প্রারম্ভিকা
১৯৭১/৭২ থেকে ২০০৭/০৮ অর্থ বছর পর্যন্ত আমরা বিদেশী সাহায্য (ঋণ, অনুদান সবকিছু সহ) বাবদ প্রায় ৩,৮৪,০০০* হাজার কোটি টাকা পেয়েছি, তার উপর দেশ থেকে কর বাবদ সংগ্রহ করা হয়েছে আরও লক্ষ কোটি টাকা অথচ সড়ক ব্যাবস্থার বেহাল দশা, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা, বেকারত্ব আর গরিবি এইসব দশক পুরনো সমস্যাগুলির কোনও সুরাহাই হলনা তাই মনে প্রশ্ন জাগে এত টাকার উন্নয়নটা কোথায় হল? দুই পর্বের এই লেখায় আপনাদেরকে নিয়ে আমি বৈদেশিক ঋন, আনুদানের রাজনীতি আর আমাদের অবস্থানটা খুঁজার চেষ্টা করব।
বিদেশি বা বৈদেশিক সাহায্য, অথবা আন্তর্জাতিক সাহায্য যে নামেই একে অবিহিত করা হোক না কেন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা এই অনুষঙ্গের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এবং ভবিষ্যতেও এর থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ৭১’র পর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশি, বিদেশি নিন্দুকেরা অনেক কথাই বলেছেন, কাড়ি কাড়ি বিদেশী সাহায্য আর অনুদানের টাকা আজ স্বাধীনতার ৪১ বছরে আমাদের প্রানপ্রিয় দেশকে কতখানি বদলাতে পেরেছে তা কিন্তু আলোচনার দাবি রাখে? বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রথম ধাপে পা রেখেছে মাত্র, ২০১১ সালের জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে আমাদের অবস্থান এর সত্যতা নিশ্ছিত করে (১৮৭টি দেশের মাঝে ১৪৬ তম)। চার দশকের বিভিন্ন অর্থনৈতিক পদক্ষেপের পর এহেন অবস্থান নাগরিক হিসেবে আমাদের হতাশ করে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলি আমাদেরকে প্রায় $৫৯ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু তাদের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল প্রায় $৪৮.৫২** বিলিয়ন ডলারের মত।
এইড বা সাহায্য কি এবং কেন?
অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD) এর ডেভলাপমেন্ট আসিসটেন্স কমিটি (DAC) এর মতে বৈদেশিক সাহায্য হচ্ছে “অর্থ ও সহায়তার একটি প্রবাহ যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন’’** অর্থের যে প্রবাহের কথা এখানে বলা হচ্ছে তার আকারগত রূপ হচ্ছে অনুদান (এই ধরনের সাহায্যের টাকা ফেরত দিতে হয় না!) আর স্বল্প সুদের ঋণ (চুক্তি অনুযায়ী সুদ+আসল কিস্তির মাধ্যমে দাতার কাছে ফেরত দিতে হয়)।
আমরা এখানে অনুদান বা সুদ ভিত্তিক ঋণের কথা বলছি তার কিন্তু কেতাবি নাম আছে, অনুদান বা স্বল্প সুদের ঋণকে বিশেষ সুবিধা যুক্ত অর্থায়ন (Concessional Finance) বলা হয়ে থাকে, অপরদিকে, যে ঋণের সুদের হার বাজারের প্রচলিত সুদের সমান তাকে বিশেষ সুবিধাবিহীন অর্থায়ন (Non Concessional Finance) বলে। আবার লক্ষ্য করুন, যে সমস্ত ঋণে শতকরা ২৫ ভাগ পর্যন্ত অনুদানের পরিমান থাকে তাকে আর ঋণ বলে না সেটাকে এইড বা সাহায্য রূপেই চিহ্নিত করা হয়। Non Concessional Finance আবার অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড(ODF) নামেও পরিচিত, আপনারা আবার Non Concessional Finance আর ODA’কে একসাথে গুলিয়ে ফেলবেন না এই দুইটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস।
আমদের মত গরিব দেশে (স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশ) আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য যে সাহায্য আসে তাকে অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট এসিস্টেন্স (ODA) নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সাহায্যের টাকা যে শুধু গরিব দেশই গ্রহন করে তা নয়, অনেক ধনী দেশ (World Bank’র হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু আয় $৯,০০০ বা তারও বেশি), যেমন, বাহামাস, ইসরাইল, সিঙ্গাপুর সহ অনেক দেশও সাহায্য নিয়ে থাকে যাকে অফিসিয়াল এসিস্টেন্স (OA) বলে। অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট এসিস্টেন্স ও অফিসিয়াল এসিস্টেন্সের পাশাপাশি অনেক স্বতন্ত্র স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও গরিব, ধনী উভয় ধরনের দেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করে থাকে, আর তাদের মাধ্যমে আসা সাহায্যকে প্রাইভেট ভলান্টারী এসিস্টেন্স (PVA) বলা হয়।
আমরা যদি আমেরিকা, জাপান ও ফ্রান্স এই বড় তিন দেশ ও তাদের ছাড়কৃত সাহায্যের দিকে তাকাই তাইলে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য দেখতে পাব, আমেরিকান সাহায্যের বড় একটি অংশ চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, উদ্দেশ্যটা আপনারা বুঝতেই পারছেন, ফ্রান্স তার সাহায্যের অধিকাংশই প্রেরন করে তাদের পুরানো কলোনিতে, আর জাপানের সাহায্য প্রদানের উদ্দেশ্য আরও চমকপ্রদ তারা তাদেরকেই সাহায্য করে যারা তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বহাল রাখে। তাদের এই ধরনের আচরণ হয়ত কৌশলগত দিক থেকে তাদের উপকৃত করছে কিন্তু যেইসব দেশ এই ধরনের সাহায্য নিচ্ছে তাদের কতটুকু উপকার হচ্ছে? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক সাহায্যের সাথে ক্ষুধা, দারিদ্র, অনিয়ম আর দুর্নীতির ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
যেখানে আমেরিকান সাহায্যের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে গনতন্ত্র, দারিদ্র বিমোচন আর জবাবদিহিতার উপর সেখানে ফ্রন্সে আর জাপানের উদ্দেশ্য ভিন্ন (উপরে দেখুন)। আর নরডিক দেশসমূহ গনতন্ত্র, দারিদ্র বিমোচন আর জবাবদিহিতার উপর গুরুত্ব দিলেও তা আমেরিকার মত মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক না। আলোচনার সুবিধার্তে আমরা মাত্রও তিনটি দেশের বৈদেশিক সাহায্যের নীতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করলাম আর তাতেই তিন রকমের স্বাদ পাওয়া গেল। অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করাই যদি বৈদেশিক সাহায্যের মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাইলে এই ধরনের নীতি ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা বাংলাদেশ সহ অন্যান্য গরিব দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সহায়ক নয় বলে আমি মনে করি।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের আগে ও পরে বৈদেশিক সাহায্যের গতি প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।
১৯৯০ সালের আগে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল একদিকে ছিল উদারতান্ত্রিক আমেরিকা ও তার অনুচরেরা আর অন্যদিকে ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া ও তার অনুসারীরা। তখনকার দিনে সাহায্যের গতি প্রকৃতি ছিল বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতকে ঘিরে। সোভিয়েত রাশিয়া আর আমেরিকার পাল্টাপাল্টি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ বিশ্বের সবকটি দেশকে তটস্ত রেখেছিল, আর এই পরিবেশকে পুঁজি করে যার যার পক্ষের দেশগুলিকে সাহায্যের টাকা দিয়ে সামরিক সাজে সজ্জিত করেছে। ১৯৬০ সালের পর থেকে ১৯৯২ অব্দি মোট $৬৮ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য ছাড় হয়েছে আর তার অধিকাংশ ব্যায় হয়েছে সামরিক খাতে, সেখানে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার সাধারণ গরিব মানুষের চাহিদা উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছিল, মোটা দাগে ৯০‘র আগে এই ছিল বিদেশী সাহায্যের নমুনা। ঠাণ্ডা যুদ্ধ অবসানের পরও সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলিকে কাছে টানতে আমেরিকাকে বিপুল পরিমান অর্থের (সাহায্য) যোগান দিতে হয়েছে যার অধিকাংশই হিসাবের বাইরে ছিল, উর্দি ওয়ালাদের ওজন আর ব্যাংক ব্যালেন্স স্ফিত হওয়া বুঝি এ করনেই।
৯০ দশকের শেষ দিকে এসে সাহায্যের প্রবাহ একটু বাড়তে থাকে আর ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকার ঘাড়ে ভুত চাপার পর সাহায্যের পরিমান আরও একটু বেড়ে যায়। যদি আমরা ডলারের দাম পড়ার ব্যাপারটি খেয়াল করি তাইলে দেখব যে, বছরের পর বছর সাহায্যের পরিমান বাড়লেও তা নীট হিসাবে বাড়েনি।
১৯৭০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ধনী দেশগুলি তাদের মোট জাতীয় আয়ের (GNP) ০.৭ শতাংশ গরিব দেশগুলির উন্নয়নের কাজে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল কিন্তু নরডিক দেশগুলি ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউই কথা রাখতে পারে নাই।
(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)
*১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার = বাংলাদেশি ৮,০০০ কোটি টাকা।
** প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ৮০ টাকা।
***সামরিক উৎকর্ষতা অর্জন সাহায্যের উদ্দেশ্য না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।