মিথ্যেবাদী নই, প্রেমিক আমি ! সকালের এই সময়টা জামিল সাহেবের কাছে আশ্চর্য রকম ভাল লাগে। এক হাতে ধূমায়িত কফির মগ আর অন্য হাতে ধরা খবরের কাগজ। পৃথিবীর সমস্ত সুখানুভুতি যেন একান্তই তার জন্য।
“বাবা, ২০০ টা টাকা দাও”।
জামিল সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ছোট মেয়ে মিলি দাড়িয়ে আছে।
“কোথাও যাচ্ছিস মা?”
“হ্যাঁ বাবা। একটু ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি”।
মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিতে দিতে জামিল সাহেব বললেন, “একটা কথা বলব মা?”
“অবশ্যই বাবা, বল”।
“গত কয়েকদিন যাবত বলব বলব করছি। কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না”।
মিলি হাসল, “ভুমিকার দরকার নেই বাবা। যা বলার নিশ্চিন্তে বলে ফেল”।
“বলছি। তুই একটু আমার পাশে বস”।
মিলি বসল।
“মা, তোর অনার্স তো কমপ্লিট হল। এবার কি করবি বলে ঠিক করেছিস?”
“কেন বাবা? মাস্টার্স করব”।
‘না…তা করবি। ঠিক আছে। কিন্তু আমি বলছিলাম কি…তোর বর বোন জুলি আর তার হাসব্যান্ড তো কানাডায় স্যাটেল্ড ।
বাকি লেখা পড়াটা ওখানে গিয়ে করলে হতোনা ? ক্যারিয়ার এর জন্যও সেটা ভাল হত!”
মিলি অভিমানী সুরে বলল, “আমাকে কানাডা পাঠিয়ে দিয়ে তুমি এখানে থাকতে পারবে তো বাবা?”
জামিল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। “নারে মা, মা মরা মেয়ে তুই আমার। ছোট বেলা থেকে মায়ের আদর বাবার স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছি । তকে ছেড়ে একলা থাকাটা আমার জন্য খুব কষ্টের হবে। কিন্তু তোর ভালর জন্যই …”
“এমন ভালর দরকার নেই আমার”।
জামিল সাহেব হাসলেন। “আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে শোন, অন্য একটা প্লান আছে আমার”।
“কি প্লান?”
“একটা খুব হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিয়ে আমার কাছে রেখে দেব”।
লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল মিলি।
জামিল সাহেব হাসলেন আবার। “কিরে? কথা বলছিস না কেন? রাজি আছিস? তাহলে ছেলে দেখতে শুরু করি?”
মিলি কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রাখল।
“কিরে মা? তোর কি পছন্দের কেউ আছে?”
মিলি চুপ করে আছে দেখে জামিল সাহেব বুঝলেন যে তার ধারনাই ঠিক।
“ছেলেটা কে মা? আমাকে খুলে বল। ভয় পাচ্ছিস কেন? বোকা মেয়ে?”
একটু ইততস্ত করে বলল মিলি, “বাবা, ওর নাম হাসান।
আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর সবচেয়ে ব্রিলিয়ানট স্টুডেন্ট”।
“হুম, জানতাম। আমার মেয়ে তো আর যে সে ছেলে কে পছন্দ করবে না! ছেলেটা কি তোর ক্লাসমেট?”
“না, আমার এক ব্যাচ সিনিয়র। এবার মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে”।
“বাড়ি কোথায়? বাবা কি করেন?”
“ওর বাড়ি পঞ্চগড়ে।
মিলি একটু ইততস্ত করে বলল। বাবা স্কুলের শিক্ষক”।
জামিল সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “এমন ভাবে কথাটা বলছিস যেন বিরাট একটা অন্যায় করে ফেলেছিস। আরে আমার বাবাও স্কুল মাস্টার ছিলেন। আমি নিজ চেষ্টায় আজ কোটি পতি হয়েছি।
তোর উপর আমি অনেক খুশি মা। তুই সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটাকে বেছে নিয়েছিস”।
মিলি আনন্দের আতিশয্যে বাবাকে জরিয়ে ধরল। “থ্যাংক ইউ বাবা। আমি জানতাম তুমি অমত করবে না”।
“আরে… হয়েছে থাম থাম। অমত করব কিভাবে? তোর আর আমার পছন্দ কখনও ভিন্ন হয়েছে বল?”
মিলি লজ্জা পেয়ে বাবাকে ছেড়ে দিল।
জামিল সাহেব বললেন, “এখন কাজের কথা শোন। কাল ছেলেটাকে আসতে বল। আমি ওর সাথে কথা বলব”।
***
“কি বলছ এসব? মিলির কথা শুনে ভ্যাবা চেকা খেয়ে গেল হাসান। তুমি আঙ্কেল কে সব বলে দিয়েছ?
দুজনে টি এস সি তে বসে গল্প করছে। হাসানের দুরাবস্থা দেখে মিটি মিটি হাসছে মিলি। “হ্যাঁ… সব বলে দিয়েছি”।
“কেন? তোমাকে না বললাম আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর।
একটা ভাল চাকরি বাকরি ধরি, তারপর না হয় বলা যেত!”
“আসলে বাবা এমন ভাবে ধরল যে না বলে উপায় ছিলনা!”
“এখন কি হবে?”
“কি আর হবে? বাবা তোমাকে কাল আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছেন। তোমার সাথে কথা বলবে”।
“এই সেরেছে রে!” ভয় পাওয়ার ভান করল হাসান। “নাটক- সিনেমায় দেখেছি বড়লোক বাবারা বড়লোক বাবারা ভীষণ রাগি হয়। মেয়ের প্রেমিক কে মাইর খাওয়ায়!”
মিলি ভ্রু কুছকাল।
“ধুর! আমার বাবা মোটেই ঐ রকম না। ওনার মত মানুষই হয়না। একবার কথা বললেই বুঝবে”।
“ঠিক আছে থাকব। কিন্তু কথা বলার সময় অবশ্যই তুমি আমার পাশে থাকবে!”
“আচ্ছা বাবা থাকব”।
হাসল মিলি।
মিলি জানে হাসানের এই ভয় পাওয়াটা আসলে অভিনয়। বাস্তব জীবনে সে দেখেছে হাসানের মত সাহসী ছেলে খুব কমই আছে। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হাসান কখনও ভয় পায়না। সে একটি বামপন্থী দলের আদর্শে বিশ্বাসী।
বলিষ্ঠ কণ্ঠে যখন সে বক্তৃতা দেয় তখন গাছের পাতারাও যেন কেপে কেপে ওঠে। একটি ছেলের মাঝে মেধা আর দুঃসাহসের এক অপূর্ব সমন্বয়। তাইতো প্রথম দিন কথা বলার পর থেকে হাসানকে সে ভাল বেসে ফেলেছে গভিরভাবে!
***
‘মিলির কথাই ঠিক’। মনে মনে ভাবল হাসান।
মিলির বাবা জামিল চৌধুরী অত্যন্ত অমায়িক মানুষ।
হাসান যখন মিলিদের বাড়িতে এল, তখন জামিল চৌধুরী ড্রয়িং রমে বসে পত্রিকা পড়ছিল। হাসান বাসায় ঢোকার পর পরই তিনি উঠে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর নিজের পাশে নিয়ে বসিয়েছেন। কাজের লোককে ডেকে চা-নাস্তা দিতে বললেন। তারপর আবার আবার পত্রিকায় কি একটা খবরের মাঝে ডুবে গেছেন।
পাশে যে হাসান বসে আছে তা বেমালুম ভুলে গেছেন। মিলি বসেছে একটু দূরে। মাঝে মঝে হাসানের সাথে চোখা চোখি হচ্ছে। হাসান অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে আর মিলি ঠোঁট টিপে হাসছে।
অবশেষে খবরটা পরা শেষ করলেন জামিল চৌধুরী।
পত্রিকা নামিয়ে রেখে বললেন, “তারপর বল ইয়ং ম্যান ! কেমন আছ?”
“জি … ভাল আছি”।
“বাড়িতে কে কে আছেন তোমার?”
“বাবা-মা আর ছোট একটা বোন, স্কুলে পরছে”।
“সবাই ভাল আছে তো?”
“জি… ভাল আছে”।
“তারপর? লেখাপরা তো শেষ। এখন করবে ভাবছ?”
“দুএকটা চাকরির অফার পেয়েছি।
কিন্তু আমি আরও ভাল কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি। এ বছর বি সি এস পরীক্ষাটাও দিতে পারি। আশা করি খুব তারাতারি একটা বাবস্থা হয়ে যাবে”।
“তা তো হবেই। হাসানের পিঠ চাপরে দিলেন জামিল সাহেব।
তুমি ব্রিলিয়াণ্ট ছেলে। তোমাকে যেকোনো প্রতিষ্ঠান টেনে নিতে চাইবে। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমি বলছিলাম কি… আরও ভাল কিছু করা যায়না?”
“ঠিক বুঝলাম না”। হাসান একটু বোকার মত হাসল।
“না… মানে বলছিলাম যে… ভাল একটা চাকরি করে হয়ত তুমি সাচ্ছন্দে নিজের জীবনটা চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তোমার কি এরচেয়ে বড় কোনও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করেনা?”
হাসান চুপ করে থাকল।
“দেখ ইয়ং ম্যান। বলছেন জামিল চৌধুরী। তোমার মত আমার বাবাও স্কুল মাস্টার ছিলেন।
আমি ঢাকা শহরে এসেছিলাম ১০০০ টাকা পকেটে নিয়ে। আজ আমি কোটি পতি। এটা সম্ভব হয়েছে কারন আমার স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার”।
হাসান বলল, “জিবনে বড় কিছু করার ইচ্ছা আমারও আছে। কিন্তু আপাতত এতকিছু ভাবছিনা”।
“ভাবতে হবে ইয়ং ম্যান। সময় চলে গেলে ভেবে আর লাভ কি হবে? এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়!”
“জি … আমি আসলে বুঝতে পারছিনা আপনি কি বলতে চাচ্ছেন”। হাসান ভাবে মিলির দিকে তাকাল। মিলিও চুপ চাপ।
“বুঝিয়ে বলছি”।
জামিল চৌধুরী বলছেন। “তোমাকে আমার মেয়ে ভাল বাসে। আর আমার মেয়ে জাকে ভাল বাসে আমিও তাকে ভাল বাসি। তুমি আমার সন্তানের মতই”।
একটু থামলেন জামিল চৌধুরী।
আবার শুরু করলেন। “আমার সম্পদ যা আছে সব ই আমার সন্তানদের জন্য। আমার বড় মেয়ে কানাডায় স্যাটেল্ড। গ্রিন কার্ড পেয়েছে। তাই এদেশে যা কিছু আছে আমার, বলতে গেলে সবই আমার ছোট মেয়ে মিলি পাবে”।
হাসানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল, “আমি বোধহয় বুঝেছি। আপনি কি বলতে চান?”
“তুমি রেগে যাচ্ছ ইয়ং ম্যান! অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন জামিল চৌধুরী। তোমার ধারনা ভুল। তুমি যা ভাবছ আমি টা বলতে চাইছি না।
আমি বলছিনা যে তুমি সব ছেড়ে ছুড়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করে ঘর জামাই হয়ে আমার বিজনেস দেখা শুনা কর”।
“তাহলে কি বলতে চাইছেন ?”
“আমি বলতে চাইছি যে তুমি নিজে বিজনেস কর। আমি যেমন নিজের চেষ্টায় এতদুর এসেছি তেমনি তুমিও নিজের চেষ্টায় বড় হও। চাকরি বাকরি করে ভাল থাকা যায় কিন্তু বড় কিছু করা যায়না। তুমি অল্পবয়সী ছেলে, তুমি মেধাবি, তোমার সাহস আছে, বুদ্ধি আছে, ঝুকি নেয়ার ক্ষমতা আছে।
তুমি বিজনেস এ নামলে অবশ্যই সফল হবে”।
“জি আমার সেই চিন্তাও আছে। আমি দু এক জনের সাথে কথা বলে রেখেছি। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর ফার্ম দেয়ার ইচ্ছা আছে। তবে এখন না।
আগে একটা চাকরি বাকরি করি- কিছু পুজি জমা হোক, তারপর…”
“এই কথাটাই আমি বলতে চাইছিলাম। হাসলেন জামিল চৌধুরী। যেই পুজিটা তুমি ১০ বছর চাকরি করে জমাতে চাইছ তা আমি তোমাকে এখনই দিতে চাই”।
বুক পকেট থেকে একটা চেক বের করলেন জামিল চৌধুরী। “এখানে তোমার নামে ৫ কোটি টাকা ইস্যু করে দিয়েছি আমি।
টাকাটা তোমাকে একেবারে দেইনি। ধার হিসেবে দিলাম। বিজনেসে লাভের মুখ দেখলে আস্তে আস্তে আমাকে শোধ করে দিও। অনেক ওপরে উঠতে হলে নিচ থেকে ধাক্কার প্রয়োজন হয়। আমি শুধু সেই ধাক্কা টা দেয়ার চেষ্টা করছি।
আর কিছু নয়”।
জামিল সাহেব চেকটা হাসানের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। হাসান তাকাল মিলির দিকে। মেয়েটা এত নির্লিপ্ত থাকে কিভাবে?
“নাও হাসান। আমি তো তোমার বাবার মতই।
বাবার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়াটা সন্তানের অধিকার”। জামিল চৌধুরী চেকটা বাড়িয়ে ধরে আছেন।
মিলির চোখে চোখ রেখে চেকটা ধরল হাসান।
“সাবাস! আমি এই চাইছিলাম। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর বিজনেস এর ভাল সম্ভাবনা আছে।
তুমি আজই একটা অফিস নিয়ে নাও। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু কর। ক্লায়েন্ট পাওয়ার ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করব। তোমার বিজনেস মোটা মোটি রানিং হওয়ার সাথে সাথে আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে”।
হাসান হাসল মিলির দিকে তাকিয়ে।
মিলিও নিরবে হাসল।
***
মিলিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল হাসান। তার হাতে ধরা ৫ কোটি তাকার চেক। মিলির বাবার টাকা নিয়ে বিজনেস শুরু করার কোনও ইচ্ছা নেই হাসানের। কিন্তু মিলির সামনে তার বাবার চেকটা ফিরিয়ে দিতে পারেনি হাসান।
তাতে করে জামিল চৌধুরী অপমানিত বোধ করতেন। হাসান বুঝতে পেরেছে যে কোটি টাকার এই চেক দেয়ার কথা মিলিই তার বাবাকে বলেছে। তাই না নিলে মিলি কষ্ট পেতে পারে ভেবে চেকটা নিয়েছে হাসান। সে স্বাধীনচেতা ছেলে। অন্যের টাকায় বড়লোক হতে চায়না সে।
চেক টা টুকরো টুকরো করে ছিরে ফেলল হাসান। তারপর ফেলে দিল ড্রেনে। মিলির বাবাকে দেওয়া কথা রাখবে হাসান। বিজনেস শুরু করবে সে। কিন্তু মিলির বাবার সাহায্য নিয়ে নয়।
***
এর পর এক মাস কেটে গেল। এই সময়টাতে মিলির সাথে কোনও যোগাযোগ রাখেনি হাসান। এর মধ্যে কয়েকটা কাজ করেছে সে। তার বন্ধু রাসেলের সাথে পার্টনারসিপে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর একটা বিজনেস দার করিয়েছে। নাম দিয়েছে ড্রিমজোন।
গ্রামের কিছু জমি জমা বিক্রি করে মোটা মোটি একটা পুজি দার করিয়েছে। রাসেলের বাবার ফার্মগেটের কাছে মনিপুরি পারায় বাড়ি আছে। সেই বারির নিচ তলায় ছোটখাটো একটা অফিস বসিয়েছে ওরা। এভাবে সব কিছু গুছিয়ে এনে একদিন মিলির নম্বরে ফোন দিল হাসান। মিলির নম্বর বন্ধ! সেদিন সারা দিনই ট্রাই করল হাসান, কিন্তু মিলির নম্বর বন্ধ পেল।
সে পরদিন মিলিদের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
***
“মিলি চলে গেছে হাসান”। থমথমে গলায় বললেন জামিল চৌধুরী।
“কোথায় গেছে?” হাসানের গলায় ভয়ার্ত সুর।
“কানাডায় চলে গেছে।
ওর বড় বোনের কাছে। গতকাল ফ্লাইট ছিল”।
“কিন্তু কেন?” বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আর্ত চিৎকার টাকে খুব কষ্টে চাপা দিল হাসান।
“আমি জানিনা, আমাকে কিছু বলেনি। সেদিন তুমি যাওয়ার পর থেকেই সে ভীষণ কাঁদছিল।
সারাটা দিন অনেক কেদেছে। আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি। সারা দিন কিছু খায়নি। রাতে আমাকে ডেকে বলল, বাবা তুমি বাবস্থা কর। আমি কানাডা চলে যাবো।
আমি অনেক প্রশ্ন করেও সঠিক জবাব পাইনি। শুধু বলেছে, কোনও প্রশ্ন করোনা বাবা। আমি যা ঠিক মনে করেছি তাই করছি”।
হাসানের মনে হল পুরো পৃথিবীটা তার মাথার ওপর ভেঙে পরেছে। সে অতি কষ্টে বলল, “আমাকে কিছু জানায়নি কেন?”
“আমি জানিনা।
সেদিন থেকে মোবাইল টাও বন্ধ করে রেখেছিল। আর তুমিও তো কোন যোগাযোগ করনি”।
হাসান চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
জামিল সাহেব ডাকলেন, “হাসান”!
হাসান দাঁড়ালো। জামিল সাহেব এগিয়ে এসে তার দিকে একটা মুখ আটকানো চিঠি বাড়িয়ে ধরলেন।
“যাওয়ার দিন মিলি এই চিঠিটা দিয়ে গেছে আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার জন্য”।
চিঠিটা হাতে নিয়ে খাম ছিঁড়ল হাসান। মিলির নিজ হাতে লেখা চিঠি ! পড়তে পড়তে হাসানের দু চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই অঝোর ধারায় অশ্রু নামল।
চিঠি তে কি লেখা আছে তা জানতে চাইলেন না জামিল চৌধুরী। শুধু বললেন, “বাবা হাসান! আমি খবর নিয়েছি- তুমি এখনও চেকটা ক্যাশ করাওনি।
তুমি চেকটা ক্যাশ করাও, বিজনেস শুরু কর। আমি বলছি তুমি ভাল করবে”।
হাসান কোনও জবাব না দিয়ে চলে গেল।
***
২৫ বছর পর…
আজ বাংলাদেশ ব্যাবসায়ি পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। এখন দর্শকদের সামনে উপস্থাপক নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করছে।
মঞ্চে বসে আছে এদেশের গণ্য মান্য কিছু বাক্তিবর্গ।
“আজকের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ ব্যাবসায়ি পরিষদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বিশিষ্ট সমাজ সেবী, বুদ্ধিজীবী ও বাংলাদেশের প্রধম সারির ধনী বাক্তিদের একজন মিস্টার হাসান মাহমুদ”।
দর্শকরা তুমুল করতালি দিল।
“এখন আমরা মিস্টার হাসান কে অনুরোধ করছি আমাদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য”।
মিস্টার হাসান উঠে দারালেন।
তার চুলে পাক ধরেছে। চোখে চশমা। চেহারায় বয়সের ছাপ পরেছে। কিন্তু কণ্ঠের সেই তেজ এখনও আছে। কথা বলতে বলতে তিনি যেন সেই ছাত্র জীবনে ফিরে গেছেন।
বলিষ্ঠ কণ্ঠে তিনি এদেশের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে বিত্তবানদের ভুমিকা নিয়ে একটা ভাষণ দিলেন।
তার সেই ভাষণ দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে শুনল। কিন্তু কেউ জানেনা এই শক্তিশালী মানুষটি কেন সারা জীবন অবিবাহিত রয়ে গেলেন। কেউ জানেনা এত অর্থ যশ খ্যাতি সব কিছু পাওয়ার পরও তার হৃদয়ে না পাওয়ার কি নিদারুন ব্যাথা!
***
বৃদ্ধ জামিল চৌধুরী মৃত্যুশয্যায়। হাঁসপাতালের ধবধবে সাদা চাদরের ওপর অসহায় অবস্থায় পরে আছেন।
ডাক্তার আসলেন।
“জামিল সাহেব, তাকিয়ে দেখুন । আপনার সাথে দেখা করার জন্য কে এসেছে!”
জামিল চৌধুরী আস্তে আস্তে চোখ খুললেন।
“মিলি!”
“হ্যাঁ বাবা, আমি”। মিলি তার বাবার হাত ধরল।
ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
“মা! এতদিন পরে এলি? এই ২৫ টি বছর তুই কিভাবে আমাকে ছেড়ে দূরে দূরে থাকলি মা?”
মিলি কিছু বলতে পারল না। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গরিয়ে পড়তে লাগল।
“আজ বাবা মৃত্যু শয্যায়, সেই খবর পেয়ে এসেছিস?”
“চুপ কর বাবা”। মিলি কান্না থামানোর আপ্রান চেষ্টা করছে।
“তাও ভাল যে এসেছিস! যাক, মৃত্যুর আগে একবার তোকে দেখে যেতে পারছি এটাই বা কম কি?”
মিলি কাঁদছে নিরবে। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠিক যেমন ছোট বেলায় রাগ করলে তার বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত।
“তোর স্বামী আর আমার নানুভাই কেমন আছে?”
“ভাল আছে বাবা। ওরা আগামিকাল আসবে”।
জামিল চৌধুরী হাসলেন। তারপর প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, “মিলি একটা জিনিস দেখবি মা?”
“কি দেখাবে বাবা?”
“আমার মাথার কাছে একটা পত্রিকা রাখা আছে। দেখ”।
মিলি পত্রিকা হাতে নিল। “কি দেখবো বাবা?”
“প্রথম পাতায় একটা খবর ছাপা হয়েছে দেখ!”
মিলি পড়ল।
“বিশিষ্ট সমাজসেবি হাসান মাহমুদ বাংলাদেশ ব্যাবসায়ি পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত”। ইনসেটে ভাষণ দেয়া অবস্থায় হাসানের ক্লোজ আপ ছবি।
মিলি হাসল। “সেই চোখ, সেই ভঙ্গী, সেই বলিষ্ঠ অবয়ব। হাসান বদলায় নি, বাবা ! আগের মতই আছে!”
জামিল চৌধুরী বললেন, “ঠিক বলেছিস।
আমি বলেছিলাম না? এই ছেলে একদিন বিশাল কিছু হবে? আমি দেখেই বুঝেছিলাম- ওর মাঝে বড় হওয়ার স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে পারলে এই ছেলে আর পিছন ফিরে তাকাবে না! ছেলেটা সত্যি অসাধারন!”
তিক্ত ভঙ্গিতে হাসল মিলি।
“আমি কখনও জানতে চাইনি, কেন তুই ওর কাছ থেকে দূরে সরে গেলি। কখনও জানতে চাইবনা। কিন্তু তুই আমার মেয়ে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তুই ওকে অনেক ভালবাসতি।
ওকে ভুলে যাওয়ার জন্যই তুই দেশ ছাড়লি, বাবা কে ছাড়লি, সংসার করলি…”
“থাক বাবা! প্লিজ আর বলোনা! আমি এসব শুনতে চাইনা”।
জামিল সাহেব মৃদু হাসলেন! “একটা ব্যাপার কি জানিস মা? সেই যে হাসানকে বিজনেস শুরু করার জন্য আমি একটা ৫ কোটি টাকার চেক দিয়েছিলাম না? সেই চেকটা হাসান আজও ভাঙ্গায় নি! ছেলেটার কি সাহস! সে কারো সাহায্য ছাড়া একা একা এত দূর চলে এল!”
মিলির হাত থেকে পত্রিকা টা পরে গেল। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে আর থামাতে পারলনা। বাবার কথাগুলো তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে!
“কি বললে বাবা? হাসান সেই চেক ভাঙ্গায়নি?” মিলির কণ্ঠে ছিল সব হারানোর বেদনার আর্ত চিৎকার!
মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে জামিল সাহেবের কাছে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন যে তার মেয়ে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভুলটি করেছে!
***
রাত হয়েছে অনেক।
কিন্তু ঘুম আসছে না। অনিদ্রা যে কত ভয়ঙ্কর অসুখ, সেটা যার হয়নি তাকে বলে বুঝানো যাবে না। হাসান মাহমুদ মনে প্রানে ঘুমাতে চাইছেন। মনে কোন দুশ্চিন্তা নেই, আশপাশের কোন আওয়াজ ঘুমে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে না। রাত জেগে সময় কাটানোর কোন কাজ নেই।
কিন্তু তবুও ঘুম আসছে না। সারা পৃথিবী নিশ্চুপ ঘুমিয়ে আছে, শুধু হাসানের চোখে ঘুম নেই। এ বড় ভয়ঙ্কর অনুভুতি!
হাসান অসহায়ের মত বিছানায় ছটফট করছেন। এক একটি সেকেন্ড কে মনে হচ্ছে যেন এক একটি বছর! একটু পর পর দেয়ালের বড় ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছেন। সময় যেন কাটতেই চায় না।
মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হচ্ছে ঘড়িটা কি বন্ধ হয়ে গেছে!
অস্থির হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। দেয়াল ঘড়িটা সময় বলছে রাত দুটো বাজে। হাসান বিছানা থেকে নামলেন। আলমারি খুললেন। একটা ফাইল বের করলেন।
সেই ফাইলের ভেতর থেকে বের করলেন একটা মলিন হয়ে যাওয়া চিঠি!
বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিল ল্যাম্প টা জালালেন। পরম যত্নে চিঠিটার ভাজ খুললেন। তারপর হঠাৎ শিশুদের মত ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। এখন এই মানুষটাকে দেখে কেউ ভাবতেও পারবেনা যে তিনি প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ডিল করেন। তার একটা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে কত কিছু!
চিঠিটার প্রতিটা লাইন তার মুখস্থ।
তবুও পড়েন, প্রতিদিন পড়েন। যেন এরচেয়ে শান্তির কাজ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।
প্রিয় হাসান,
আমার অনেক ভালোবাসা জানবে। তোমার হাতে যখন এই চিঠি পৌঁছাবে তখন হয়ত আমি তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে। কেন চলে গেলাম জানতে চাও? জানো হাসান? যখন বাবা তোমার দিকে চেকটা বাড়িয়ে ধরল- আমি অবাক হয়ে চেকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আমি মনে প্রানে চাইছিলাম যেন চেকটা গ্রহন না কর। কিন্তু তুমি চেকটা নিলে! আমি যেই হাসানকে ভালবাসতাম, সেই দিন তোমাকে সেই হাসান মনে হয়নি। যেই স্বাধীনচেতা ছেলেটি কখনও মাথা নত করতে শেখেনি, কখনও আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনও কাজ করেনি, সেই ব্যাক্তিত্তপূর্ণ মানুষটার কাছে এই আচরণ আমি আশা করিনি। আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি হাসান। আমি জানি তুমি আমাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালবাস।
তাই আমার সুখের কথা ভেবেই তুমি বাবার কাছ থেকে চেকটা নিয়েছ। তুমি বড় কিছু করতে পারলে আমাকে সুখে রাখতে পারবে, এই ভেবে নিজের ব্যাক্তিত্তকে বিসর্জন দিয়েছ। কিন্তু বাইরের সুখটাই কি সব কিছু? মনের সুখ কি কিছুই নয়? বিশ্বাস কর হাসান। আমি সুখি হতাম না। আমি চেয়েছিলাম তুনি বড় হও।
কিন্তু আমার বাবার সাহায্য নিয়ে বড় হও- এটা চাইনি। সারা জীবন মনের মধ্যে অদম্য কষ্ট নিয়ে তোমার সাথে সুখি হওয়ার অভিনয় করে যেতে হত! আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি হাসান। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমি যেন অনেক বড় হও। নামি-দামি একজন মানুষে পরনত হও। কিন্তু আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম।
যদি আমার ভাল চাও তাহলে কোনোদিন আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনা। আমি তোমাকে ভুলে যেতে চাই হাসান! জানি পারবোনা- কিন্তু আমি চেষ্টা করে যাবো। এই জীবনে হয়ত আর কাউকে ভালবাসতে পারবোনা। কারন আমার সকল ভালোবাসা আমি তোমার কাছে রেখে গেলাম । ভাল থেক।
ইতি
তোমার একান্ত ভালবাসার মানুষ
মিলি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।