এতকিছু ... ওই সিনেমার জন্যই...
পৃথিবীর সবচাইতে ভালো গল্পকার সম্ভবত নাপিতরা। এই পারদর্শীতা খুব আস্তে আস্তে সহজভাবে তৈরী হয়। তাদেরকে একইসাথে কয়েকটি কাজ করতে হয়। যার চুল কাটা বা দাড়ি শেভ করা হচ্ছে তার যাতে কোনভাবেই বিরক্তি উৎপাদন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। আর যারা পাইপলাইনে আছেন, একটু পরেই যাদের চুল কাটা হবে তাদেরকে খুব সুক্ষভাবে ধরে রাখা এবং প্রতিমুহূর্তে যারা আসছে তাদেরকেও পাইপলাইনে ঢুকিয়ে দেবার কাজটিও সুন্দরমতো করতে হয়।
এর জন্য তাকে যেটা করতে হয়- সেটা হলো চমৎকার সব বিষয়তুলে এদেরকে গল্পের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া। অনেক ক্ষেত্রেই গল্প বলার কাজটি এই জনগনেরই কেউ করে থাকেন আর নাপিত ভদ্রলোক বিষয়টি পরিচালনা করেন। তথাপি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গল্প বলার কাজটি তিনি নিজেই করেন। তাদের স্টকও যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে থাকে।
রবি নাপিত আমার শৈশবের এক অলীক গল্পকারের নাম।
উনার গল্পের চাইতে উনার নাপিতশালা অতিমাত্রায় সমৃদ্ধ ছিলো। উনি কোন দোকান দিয়ে এই ব্যবসা পরিচালনা করতেন না। এটা ব্যবসা ছিলো কী না এটা এখনো ভাবায় আমাকে। রবি নাপিতের নাপিতশালা ছিলো একটা বিশাল বড় ছায়াঘেরা বাগানের ভেতর। সেখানে অসংখ্য জাতের গাছ।
সেই বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট্ট বেড়াবিহীন ঘর। সেখানেই তার কর্মক্ষেত্র। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এই রবি নাপিতকে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতাম। এর আগে রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছি ছবি দেখেছি এবং জেনেছি তিনি আমাদেরই এলাকার লোক। এদিকে রবি বাবুর কাছে চুল কাটতে যাওয়া হবে শুনতে শুনতে গড়িয়ে যাচ্ছিল দিন।
একদিন বাবার সাথে উনার নাপিতশালায় গিয়ে আস্তে আস্তে ভেঙ্গে গেল ভুল। উনাকে নতুন করে আবিস্কার করলাম বেশ কয়েকবার চুল কাটাবার পর। উনি আমাদের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টারের ছোটভাই ছিলেন। এবং উনার মেয়ে (সাধনা আপা) একই স্কুলে আমাদের শিক্ষিকা ছিলেন।
এই নাপিতশালাটি ছিলো পদ্মানদীর তীরঘেঁষা।
রাজবাড়ী আর কুষ্টিয়ার প্রায় সংযোগস্থলে; ওপারে পাবনা। পশে একটি কুয়া ছিলো, সেও এক রহস্যের আধার। জীবনে প্রথম পদ্মা নদী দর্শন, এই চুল কাটা সুত্রেই।
তার গল্পগুলি হতো একটু আধিভৌতিক। জোছনার রাতের দুরন্ত ষাড়।
মাথাবিহীন এক পালোয়ান। জিতেনের পোষা ভুত। মওলানা জ্বীন। মাছপ্রিয় নাকি সুরের নৈশপ্রহরী। সেইসব ছায়া ছায়া রোদের ভেতর গল্পগুলি অদ্ভুতভাবে মানিয়ে যেত।
বুকের গভীরে কোন অযান্ত্রিক ঘুমের ভেতর এখনো তাকে সাজিয়ে রেখেছি। রবি নাপিত নেই অনেককাল হলো। সেই ছায়াময় গাছগুলির একটিও নেই। নদী আরও কাছে চলে এসেছে। কুয়োটি একদম নদীর পাশ ঘেষে দাঁড়ানো- শেষবার যখন দেখেছি।
এর পরের বার কুয়োটিকে দেখা যাবে কী না কে জানে। এইসব অজানার ভেতরও কোথাও একটি স্নিগ্ধতা ঠিকই থেকে যায়। আমাকে চুপচাপ নিয়ে যায় একটা ছায়াগন্ধী জানালার কাছে।
ছবি: Gene & Frances In Old Barber Barn, 2002
ও Barber Boys on Cattle Roundup, 1999
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।