে মানিয়ে নিয়ে চলছি।
কিন্তু এটাতো অমানবিক। কর্তৃপক্ষ আপনাদের টিনগুলো পাল্টে দেয় না কেন? ঠিকই তো তাঁরা অনুদানগুলো থেকে মেরে মেরে খায়। অন্তত পুরোনো শিলিংটা তো পাল্টে দিতে পারে। জানালাটাও যে ঠিক নেই। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
না এখন জানালা একটা সামান্য ভাল হয়েছে। কয়েকদিন আগে মেরামত করিয়েছি। ছিঁচকে চোরদের উৎপাত। কখন কি নিয়ে যায়।
রিজোয়ান চোখ লাল করে জিগ্যেস করে-
নিরুপায় হয়ে মেরামতটা নিশ্চয়ই নিজের টাকায় করিয়েছেন?
তা ছাড়া তো উপায় নেই।
কে শুনে কার কথা। আর আমি বলিও না।
বদিউল বলে-
সেটা জানি স্যার। আপনি তো এই কলেজের সবচেয়ে ভদ্রলোক বলে পরিচিত। আপনি অভিযোগ দিতে জানেন না।
আমরাই কাল প্রিন্সিপালকে গিয়ে ধরব।
স্যার উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন-
আরে না না, এমন কাজটি করো না। তিনি আবার কী ভাববেন।
আমি বলি-
কেন নয়?
অযথা এসবের কী দরকার? এমনিতেই তো বেশ আছি। তা ছাড়া হলে তো আগেই হতো।
দেখো না চারদিকে পানি পড়ে। বই ভিজে একেবারে শেষ। আমি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বৃষ্টির সময় চেয়ার-টেবিলগুলো টেনে সরিয়ে দিলেই কোনোমতে হয়ে যায়। এসব বলে লাভ নেই।
আমি মুচকি হাসি। বলি-
না না স্যার, কালকে এসেই দেখবেন প্রিন্সিপালকে কেমন কাঁপিয়ে দেই। আপনার দুরবস্থা সহ্য করার মতো নয়। বাইরে একটা বাসা ভাড়া নিলে নিশ্চয়ই মালিক আপনাকে এমন অবস্থায় রাখত না। আপনি এখানে মাসে মাসে ভাড়া দেবেন, আর এই করুণ অবস্থা।
কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
বদিউল স্বভাব সূলভ জানতে চায়-
স্যার, আপনি এই রুমটার জন্য মাসে কত ভাড়া দেন?
এবার স্যার তাঁর বেসুরো কন্ঠের মতোই বিশ্রী হাসি হাসেন। নাকে-মূখে শব্দ তুলে জানান-
সে শুনে লাভ নেই।
বদিউল নাছোড় বান্দার মতো মূখের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে-
বলেন না স্যার। শুনি, প্রিন্সিপালের একটা বিহিত করতেই হবে।
স্যার বলেন-
ইয়ে মানে, ৫২।
৫২ শ?
না।
তাহলে ৫২ হাজার?
রিজোয়ান বদিউলের বোকামী দেখে ধমকে বলে-
মূখ বন্ধ কর বেকুব। এক রুমের ভাড়া ৫২ হাজার হয়? প্রতিদিন ৫২ টাকা করে মনে হয়।
তারপর ও ঠোট উল্টে হিসেব করে বলে-
বাইরের হিসেবে এক রুমে মোটামুটি ঠিকই আছে।
প্রতিদিন ৫২ টাকা হলে মাসে ১৫৬০ টাকা।
কী ঠিক আছে?
বদিউল গর্জে উঠে। সবক্ষেত্রেই সে একটু অতি উৎসাহী। বলে-
এই ভাঙা রুমের হিসেবে ভাড়া অনেক বেশি। কাল প্রিন্সিপালের নিস্তার নেই।
হিসাব দিতে হবে, এই টাকা কোথায় যায়? কেন এই রুমের চালে নতুন টিন লাগে না। আরে, পাঁচটা মাসের ভাড়া এক করলেও তো পুরো চাল পাল্টে ফেলা যায়।
বদিউলের হম্বিতম্বি দেখে স্যার একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেন-
মিয়া তোমরা উত্তেজিত হয়ো না। ভাড়া মাসে ১৫৬০ টাকা নয়। প্রতিদিনে ৫২ টাক করেও নয়।
মাসেই ৫২ টাকা।
কথা শুনে কেন জানি আমার খুব ঢেঁকুর চলে আসে। তবে, এমনিতে এই জিনিসের ব্যবহার আমার ক্ষেত্রে সচরাচর প্রত্যাশিত নয়।
বৃষ্টি শেষে বাইরে এসে, আমি বন্ধুদের জানাই-
কাল কলেজে এসেই হোস্টেলের রুমগুলো থেকে স্যারদের বের করার আন্দোলন শুরু করতে হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।