চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি সাংহাই চলচ্চিত্রটি নানা অর্থেই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ছবি। এর শক্তি যেমন সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটিকে তুলে আনার মধ্যে রয়েছে, তেমনি চলচ্চিত্র শিল্পকলার নিরিখেও এর নান্দনিক আবেদন উল্লেখযোগ্য। গোটা ছবি জুড়ে একটা ঠাস বুনোট ও দ্রুত লয় বজায় রাখতে পেরেছেন পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়, আবার এরই মাঝে রয়েছে ব্যঙ্গের কষাঘাতের টুকরো টুকরো কিছু উজ্জ্বল মুহূর্ত। যেমন শাসক নেতাদের ফোন তুলেই বা পরস্পরকে সম্বোধনের সূত্রে ক্রমাগত ‘জয় প্রগতি’ আওড়ানো।
প্রথমে ছবির কাহিনীটি একবার দেখে নেওয়া যাক।
ভারতনগর একটা ছোট গ্রাম, কিন্তু রাজ্যের শাসক দল চান এই ভারতনগরকে ইন্টারন্যাশানাল বিজনেস পার্ক করে তুলতে। সেখানে একটি এস ই জেড বানাতে। এর বিরোধিতা করেন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আহমেদী। এস ই জেড বিরোধী একটি বিক্ষোভ সভা চলাকালীন সভার বাইরে শাসক পার্টির সমর্থক ও গুণ্ডারা সমাবেশিত হয়, তারা আহমেদী ও তার সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ যথারীতি নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ধস্তাধস্তির মাঝে হঠাৎই ছুটে আসে একটি গাড়ি, মরণ ধাক্কা দেয় অধ্যাপক আহমেদীকে। রক্তাত্ত আহমেদী যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন তখনই চলচ্চিত্র এক নাটকীয় বাঁক নেয়। চাপে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী গঠন করেন একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন, দায়িত্বে থাকেন পদস্থ আমলা কৃষ্ণান। কৃষ্ণানের তদন্তর পরতে পরতে চলচ্চিত্রকার আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন সরকার, শাসক দল, শাসকের ভাড়াটে খুনি সহ পেশাদার বশংবদ গুণ্ডাবাহিনী, পুলিশকর্তা – এই বিচিত্র গোষ্ঠী এবং তাদের যৌথতায় গড়ে ওঠা এক শক্তি, রাষ্ট্র-শক্তির সঙ্গে। এরা সহজেই অল্প স্বল্প অনুগ্রহ বিতরণ, চটুল জলসার আয়োজন, ভয় ভীতি প্রদর্শন – ইত্যাদির মিশেলে সাধারণ আম আদমির মধ্যে থেকে তৈরি করে নেয় বিশাল এক স্তাবক বাহিনী, তাদের প্রয়োজনীয় ‘ভোটব্যাঙ্ক’।
তারা কখনো শাসকের হাতিয়ার; শত্রুকে বলি দেবার যন্ত্র, আবার কখনো কাজ ফুরোলে সেই যূপকাষ্ঠেই বলি। এদের বিপরীতে প্রতিবাদী একটি অংশও আছে অবশ্য, সংখ্যায় অল্প, কিন্তু আদর্শবান, সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মার খেয়ে, ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়েও তারা কৃষক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে প্রতিবাদ করার পথ থেকে পিছ পা হয় না।
এই আন্দোলনের বড় প্রাপ্তি কিন্তু যোগিন্দর। তরুণী ছাত্রী শালিনি তার মাস্টারমশাই এবং ভালোবাসার মানুষ অধ্যাপক আহমেদীর হত্যা প্রচেষ্টার রহস্য উন্মোচনের জন্য জান লড়িয়ে দেবে, এটা ততটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।
কিন্তু বেশি গুরূত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিমণ্ডলের এক মানুষ, পর্ণোগ্রাফিক ছবির ভিডিওগ্রাফার যোগিন্দারের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়াটা। পর্ণো ফ্লিম এর ছবি তোলার পাশাপাশি কিছু ‘খেপ’ ছবি তোলার কাজও সে করে থাকে। এই সূত্রেই স্থানীয় নেতার ছবি তোলার বরাত এসেছিল তার কাছে। সেই কাজ চলাকালীনই এক কথোপকথনে রেকর্ড হয়ে থাকে অধ্যাপককে হত্যার ছক। পরে এটাই হয়ে ওঠে আহমেদী হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল স্বাক্ষ্য।
যেভাবে প্রাণের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে, নিজের শাকরেদকে খুন হয়ে যেতে দেখার পরও আহমেদী হত্যার সবুদ বের করতে সে সচেষ্ট হয় – তা নিশ্চিতভাবেই আহমেদী ও তার অনুগামীদের ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে যুক্ত। শাসক শক্তির অঙ্গুলি হেলনে নাচন কোদন রত নির্বোধ জনতার সারি যদি আমাদের হতশ্বাসের কারণ হয়, তবে পর্ণোগ্রাফিক ছবির ভিডিওগ্রাফারের এস ই জেড বিরোধী আন্দোলনের দূরগত কিন্তু সাহসী ও সৎ শরিক হয়ে ওঠা নিশ্চিতভাবেই আশাব্যঞ্জক দিক।
পুলিশ মহলের ওপর তলা বা উচ্চ পদস্থ আমলাকুল আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ীই এখানে চিত্রিত –দুর্নীতি পরায়ণ, শাসকের অঙ্গুলি হেলনে নাচন উন্মুখ এবং কৃষ্ণানের মত উচ্চপদস্থ আমলার তদন্তকে স্বার্থসীমার মধ্যে রাখার মত যথেষ্ট শক্তিধর। এরা গণ আন্দোলনের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণকারী। তবু এসবের মধ্যেই কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে কখনো সখনো একাংশ সত্য, ন্যায় গলে আসতে পারে, যেমন এক্ষেত্রে এসেছে।
তবে তা বড় অনিশ্চিৎ, দৈবাৎ।
পুনশ্চ –কেউ প্রশ্ন করতে পারেন ছবির নাম সাংহাই কেন হঠাৎ ? ভারত নগরকে আই বি পি বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিজনেস পার্ক করা তো আসলে ‘ইন্ডিয়াকো বানাও পরদেশ’ নামক প্রগতি/উন্নয়নস্বপ্ন ফেরিওয়ালাদেরই প্রজেক্ট। ঝাঁ চকচকে সাংহাই বানানোর প্রজেক্ট। কোলকাতাকে লন্ডন বা দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড বানানোর গল্প যারা নিয়মিত শোনেন, তাদের কাছে অবশ্যই এর বেশি ব্যাখ্যা লাগবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।