যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় ব্যক্তি এন্ডি শ্যারম্যান, প্যাসিফিকের আর্মি কমান্ডার, ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি শিয়ার ও ব্লেইকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাংলাদেশ সফর মানেই ‘বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা হচ্ছে’ বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে ১ ঘণ্টার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে যখন ৩০ মিনিট বেশি সময় ধরে বৈঠক করেন তখন সেটিকে আর সাধারণ বৈঠক হিসেবে দেখতে চান না এই কূটনীতিক। ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ’ আয়োজিত একটি সেমিনারে গত ২২ মে তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে আরো কিছু অর্থপূর্ণ কথা বলেছেন।
বাংলাদেশে আসলে কী হচ্ছে? দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের চোখ খোলা রেখে যা দেখতে পাচ্ছে তার বাইরেও কি আরো কিছু হচ্ছে? পর্দার অন্তরালে? যা গুরুত্বপূর্ণ? বর্তমান সরকারের শাসনামলে গোটা দেশ জুড়ে গত সাড়ে ৩ বছরে যা হয়েছে, যা হচ্ছে তাকে কোন অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়? কোন অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত?
যে বিপুল প্রত্যাশা আর স্বপ্ন দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল সেই প্রত্যাশা পূরণে তারা এখন পর্যন্তও সফল হতে পারেনি। সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।
সরকার স্বীকার করুক আর না করুক এটাই এখন বাস্তবতা যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় নানা ক্ষেত্রে তাদের ভুল, ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। চারদলীয় জোটের সাফল্য আর জনপ্রিয়তায় নয়, আগামীতে যদি তারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় তা পাবে আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের ক্ষুব্ধতার কারণে। বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশ পরিচালনার যে নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে, সে কথাও দেশের মানুষ ভুলেছে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য। এ জন্য ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে আওয়ামী লীগকে।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে যা কিছু হচ্ছে তা দেশ ও জাতির জন্য রীতিমতো আশঙ্কাজনক।
তাকে কোনও অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ বলা যাবে না। এ মুহূর্তে কী হচ্ছে বাংলাদেশে? কী দেখতে পাচ্ছি আমরা?
দুর্নীতির অভিযোগে আটকে গেছে পদ্মা সেতুর কাজ। সরকার যতই চিৎকার করে বলুক ‘কোনও দুর্নীতি হয়নি’ মানুষ তা বিশ্বাস করছে না। কানাডার কোর্টে এ ব্যাপারে রায় বেড়িয়েছে। সেই রায় প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ওই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
এই দুর্নীতি বিষয়ে উইকিলিকস থেকেও বেড়িয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির অসম্মানজনক বক্তব্য। অথচ সরকার ওই মন্ত্রীকে এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রানালয়ের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। দেশটির নাম বাংলাদেশ আর সেদেশের সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ, এজন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখন ফাইলবন্দি। বলা যায়, এ তদন্ত থেমে গেছে।
কেন হত্যা করা হয়েছে সাংবাদিক দম্পতিকে তা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়েই রয়ে গেল। তদন্ত কাজে সরকারের অনীহা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয়বারের মতো ময়নাতদন্তের পরও তদন্ত কাজ এগোয়নি।
সম্প্রতি একটি দৈনিকের ফটো সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে পুলিশের নির্যাতন, সাংবাদিক শফিক রেহমানকে আদলতে নিয়ে ২ ঘণ্টা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে আভাসে ইঙ্গিতে তাকে ‘চোর’ বলা, টক-শোতে তৃতীয় শক্তি বিষয়ে একটি মন্তব্য করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুলকে সশরীরে আদালতে হাজির করা এ সব কিছুর মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। প্রথিতযশা আইনবিদ ও আমাদের সংবিধান রচয়িতা ড. কামাল হোসেন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ১৫০ বছরের ইতিহাসে নেই যে রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে বিবাদীকে আদালতে হাজির হতে হয়।
আপনারা একটি পক্ষ নিয়ে ফেলেছেন। ’ দেশের মুক্তচিন্তার মানুষগুলোকে কি সরকার ভয় দেখাতে শুরু করেছে? এমন ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করলে কে আর কথা বলবেন সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে? কে আর লিখবেন স্বাধীনতম মতামত? বাংলাদেশে কার এত বড় বুকের পাটা আছে? মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএনপিপন্থী দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থানার পুলিশ এমনভাবে নির্যাতন করেছে যে তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
রাস্তা থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলেন দেশের প্রধান বিরোধী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। তাকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হল সরকার। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কারো বেডরুম পাহারা দেবার দায়িত্ব সরকারের নয়।
’ তাহলে রাস্তা থেকে নিখোঁজ হওয়া মানুষকে গুম করল কারা? তার নিরাপত্তা দেবে কে? এখন দেশের মানুষ না বেডরুমে, না বাইরেÑ কোথাও নিরাপদ নয়। মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে প্রিয় স্বদেশ। বিচার বহির্ভূত হত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশ ও দেশের বাইরে এ হত্যাকাণ্ড নিন্দিত হলে, সমালোচিত হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী শুরু করেছে গুম সংস্কৃতি। মাজার থেকে অর্থ আত্মসাৎ করলে তার সাজা হয় কিন্তু মানুষ খুন করলে কিছুই হয় না।
এ সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মূল্যবোধটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। মানুষের মনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। বারবার দায়মুক্তি জাতির জন্য একটি ভয়ঙ্কর ম্যাসেজ।
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানাতে ঢাকা এসে সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে ফিরে গেলেন। পুলিশের নিপীড়নে নিহত হলেন মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক।
সরকারের পক্ষ থেকে একটি শোকবার্তা পর্যন্ত দেয়া হল না।
জনপ্রতিনিধি এখন পিস্তল দিয়ে গুলি ছুঁড়ছে জনতার ওপর। কোনও প্রতিকার নেই।
রাতের আঁধারে মন্ত্রীর বাসায় এখন বস্তা বোঝাই টাকা যায়। মন্ত্রী থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আগের মতোই তিনি আবার নানা রঙ্গ রসিকতা শুরু করেছেন। স্বপ্ন দেখছেন, হারানো মন্ত্রণালয় ফিরে পাবার। এ সরকার জনতার স্বপ্ন পূরণ না করলেও মন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করবে। এতে কোনও ভুল নেই। মন্ত্রীর নিজের তৈরি তদন্ত কমিটি মন্ত্রীকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও নিখোঁজ গাড়িচালকের বিষয়ে কোনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
আর কি কোনও গাড়িচালক কখনো সাহস করবে অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াতে?
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শুরু করেছে ছাত্ররাই। পরবর্তীকালে তাদের পাশে এসে রাজনীতিকরা তা বেগবান করে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। সেই ছাত্র রাজনীতিকেও কলঙ্কিত করেছে বর্তমান সরকার। বর্তমানে এ রাজনীতির আভিধানিক অর্থ ঠিক থাকলেও শাব্দিক অর্থের পরিবর্তন ঘটেছে।
এখন ছাত্র রাজনীতি মানেই সন্ত্রাস, মাস্তানি, টেন্ডারবাজি। ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেরা’ গোটা দেশ জুড়ে কায়েম করেছে সন্ত্রাসী রাজত্ব।
টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে বাংলাদেশের পানি প্রবাহ। তারা ইচ্ছে করলে যখন-তখন আমাদের বিস্তৃত ভূমিকে শুকনো মরুভূমিতে পরিণত করতে পারবে। আবার ভাসিয়ে দিতে পারবে বাঁধভাঙা জলরাশিতে।
এ ব্যাপারে সরকারের কণ্ঠের আওয়াজ উঁচু নয়। প্রথম থেকেই সরকার খুব নরম সুরে কথা বলছে। মহাজোট নেতা রাশেদ খান মেনন তো বলেই ফেলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টাদের কথা শুনলে মনে হয় তারা ভারতীয় সরকারের উপদেষ্টা। ’ সীমান্তে নির্বিচারে ভারতীয় রক্ষির গুলি চালানোরও কোনও তীব্র প্রতিবাদ করছে না সরকার।
নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে অপমানিত করেছে সরকার।
যেকোনও মুহূর্তে, যেকোনও দেশের রাষ্টপ্রধানকে ফোন তুলে কথা বলার ক্ষমতা বাংলাদেশে ওই একটি মাত্র মানুষেরই আছে। বিশ্বের যে ৫ জন মানুষ আগামী পৃথিবী কেমন হবে তার পরিকল্পনায় ব্যস্ত তার মধ্যে ড. ইউনূস অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের একেবারে নিচু পর্যায়ের নীতি-নির্ধারক পর্যন্ত এই আলোকিত মানুষটিকে নিয়ে অপ্রীতিকর সব কথা বলেছেন, অযৌক্তিক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন।
বিরোধী দলের ওপর সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন বেড়েই চলেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘তাদের কীভাবে সোজা করতে হয় তা সরকারের জানা আছে’ তখন বিরোধী দলের প্রতি সরকারের মনোভাবটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিরোধী দলের প্রধান নেতাদের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রেখে সরকার দেশ চালাচ্ছে।
সরকারকে এটা বুঝতে হবে, সরকার যখন দেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ বন্ধ করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখে তখন ক্ষমতার বাইরে থাকা শক্তি বাধ্য হয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারকে হঠাতে। তারা ভিন্ন পথে সরকার উৎখাতের পাঁয়তারা করে। না করে উপায়ও থাকে না। অতীতে বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটেছে।
এটা এখন স্পষ্ট যে, সরকার যেকোনও পন্থায় দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার জন্য নানা পরিকল্পনা শুরু করেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। এমতাবস্থায় অন্য পক্ষ বসে তামাশা দেখবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। তারাও ক্ষমতায় আসার জন্য নানা ফন্দিফিকির করবে। ষড়যন্ত্র করবে।
করছেও।
আওয়ামী লীগ যেহেতু এদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাই তাদেরকেই বিষয়টি বেশি করে ভাবতে হবে। আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপি বেশি দেশ দরদী এটা এখনও আমরা বিশ্বাস করি না।
পাদটিকা: যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রদূত যখন বলেন, বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু হচ্ছে তখন তাকে সহজভাবে দেখার কোনও কারণ নেই। আমরা সাধারণ জনতা খালি চোখে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে দেখছি না।
৩১ বছরের কূটনৈতিক জীবনে অভিজ্ঞ মজীনা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হচ্ছে বলে জানেন। কী হচ্ছে?
সুত্রঃ এইখানে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।