সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি দিনাজপুর: শেকড়ের সন্ধান
ইতিহাসের কোন বিষয় আকস্মিক নয়। পূর্ববর্তী এমন কি সূদূর অতীতের অনেক ঘটনা যুগ যুগান্তরের শেষে প্রেরণা হয়ে নতুন করে হাজির হয়। যাকে কার বলেন “--- dialogue between the past and the present”.৩ এদিক থেকে কান্তজিউ মন্দির প্রসঙ্গে আলোচনায় আমাদেরকে দিনাজপুরের সভ্যতা সংস্কৃতির শেকড়ের একটু সন্ধান করা বাঞ্চনীয়। আগের কথা সঠিকভাবে বলা না গেলেও অন্তত আড়াই হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক যে দিনাজপুর জেলা তথা বাঙলার অধিবাসীরা ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ ধারণার পেছনে পরো সমর্থন পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে।
তারা “Gangaridai/Gandaridai” ও “Prasioi” (প্রাচ্য) নামক দুটি রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে গেছেন এবং তাদের সম্মিলিত শক্তির কথা শুনে বিশ্ব ও উত্তর ভারত বিজয়ী মহাবীর আলেকজাণ্ডার (৩৫৬-৩২৩ ইঈ) এদিকে অগ্রসর হননি।
তৎকালে বাংলা, বিশেষ করে বাঙলার উত্তরাঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় ২৫০০ বছর আগের প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের (বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়) ধ্বংসাবশেষ ও খননের পর সেখানে আবিষ্কৃত সে যুগের অসংখ্য প্রত্নবস্তু থেকে। মৌর্য সম্রাট অশোকের (২৭৪-২৩২ বিসি) বলে অনুমিত ব্রাহ্মী অক্ষরে লিপিবদ্ধ ও মহাস্থানগড়ে আবিষকৃত আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর একটি শিলাখণ্ড লিপি থেকে জানা যায় যে, “কোন এক অত্যাথিক কালে রাজা পুন্দনগলের (পুণ্ড্রনগরের) মহামাত্রকে নির্দেশ দিতেছেন, প্রজাদের ধান্য এবং গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রা দিয়া সাহায্য করিবার জন্য, কিন্তু সুদিন ফিরিয়া আসিলে ধান্য ও মুদ্রা উভয়ই রাজভান্ডারে প্রত্যর্পণ করিতে হইবে, তাহাও বলিয়া দিতেছেন”। ৪ এতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, পুণ্ড্রনগরে অর্থাৎ বাঙলার উত্তরাঞ্চলে সে সময়ে শাসকগোষ্ঠীর (সম্ভবত মৌর্যদের) শুধু একটি প্রশাসন কেন্দ্রই ছিল না, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুগঠিত, সুবিন্যস্ত এবং সুশৃংখলও ছিল। বাঙলার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র যে অপেক্ষাকৃত হাল আমলের (ইংরেজ আমলে গঠিত) বগুড়া জেলার মত শুধু একটি ুদ্র অঞ্চলের জন্যই ছিল না, তা অতি সহজেই অনুমান করা যায় এবং দিনাজপুরসহ বাঙলার উত্তরাঞ্চলের আরো অনেক জেলা যে এই প্রশাসনিক কেন্দ্রের অন্তর্ভূক্ত ছিল, সে ধারণাও অতি যুক্তিসঙ্গত কারণেই করা যায়।
অবশ্য দিনাজপুর জেলায় সেই যুগে কোন প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল কিনা, তা নিশ্চিত করে বলার মত কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে ছিল না যে তাও জোর করে বলা যায় না। কারণ, এ জেলার সর্বত্র প্রাচীন কালের এতসব অনাবিষকৃত প্রাচীন নগরী ও কীর্তির ধ্বংসাবশেষ ছিল যে, সেগুলির মধ্যে কোনটি মৌর্য বা তাঁদেরও পূর্ববর্তী কালের এবং কোনটি গুপ্ত, পাল বা সেন যুগের, তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে খননের অভাবে আজও সঠিকভাবে জানার মত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এই বিপুল সংখ্যক ও বিরাট বিরাট আয়তন বিশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ গুলির মধ্যে বৈজ্ঞানিক উপায়ে খনন কার্য করা হলে এমন সব তথ্যের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, যাতে বাঙলার ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
তবে বর্তমান কালের নিতান্ত অপ্রতুল তথ্যাদির সাহায্যেও একটা কথা একরকম নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে দিনাজপুর (ব্রিটিশ আমলের অবিভক্ত দিনাজপুর) জেলা খুব সম্ভব মৌর্যদের শাসনাধীন ছিল এবং এ জেলার তাঁদের কোনও প্রশাসনিক কেন্দ্র থাকলেও তা ছিল খুব সম্ভব পুণ্ড্রনগরের ‘মহামাত্রের’ প্রশাসনিক কেন্দ্রের অধীনেই।
মৌর্যদের অব্যবহিত পরে দিনাজপুর তথা বাঙলার উত্তরাঞ্চল কোন্ রাজা বা রাজবংশের শাসনাধীন ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। শুঙ্গ ও কুষাণ যুগের কিছু কিছু মুদ্রা, ভাস্কর্য, পোড়ামাটির চিত্রফলক ইত্যাদি প্রতœবস্তু বাংলায় বিশেষ করে বাঙলার উত্তরাঞ্চলে আবিষকৃত হলেও শুঙ্গ ও কুষাণ নৃপতিদের অধিকারে এদেশ ছিল কিনা, তা সঠিকভাবে বলার মত নির্ভরযোগ্য তথ্যের একান্ত অভাব । প্রকৃতপে মৌর্যদের পরে এবং খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পূর্ব ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাঙলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসের কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যই পাওয়া যায় না।
গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, একটি ুদ্র রাজ্যের অধিপতি ও বাঙলার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত মৃগ স্থাপন স্তূপের নিকট একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণকারী বলে কথিত রাজা শ্রীগুপ্তকে সপ্তম শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক ইৎসিঙ বাঙলার অধিবাসী বলে উল্লেখ করে গেছেন। তাঁর এ মত যদি গ্রহণ করা না হয় তবে বাঙলায় গুপ্তদের অস্তিত্ব খ্রীষ্টিয় চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সময় থেকে ধরা যেতে পারে।
সমুদ্রগুপ্ত বা তাঁর পুত্র চন্দ্রগুপ্ত (দ্বিতীয়) বিক্রমাদিত্যের কোন লিপি দিনাজপুর জেলায় আবি®কৃত না হলেও এ জলো যে তাঁদের রাজ্যভূক্ত ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সম্রাট প্রথম কুমার গুপ্তের ২টি তাম্রলিপি (৪৪৩-৪৮ খ্রীঃ) ফুলবাড়ি উপজেলার দামোদরপুর৫ নামক একটি প্রাচীন গ্রামে এবং অন্য একটি তাম্রলিপি (৪৪৭-৪৮ খ্রীঃ) হিলীর নিকট বৈগ্রাম নামক একটি অতি প্রাচীন গ্রামে আবি®কৃত হয়েছে। এ তিনটি লিপি থেকে জানা যায় যে, অবিভক্ত দিনাজপুর জেলায় কোটিবর্ষ, শিলবর্ষ ও পঞ্চনগরী নামক ৩টি বিষয় (প্রায় জেলার আয়তন বিশিষ্ট প্রশাসনিক বিভাগ) ছিল। কোটিবর্ষ নগরী ছিল বাণগড়, দেবকোট বা দেবী কোট (মুসলিম আমলে দেও বা দেবকোট নামে থানা সদরের নিকটবর্তী) নামক স্থানে অবস্থিত। শিলবর্ষ বিষয় ছিল খুব সম্ভব বর্তমান বগুড়া জেলার সেলবরষ পরগনায় (শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই এলাকা এককালে দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল)।
পঞ্চনগরী (গ্রীক ইতিহাসে বর্ণিত ‘পেন্টাপলিস’) বিষয়ের অধিকরণ অর্থাৎ প্রাশাসনিক কেন্দ্র কোথায় ছিল, তা আজও সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি যদিও বিষয়টি দিনাজপুর জেলার দণি পূর্বাঞ্চলে ছিল বলে বিভিন্ন লিপি প্রমাণে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে এর সদর ছিল বর্তমান জয়পুরহাট জেলার অন্তর্গত পাঁচবিবি উপজেলায় অবস্থিত পাথরঘাটা-মাহিগঞ্জ-কসবাউঁচাই নামক প্রাচীন স্থানে। আবার কোন কোন পণ্ডিতের মতে পঞ্চনগরী ছিল দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলা সদরকে কেন্দ্র করে চণ্ডীপুর-গড়পিঙলাই-চরকাই বিরামপুর-বেগমপুর-মির্জাপুর প্রভৃতি স্থানে অবস্থিত যে ৫টি স্বতন্ত্র নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় সেখানে। এ সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু বলা না গেলেও বিভিন্ন লিপি প্রমাণে দেখা বোঝা যায় যে পঞ্চনগরী বিষয়ের অধিকরণ বর্তমান দিনাজপুর জেলায় এবং খুব সম্ভব চরকাই-দিনাজপুরকে কেন্দ্র করেই ছিল।
মগধে রাজত্বকারী পরবর্তী গুপ্তদের অধিকারেও কিছুকাল খুব সম্ভব উত্তর বঙ্গ ছিল।
এঁদের মধ্যে দামোদর গুপ্ত ও তাঁর পুত্র মহাসেন গুপ্ত খুব সম্ভব দিনাজপুর অঞ্চলে তাঁদের অবদানের কিছু চিহ্ন রেখে গেছেন বলে মনে হয়। দামোদর গুপ্তের নামে দুটি প্রাচীন নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে হয়। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল ফুলবাড়ি উপজেলার উত্তর দামোদরপুরে যেখানে গুপ্ত যুগের পূর্বে উল্লেখিত ৫টি তাম্রলিপি আবি®কৃত হয়েছে। দ্বিতীয়টি ছিল ঘোড়াঘাট উপজেলার দণি দামোদরপুর নামক স্থানে। সেখানে হিন্দু বৌদ্ধ যুগের অসঙখ্য কীতির ধ্বংসাবশেষ আজও (১৯৭৪ খ্রীঃ) ঢিবিরূপে টিকে আছে।
গুপ্তদের পরে প্রথমে মহারাজ শশাঙ্ক (মৃত্যু আনুমানিক ৬৩৭ খ্রীঃ), তার পরে সম্রাট হর্ষবর্ধন (মৃত্যু আনুমানিক ৬৪৭ খ্রীঃ) ও জয়নাগ নামক এক নৃপতির রাজত্ব বাঙলার উত্তরাঞ্চলে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। দিনাজপুর জেলা যে তাঁদের রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল তাতে বোধ হয় কোন সন্দেহ নেই। এঁদের প্রায় অব্যবহিত পরে এবং সম্রাট হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর কিছুকাল পরে প্রায় শতবর্ষ ধর বাঙলার উত্তরাঞ্চলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসের কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না এবং এই সময়কে ‘মাৎস্যন্যায়’ অর্থাৎ অরাজক অবস্থার যুগ বলে অতি যুক্তসঙ্গত কারণেই অভিহিত করা হয। পণ্ডিতদের মতে সে সময়ে কোন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না এবং সমগ্র দেশ অসংখ্য ুদ্র ুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং জলাশয়ে বড় মাছ যেমন নির্বিবাদে ছোট মাছকে গলধঃকরণ করে তেমনি প্রবল দুর্বলকে গ্রাস করত বলে এ সময়কে মাৎস্যন্যায় যুগ বলা হয়ে থাকে।
এই অরাজক অবস্থার অবসান ঘটে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রথম পালবংশীয় নৃপতি গোপালের রাজ্য লাভের পরে।
তাঁর জয়স্কন্ধাবার বা রাজধানী কোথায় ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ঘোড়াঘাট উপজেলার অন্তর্গত ‘পল্লরাজ’ নামক প্রাচীন স্থানকে গোপালের প্রথম রাজধানী বলে চিহ্নিত করাহয় স্থানীয় জনশ্র“তি মূলে। সঠিক তথ্যের অভাবে এ সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
গোপালের পরে ধর্মপাল, দেবপাল, নারায়ণ পাল, মহীপাল, রামপাল প্রমুখ প্রখ্যাত নরপতিগণসহ তাঁর বংশধরগণ প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাঙলায় রাজত্ব করেন এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে তাঁদের রাজ্যসীমা বি¯তৃত হয়। খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল রাজত্বের অবসান ঘটে সেনবংশীয় নৃপতিদের অভ্যুদয়ের ফলে।
দিনাজপুর জেলা যে পাল ও সেন বংশীয় নৃপতিদের অধিকারে ছিল, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বাঙলার উত্তরাঞ্চলে সেন রাজত্বের অবসান ঘটে ১২০৫ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কী সমরনায়ক ইখতিয়ার উদ-দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর বঙ্গবিজয়ের পর। বাঙলায় মুসলিম অধিকারের সূচনা সে সময়েই।
মোহাম্মদ বখতিয়ার ‘নওদীহ’ নামক স্থান থেকে মহারাজ লণ সেনকে বিতাড়িত করে ‘লখনৌতি’ (গৌড়-লণাবতী) নামক স্থানে তাঁর প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি দেবকোট (পূর্বে উল্লিখিত বাণগড় বা কোটিবর্ষ) নামক স্থানে তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই তিনি তিব্বত অভিযানে অগ্রসর হন।
সেই ব্যর্থ অভিযানের পরে তিনি দেবকোটই ফিরে আসেন এবং সেখানেই নিহত হন ১২০৬ খ্রীস্টাব্দের প্রথম দিকে। তাঁর মৃত্যুর পর গৌড়-লণাবতী রাজ্যের পরবর্তী দুই শাসনকর্তা মোহাম্মদ শিরান খলজী ও আলী মর্দান খলজীর রাজধানী দেবকোটেই ছিল। তাঁদের পরবর্তী শাসনকর্তা সুলতান গিয়াস-উদ-দীন (হোসাম-উদ্-দীন) ইওয়াজ খলজীর রাজত্বের (১২১২-২৭ খ্রীঃ) প্রথম দিকেও দেবকোটেই ছিল তাঁর রাজধানী। পরে অবশ্য তিনি লখনৌতিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
১২০৫ সালে বাঙলার প্রথম মুসলিম বিজয় থেকে শুরু করে সুলতান আলা-উদ্-দীন হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীঃ) পুত্র সুলতান গিয়াস-উদ্-দী মাহ্মুদ শাহর রাজত্বকাল (১৫৩৩-৩৮ খ্রীঃ) পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়কে বাঙলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে সাধারণ ‘সুলতানী আমল’ বলে অভিহিত করা হয়।
মোহাম্মদ বখতিয়ার ও তাঁর পরবর্তী ৩ জন শাসনকর্তা ছাড়া অন্য কোন সুলতান বা শাসনকর্তার রাজধানী বা প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র দিনাজপুর জেলার কোন স্থানে ছিল কিনা, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে দেবকোট যে মুসলিম আমলে একটি উল্লেখযোগ্য শহর ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। সেখানে সুলতানী আমলের শুধু একটি দুর্গই (দমদমা) নয়, একটি কসবাহ্ অর্থাৎ শহরের ধ্বংসাবশেষও আবি®কৃত হয়েছে।
তাছাড়া অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বহুস্থানে বিশিষ্ট জনপদের অস্তিত্ব ছিল বলে বিভিন্ন লিপি প্রমাণ ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়। এগুলির মধ্যে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলা ও বর্তমানে নওগাঁ জেলার অন্তর্গত পতœীতলা উপজেলার মাহিসন্তোষ, অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত হেমতাবাদ, কোতোয়ালি উপজেলার অন্তর্গত চেহেলগাজি, বিরল উপজেলার অন্তর্গত বিশ্বনাথপুর, রাণীশঙ্কইল উপজেলার অন্তর্গত মহলবাড়ি, অবিভক্ত দিনাজপুর ও বর্তমানে নওগাঁ জেলার পতœীতলা উপজেলার অন্তর্গত শীতলমঠ প্রভৃতি আবি®কৃত হয়েছে।
এসব স্থানের মধ্যে দেবকোট যে খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল, সে কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময়ে আর একটি বিশিষ্ট স্থান ছিল মাহীসন্তোষ। সুলতান রুকন-উদ্-দীন বারবক শাহর আমলে (১৪৫৯-৭৬ খ্রীঃ) সে স্থানের নাম হয় ‘বারবকাবাদ’ এবং সেখানে একটি টাকঁশালও তখন প্রতিষ্ঠিত হয়।
মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রীঃ) সমগ্র মোঘল সাম্রাজ্য কয়েকটি ‘সুবা’য় বিভক্ত ছিল এবং ‘সুবা-ই-বাঙলা’ ছিল সেগুলির অন্যতম। সুবা-ই-বাঙলার অধীনে ছিল প্রায় সমগ্র অবিভক্ত বাঙলা, ভারতের বিহার রাজ্যের ভাগলপুর ও পূর্ণিমা জেলাদ্বয় এবং অবিভক্ত শ্রীহট্ট জেলা।
এই সুবা তখন ১৯টি ‘সরকার’ নিয়ে গঠিত ছিল ৬ এবং সেগুলি ছিল, (১) আরদবুজ্, ওরফে টাণ্ডা, (২) জন্নাতাবাদ অর্থাৎ গৌড়-লণাবতী, (৩) ফতেহাবাদ, (৪) মাহ্ মুদাবাদ, (৫) খলিফাতাবাদ, (৬) বগলা অর্থাৎ বাক্লা, (৭) পুর্ণিয়া, (৮) তাজপুর, (৯) ঘোড়াঘাট, (১০) পাঞ্জরা, (১১) বারবকাবাদ, (১২) বাজুহা, (১৩) সোনারগাঁও, (১৪) সিলহেট অর্থাৎ শ্রীহট্ট, (১৫) চাটগাঁও, (১৬) শরীফাবাদ, (১৭) সোলায়মানাবাদ, (১৮) সাতগাঁও ও (১৯) মদারণ (মান্দারণ)।
এই ১৯টি সরকারের মধ্যে তাজপুর (৮) ঘোড়াঘাট (৯) পাঞ্জার (১০) ও বরবকাবাদ (১১) এই ৪টি সরকারই ছিল অবিভক্ত দিনাজপুর জেলায়। এছাড়া জন্নতাবাদ সরকারের (২) অংশ বিশেষ বিশেষ করে গঙ্গারামপুর ও বংশিহারি থানা দুটি এই জেলার মধ্যেই ছিল। অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে সরকার পাঞ্জরা, পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে সরকার তাজপুর, দণিাঞ্চল নিয়ে সরকার বারবকাবাদ ও দণি-পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল সরকার ঘোড়াঘাট। প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মিঃ ওয়েস্টমেকট (Mr. Westmacott) পানিকট (Sarkaer Panikot) নামক একটি সরকারের উল্লেখ করে গেছেন।
কিন্তু এ নামের কোন সরকার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে নেই। খুব সম্ভব সরকার পাঞ্জরাকে ভুল করে তিনি পানিকট বলেছেন। কারণ, সাবেক দিনাজপুর জেলার কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চল সরকার পাঞ্জরার অন্তর্গত ছিল এবং সেই অঞ্চলকেই তিনি পানিকট বলে উল্লেখ করেছেন। ৭
সরকার বারবকাবাদ ছিল বর্তমান নওগাঁ জেলার অধীনে পতœীতলা উপজেলার অন্তর্ভূক্ত মাহীসন্তোষ নামক স্থানকে কেন্দ্র করে। এস্থান খুবই প্রাচীন এবং প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ যুগেও এ স্থানের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
মোহাম্মদ বখতিয়ারের সঙ্গী ও লখনৌতি রাজ্যে তাঁর অব্যবহিত পরবর্তী শাসনকর্তা মোহম্মদ শিরান খলজী এক যুদ্ধে এখানে নিহত হয়েছিলেন বলে মীনহাজ তাঁর সুবিখ্যাত ‘তবকাত-ই-নাসিরী- গ্রন্থে উল্লেখ করে গেছেন। ৮ এখানে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের বহু প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ ছিল এবং সুলতানী আমলের বহু কীর্তির ধ্বংসাবশেষ ও কয়েকটি শিলালিপি আবি®কৃত হয়েছে। খুব সম্ভব সুলতান রুকন-উদ্-দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-৭৬) এ স্থানে তাঁর একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ও টাঁকশাল স্থাপন করে তাঁর নামানুসারে এ স্থানের নাম রাখেন ‘বারবকাবাদ’। মোঘল আমলের প্রথম দিকেও এ স্থানের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল।
ঘোড়াঘাটের ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন।
এক কালের সুবিশাল করতোয়া নদীর ডান (পশ্চিম) তীরে অবস্থিত এ স্থানের ঐতিহ্যকে মহাভারতের বিরাট রাজার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয় জনপ্রবাদ মতে। এ কাহিনী কাল্পনিক হলেও ঘোড়াঘাটের ঐতিহ্য যে প্রাচীন হিন্দু- বৌদ্ধ যুগের প্রারম্ভেই শুরু হয়েছিল, তাতে বোধ হয় কোন সন্দেহই নেই। সুলতানী আমলেও ঘোড়াঘাটের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল। মোঘল আমলের প্রথম দিক থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত এস্থান শুধু একটি সরকারেরই শাসনকেন্দ্র ছিল না, বাঙলার উত্তরাঞ্চলের একটি বিশেষ ঘাঁটি ছিল ঘোড়াঘাটে এবং আসাম অভিযানের প্রায় সব প্রস্তুতি এখান থেকেই গ্রহণ করা হত। সে সময়ে এখানে একটি বিরাট শহর ছিল।
দিনাজপুরের ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের কথা আবারও বলতে হয়। সেই যুগে রচিত কোনও ইতিহাস-গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় না। সে যুগের বিভিন্ন নরপতি কোন কোন স্থানে তাদের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন, কোথায় কোথায় বড় বড় নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে সম্বন্ধে কোন সুষ্ঠু ও ধারাবাহিক বর্ণনা কোথাও নেই। সেসব নৃপতির যেসব তাম্র বা শিলালিপি ঘটনাচক্রে ও দৈবাৎ আবি®কৃত হয়েছে, সেগুলির সাহায্যেই তাঁদের ও দেশের ইতিহাস রচিত হয়েছে ও হচ্ছে।
সমগ্র অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার সর্বত্র এতসব প্রাচীন কীর্তি ও নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবি®কৃত হয়েছে এবং হচেছ যে, এসব দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
শুধু ভারতের গঙ্গারামপুর থানার সুবিখ্যাত বাণগড় বা কোটিবর্ষ, বংশিহারি থানার সুবিশাল একডালা দুর্গনগরী অথবা পশ্চিম দিনাজপুর জেলার আরও অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষই নয়, বর্তমান দিনাজপুর (সাবেক) জেলার আনাচে কানাচে এতসব অনাবি®কৃত প্রাচীন নগরী ও কীর্তির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে যে, সেগুলির সংখ্যা নিরূপণ করা খুবই কঠিন ব্যাপার। এগুলি দেখে মনে হয় যে এককালে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে শুধু বিভিন্ন নৃপতি ও প্রশাসকদের প্রশাসনিক কেন্দ্রই ছিল না, এ জেলা ছিল প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি। ৯
তথ্য নির্দেশনাঃ
৩.Car, E. H. “What is History”, P. 30
৪.রায়, নীহার রঞ্জন, বাঙালীর ইতহাস, পৃ: ৪৪২
৫.দামোদরপুরে এই সঙ্গে আরো ৩টি তাম্রলিপি আবি®কৃত হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে ২টি হচ্ছে কুমার গুপ্তের কিছুকাল পরের বুধ গুপ্তের (৪৮১-৮২ সাল প্রথম লিপি, দ্বিতীয় লিপির সন জানা যায়নি) এবং তৃতীয়টি হচ্ছে বুধ গুপ্তের পরবর্তী ভানুগুপ্তের (৫৩৩-৩৪ সাল)।
৬.Fazl, Abul, “Ain-i-Akbari”, 3rd edition, Newal kishore press, Lucknow, 1893, vol-121, PP. 59-60. উদ্ধৃত যাকারিয়া, এ. কে. এম. দিনাজপুর, মিউজিয়াম ১৯৮৯, প্রেসিডেন্সী প্রেস, ঢাকা, পৃঃ ৪।
৭.“The Northern and central part of the estate (Dinajpur) was in Akbar’s Sarkar panikot...” Eastern Bengal District Gazetteer- Dinajpur, p.22, Strong, F. W. 1911. উদ্ধৃত যাকারিয়া, এ. কে. এম. দিনাজপুর, মিউজিয়াম ১৯৮৯, প্রেসিডেন্সী প্রেস, ঢাকা, পৃঃ 5।
৮.মীনহাজ-ই-সিরাজ, “তবকাত-ই-নাসিরী”, অনুবাদ ও সম্পাদনা যাকারিয়া এ কে এম. পৃষ্ঠা- ৪৮। উদ্ধৃত যাকারিয়া, এ. কে. এম. “দিনাজপুর মিউজিয়াম” ১৯৮৯, প্রেসিডেন্সী প্রেস, ঢাকা, পৃঃ ৫।
৯.দিনাজপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন: যাকারিয়া, এ. কে. এম. “দিনাজপুর মিউজিয়াম” ,১৯৮৯, প্রেসিডেন্সী প্রেস, ঢাকা, পৃঃ ১-২৬। এবং “দিনাজপুর: ইতিহাস ও ঐতিহ্য”, সম্পাদনায়: আহমেদ, এস. ইউ., বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, ১৯৯৬, এশিয়াটিক সিভিল মিলিটারি প্রেস, ঢাকা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।