আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিকফার এপিঠ-ওপিঠ

প্রথমে ছিল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি বা টিফা। এর খসড়াটি ২০০৩ সালে বড়ভাবে আলোচনায় আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ টিফা স্বাক্ষর করবে কি করবে না, তা নিয়ে জোর বিতর্ক দেখা দেয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে নাম বদলে করা হয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি বা টিকফা। আর গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম (টিকফা) চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার।

বলা হচ্ছে, টিকফা স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হবে। প্রকাশ করা হয়েছে চুক্তির খসড়াটি। এটি পর্যালোচনা করে এই চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাব্য প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে প্রথম আলোর কাছে দুজন বিশেষজ্ঞ তাঁদের সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ ও মতামত দিয়েছেন, যা এখানে তুলে ধরা হলো

বাংলাদেশের আদায়যোগ্য স্বার্থ এতে জোরদার হবে: মনজুর আহমেদ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে টিকফা স্বাক্ষরের বিকল্প কিছু নেই। আট বছরের বেশি সময় ধরে এটি নিয়ে কালক্ষেপণ করা হয়েছে, সরকার অনেক বেশি লুকোচুরি করেছে; যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে।

এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিবিড় করার সুযোগ তৈরি হলো। বস্তুত টিকফার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কে নিয়মিত আলোচনার জন্য একটি ফোরাম গঠন করা হবে। এই ফোরামে বেসরকারি খাত ও সুশীল সমাজের সঙ্গেও পরামর্শ করার সুযোগ থাকবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ কমে আসবে।
টিকফা অনুসারে বাংলাদেশ ও আমেরিকা যার যার দেশের শ্রম, পরিবেশ ও মেধাস্বত্ব আইনকানুন পরিপালন করবে।

মেধাস্বত্ব আইনের ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) বাংলাদেশ যে ছাড় পেয়ে আসছে, তা-ই বহাল থাকবে। একইভাবে শ্রমমানের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিধিবিধান মেনে চলতে হবে বাংলাদেশকে। কোনো ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র এর বাইরে কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না। টিকফার অন্যতম মূল কথাই হলো, যার যা বাধ্যতামূলক, তাকে তা অনুসরণ বা প্রতিপালন করতে হবে।
টিকফার সুদূরপ্রসারী কিছু সুফল আছে, যা আপাতত দৃশ্যমান না-ও হতে পারে।

যেমন, বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনা করতে পারবে। শুল্কমুক্ত-সুবিধা শিগগিরই পাওয়া না গেলেও তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী প্রধান পণ্যগুলোতে শুল্ক ছাড় বা অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। আসলে ২০০৫ সালেই যদি বাংলাদেশ টিফা (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি) স্বাক্ষর করত, তাহলে এত দিনে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যে বড় ধরনের শুল্কছাড় পাওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে এখনকার মতো ১৫ শতাংশ হারে এমএফএন শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হতো না। যদি মোটা দাগে হিসাব করি, তাহলে বলা যায় যে আট বছরে অন্তত ৭০ কোটি ডলার শুল্ক কম দিতে হতো।


টিকফার ফলে বাংলাদেশ এখন বরং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উন্নত প্রযুক্তি স্থানান্তরের বিষয়ে কথা বলতে পারবে, ওষুধশিল্পের জন্য বাধ্যতামূলক বা কম্পালসারি লাইসেন্সিং চাইতে পারবে। এভাবে বাণিজ্যসংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশের আদায়যোগ্য স্বার্থ বা অফেনসিভ ইন্টারেস্ট জোরদার হবে।
মনজুর আহমেদ: উপদেষ্টা, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)

মেধাস্বত্ববিষয়ক ধারাটি সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা: তৌফিক আলী
টিকফা কেন করা হচ্ছে বা এ থেকে বাংলাদেশ কী কী সুবিধা পাবে, সে বিষয়ে সরকারের দিক থেকে খুব স্পষ্ট কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়বে। কিন্তু তা কীভাবে হবে, তা পরিষ্কার নয়।

টিকফার এই খসড়ায় আমাদের পাওয়ার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে টিকফা স্বাক্ষরে সম্মত হয়েছে। তাদের কী উদ্দেশ্য আছে বা তাদের কী সুবিধা হবে, সে বিষয়ে আমরা স্পষ্টভাবে কিছু জানি না; তবে কিছুটা ধারণা করতে পারি। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় যেকোনো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
চুক্তির সবচেয়ে গোলমেলে ও উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে মেধাস্বত্ববিষয়ক ধারাটি।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ডব্লিউটিওর আওতায় আমরা বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব অধিকার (ট্রিপস) আইনে বড় ধরনের ছাড় পেয়েছি। আমেরিকা-ইউরোপের বিরোধিতা সত্ত্বেও কয়েক দিন আগে এই ছাড় ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। টিকফায় মেধাস্বত্ব বিষয়ে ডব্লিউটিওর বাধ্যবাধকতা অনুসরণের কথা বলা হলেও ছাড়ের উল্লেখ নেই। মেধাস্বত্ব আইন মানতে গেলে কোনো বিদেশি বইয়ের আর কপি বা অনুলিপি করা যাবে না এবং কোনো নকল সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন অনেক দূর পিছিয়ে যাবে।


আবার বার্ন কনভেনশনের কথা বলা হয়েছে; অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বার্ন কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কেননা, ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সে দেশে কোনো বিদেশি বই বিক্রি করা যেত না। এভাবে তারা তাদের গ্রন্থশিল্পকে সুরক্ষা দিয়েছে। ডব্লিউটিওতে অনেক চেষ্টা করে, অনেক লড়াই করে আমরা যে ছাড় পেলাম, সেটা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় এসে নাকচ হয়ে যায় কি না, তাই ভাবনার বিষয়।
বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতার নানা রকম বাধ্যবাধকতা থাকে, যা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ছাড় দেওয়া যায়, ছাড় দেওয়া হয়।

টিকফার আওতায় বাণিজ্য আলোচনাকে সেভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন।
বাজারসুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোনো ক্ষমতা নেই। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মার্কিন কংগ্রেস। আর বাংলাদেশের এই সুবিধা পাওয়ার সুযোগ খুব ক্ষীণ। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো, খসড়ায় অশুল্ক বাধার (এনটিবি) উল্লেখ আছে।

অথচ আমাদের প্রয়োজন শুল্ক বাধা অপসারণ।
তৌফিক আলী: জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।