বিবেকানন্দের মৃত্যুর বহু বছর পরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফরাসি নোবেল লরিয়েট রম্যাঁ রল্যাঁকে বলেছিলেন, "যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছু নেই। বিবেকানন্দ অনেকগুলি দর্শন-বিষয়ক বই লিখেছিলেন। মানবজাতিকে তিনি চার ভাগে ভাগ করেন—যাঁরা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেন, তাঁদের বলেন "কর্মী"; যাঁরা অন্তরের প্রেরণায় জীবনে কিছু একটা অর্জন করতে চান, তাঁদের বলেন "ভক্ত"; যাঁরা মনে গতিবিধি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাজ করেন, তাঁদের তিনি বলেন "মরমিয়া" এবং যাঁরা যুক্তির মাধ্যমে সব কিছু বুঝে নিতে চান, তাঁদের বলেন "জ্ঞানী"। সন্ন্যাস জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত নরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বাবা কলকাতার সিমুলিয়া পল্লীর বিশ্বনাথ দত্ত এবং মা ভুবনেশ্বরী দেবী। বি.এ. পাশ করে আইন পড়বার সময় পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অর্থাভাবে তাঁকে অনাহারে পর্যন্ত দিন কাটাতে হয়েছিল। বেলুড় মঠে মহাত্মা গান্ধীকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, তাঁর সারা জীবনের উদ্দেশ্য ছিল বিবেকানন্দের ধারণাগুলিকে কাজে পরিণত করা। তার বাণী ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িতে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ১৫০ কোটি টাকা খরচ করবে এই বছরে। স্বামীজী এর আসল নাম ছিলো নরেন্দ্রনাথ দত্ত সংক্ষেপে নরেন দত্ত।
বিবেকানন্দ একজন সুগায়ক ও কবিও ছিলেন। তিনি বেশ কিছু গান ও কবিতা লিখে যান। সেগুলির মধ্যে তাঁর নিজের প্রিয় ছিল মাতৃরূপা কালী কবিতাটি। তিনি সরস ভঙ্গিতে শিক্ষা দিতেন। তাঁর ভাষা ছিল সহজ সরল।
স্বামী বিবেকানন্দ আধুনিক হিন্দুধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনিই এই ধর্মটিকে ভারতে ও ভারতের বাইরে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি কোরআন শরিফও অধ্যয়ন করেছিলেন । বিবেকানন্দ দেশের সর্বব্যাপী দারিদ্র্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং এই দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে জাতীয় জাগরণের কথা বলেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর মতে, বিবেকানন্দের প্রভাব দেশের প্রতি তাঁর ভালবাসা হাজারগুণ বৃদ্ধি করেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, একথা সর্বজনস্বীকৃত। আমরা যদি স্বামীজীর একটি বাণীও ধরে থাকি তাহলে পৃথিবীটা স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হতে বাধ্য। ভারতে বিবেকানন্দের জন্মদিন ১২ জানুয়ারি উদযাপিত হয় জাতীয় যুব দিবস হিসেবে। শেষ জীবনে বিবেকানন্দ অনুতাপ করেছিলেন, কেন গৃহী না হয়ে সন্নাস্যী হয়েছেন-আরেকবার জন্মালে আর সন্ন্যাসী হবেন না, বে-থা করে গৃহীই হবেন। অভুক্ত জাতিকে আগে খেতে দিতে হবে।
ভারতের ধর্মীয় সংস্কার এবং অহংকার ছেরে, আগে জাতিকে খাওয়ানো পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পেটে ভাত না থাকলে, বস্তুবাদি উন্নতি না হলে, সেই জাতির আত্মমর্যাদা থাকে না। তিনি প্রকাশ্যে গো মাংস ভক্ষন করতেন। ছোট জাতকে এক পাতে নিয়ে খেতেন। তার মতে তাবৎ দুনিয়ার সকল মেয়ে মানুষ তার মা ও বোন।
বিবেকানন্দ বহু বই লিখেছিলেন। তাঁর সমগ্র ইংরেজী রচনাবলী আট খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রধান বইগুলি হলঃ 'পরিব্রাজক' (১৯০৩ খ্রী); 'ভাববার কথা' (১৯০৫ খ্রী); 'বর্তমান ভারত' (১৯০৫ খ্রী); 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য । স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩-র ৩১ মে "পেনিনসুলার" জাহাজে করে বোম্বে থেকে আমেরিকা যাত্রা করেছিলেন। এবং দীর্ঘ দুই মাস যাত্রাপথে কাটানোর পর ৩০ জুলাই রবিবার রাত এগারটায় শিকাগোয় এসে উপস্থিত হন।
সেখানে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়ে গেলেন। তিনি জানতে পারলেন, ধর্মমহাসভায় যে-সব প্রতিনিধি যোগ দিতে চান, তাদের প্রত্যেকের পরিচয়পত্র থাকা প্রয়োজন। অথচ তাঁর সাথে কোন পরিচয় পত্র নেই। যে আশা নিয়ে স্বামীজী আমেরিকা এসেছিলেন, যার জন্য এত উদ্যোগ আয়োজন, শিকাগোয় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা এইভাবে চুরমার হয়ে গেল। কিন্ত্ত তবুও তিনি ভেঙ্গে পড়লেন না।
কম খরচে থাকার সুবিধার জন্য প্রায় দু স্তাহ শিকাগোয় থেকে তিনি রওনা হলেন বস্টন অভিমুখে। যাত্রা পথে ট্রেনে পরিচয় হল এক মাঝবয়সী মহিলার সঙ্গে, নাম ক্যাথেরিন স্যানবর্ন। স্বামীজীকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে নিজেই এসে পরিচয় করলেন স্বামীজীর সাথে। ঐ মহিলাও থাকেন বস্টনে। তাঁর খামার বাড়িতে থাকবার জন্য স্বামীজীকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন।
স্বামীজীর মনে হল, এ এক দৈব যোগাযোগ এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মহিলার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। বিবেকানন্দের শিক্ষার একটি মূল কথা হলো চরিত্রগঠন ও খাঁটি মানুষ তৈরি করা। তাঁর নিজের কথায়, ‘সামাজিক ও রাজনীতিক সর্ববিধ বিষয়ের সফলতার মূল ভিত্তি — মানুষের সাধুতা।
স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা ও গান-" নীল আকাশে ভাসে মেঘকুল,/ শ্বেতকৃষ্ণ বিবিধ বরণ---/ তাহে তারতম্য তারল্যের,/ পীত ভানু মাঙ্গিছে বিদায়,/ রাগচ্ছটা জলদ দেখায় |" শিকাগোর প্রথমদিনের বক্তৃতাই স্বামীজীকে আমেরিকায় পরিচিত করে তুলল। রাস্তায় রাস্তায় শোভা পেতে লাগল তার তেজোদৃপ্ত ছবি।
আমেরিকার পত্র-পত্রিকাগুলো তার উচ্ছসিত প্রশংসা করল। "দি হেরাল্ড" লিখল : "ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দই অবিসংবাদিত রূপে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। " নারী মুক্তি এবং নারীর অধিকারের সাম্যতা নিয়ে তিনি দেদারসে শ্লোগান দিয়েছেন। এবং বেদান্তের চোখে নারী-পুরুষ সমান সেটা তার লেখাতে অনেকবার এসেছে। কিন্ত হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান বা সব ধর্মে নারীর অবস্থান এত বাজে কেন-সেই নিয়ে কোন বিশ্লেষন তিনি করেন নি।
তিনি হাঁপানি, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য শারীরীক অসুখে ভুগছিলেন। তিনি কতিপয় লোকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন না। বিবেকানন্দ জীবনীতে দেখা যায়- বিদেশী নারীর কাছে তিনি নারীবাদি, হিন্দুর কাছে তিনি হিন্দু, বিদেশীদের কাছে তিনি আধ্যাত্মিক, জাপানীদের কাছে তিনি জাপানের জাতিয়তাবাদের ভক্ত!বিবেকানন্দ তাঁর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বেচে না থাকার তাঁর নিজের ভবিষ্যৎবাণী পূরণ করেছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজো করলেন। আর সেই থেকেই বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোর প্রচলন হল।
তিনি সাক্ষাৎ পান এক আইরিশ মহিলা মিস মার্গারেট নোবলের যিনি পরে সিস্টার নিবেদিতা নামে পরিচিত হন। সিস্টার নিবেদিতা ভারতে তাঁকে অনুসরণ করেন। সিস্টার নিবেদিতা তার বাকী জীবন ভারতীয় নারীদের শিক্ষায় এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে নিয়োজিত করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকেও তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ অনেক দেশপ্রেমীর কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ।
আইনস্টাইন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ কিংবা অধুনা বিল গেটস, স্টিভ জবস সহ অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েও কিংবা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করেও স্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন নিজের কাজের গুণেই তা আমরা দেখেছি। বিবেকানন্দও কিন্তু তেমনি। তার শিক্ষা জীবন পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ডের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি মোটেই। তিনি তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন নিজ গুণেই। মহাপুরুষদের পূজার আসনে বসিয়ে নিরন্তর স্তব নয়, বরং তাঁদের কাজের নির্মোহ বিশ্লেষণই কেবল আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
# জেগে ওঠো, সচেতন হও এবং লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত থেমো না।
# মানুষের সেবা করা হচ্ছে ঈশ্বরের সেবা করা।
# যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও ক্ষুধার্ত, আমার সমগ্র ধর্মকে একে খাওয়াতে হবে এবং এর সেবা করতে হবে, তা না করে অন্য যাই করা হোক না কেন তার সবই অধার্মিক।
# খালি পেটে ধর্ম হয় না ।
# “যদি কাউকে ইচ্ছেমতো পতি বা পত্নীরূপে গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ এবং পাশবপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির চেষ্টা সমাজে বিস্তার লাভ করে, তার ফল নিষচয় অশুভ হবে- দুষ্টপ্রকৃতি, অসুর ভাবের সন্তান জন্মাবে।
# আমি সন্ন্যাসী, তাই জগতে নিজেকে প্রভু নয়, দাস বলেই মনে করি।
# আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে। আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি! সব রাক্ষসীর মত দেখি।
# “কিছু চাহিও না, উহাই ঈশ্বর, উহাই মনুষ্যত্ব’’।
# ‘‘আমাদের যুবগণকে প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে।
এ কথাগুলো শুনতে ভালই লাগে। মনে হয় কত মহৎ সব কথা। কিন্তু বার বার বহুভাবে চর্চিত বাণীগুলোর পাশাপাশি সম্পূর্ণ বিবেকানন্দকে জানার জন্য তার রচনাবলীর দিকে সংশয়ী দৃষ্টি দিলেই জাগবে চোখ ধাঁধানো বিভ্রম। দেখা যাবে উপরে যে ভাল ভাল কথামালার লিস্টি ঝোলানো হয়েছে, প্রতিটি বানীরই ঠিক একশত আশি ডিগ্রী বিপরীত কথা আবার তিনিই বলে গেছেন।
এক দিকে জীবপ্রেমের গান শুনাচ্ছেন তো অন্যদিকে নিজেই বরাহনগর মঠে পশুবলি প্রবর্তন করেছেন। একদিকে চণ্ডালদের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন তো অন্যদিকে আবার বলছেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মনেরাই চরম আদর্শ’। একদিকে বাল্য বিবাহকে খারাপ বলছেন তো পর-মুহূর্তেই আবার বলছেন, ‘বাল্য বিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করেছে’। একবার কুসংস্কার দূর করার জিকির তুলছেন তো একই মুখে আবার জন্মান্তর, আত্মা আর জাতিভেদ জিইয়ে রাখার পক্ষে সাফাই গাইছেন। একবার নিজেকে সন্ন্যাসী বলে জাহির করেছেন তো আরেকবার ভোগ, বিলাস ব্যসনে আর রাজ রাজাদের গৃহে গিয়ে উদরপূর্তিতে অফুরন্ত সময় ব্যয় করেছেন।
কিন্তু ভক্তকুলের নিবিষ্ট প্রচেষ্টায় সেই বিপরীত কথাগুলো কিংবা তার স্ববিরোধী কাজগুলোকে সযত্নে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। মহাপুরুষ হলেই তাকে দেবতা বানিয়ে একেবারে মাথায় করে রাখতে হবে!
স্বামীজির বেহিসেবী খরচ আর অমিতব্যায়িতা দেখে আমেরিকার বহু ভক্ত তার সান্নিধ্য ত্যাগ করেছিলেন। দেশ যখন দুর্ভিক্ষে তোলপাড়, বিবেকানন্দ তখন খেতরির মহারাজার কাছ থেকে প্রভূত অর্থ যোগাড় করে শিকাগো ধর্মসভায় যোগ দেন, এবং সেটাও হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্যই। বিবেকানন্দ তার বহু লেখাতেই ইংরেজদের অভিহিত করেছেন ‘বীরের জাতি’,’ প্রকৃত ক্ষত্রিয়’, ‘অটল ও অকপট’, এবং ‘প্রভু’ হিসেব । সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের বিলাস ব্যাসন আর অমিতব্যয়ী জীবন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলো যে, সাধারণ সন্ন্যাসীরা বেলুড় মঠের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘গরীব রামকৃষ্ণ সভা’ নামে আলাদা সংস্থা সৃষ্টি করে ফেলতে শুরু করেছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।