আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চায়ের রঙ যে কারণে রঙিন হয়

সকাল আর আসেনা গোলাপ হয়ে ফোটেনা কিশোরীর হাতে আমি ক্লাশ নিচ্ছি এমন সময় একটা ফোন। ফোন কেটে দিলাম। কিন্ত্ত আবার ফোন। হ্যালো কেন বলছেন? -কিতাবা বালানি? -হ্যা,কে বলছেন? -ভাই আমি উজ্জ্বল কইরাম আপনার দেশি। -ও আচ্ছা উজ্জ্বলদা বলেন তাড়াতাড়ি আমি এখন ক্লাশ নিচ্ছি।

-আপনি হাড়িয়ার সন্ধান কইরা দেন ভাই। আমার মামার গলা বইসা গেছে কোন কবিরাজ নাকি কইছে হাড়িয়া খাইলে ঠিক হইয়া যাইব। -আচ্ছা ঠিক আছে আমার একটা ছাত্র চা বাগানে থাকে তার কাছ থেকে জেনে তারপর বলি। সন্ধ্যায় আসেন। -কিন্ত্ত আপনার কেনো এমন মনে হলো যে আমি হাড়িয়ার সন্ধান জানি? -আপনি কাজের মানুষ ভাই আপনি কাজের মানুষ।

কাজের মানুষ দেখলেই চেনা যায়। সন্ধ্যায় লাক্কাতুরা চা বাগানে ঢুকতে না ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। বুনো গন্ধ চারদিকে। মৃদু বাতাস। শ্রমিক পল্লীতে বৈঠকঘরের চারদিক ছেলেমেয়েদের আনন্দমুখর হৈচৈ।

এমন নির্মল আনন্দ অনেকদিন পাইনা। সেই যে ছেলেবেলায় উঠানে ধানের স্তুপে ,খড়ের স্তুপে গড়াগড়ি খেতাম তেমন আনন্দ। চা বাগানে সন্ধ্যার সময়টাতে বসত পল্লীগুলো কেমন যেন রং ছড়ায়। আনন্দের,নেশার। দিনের বেলায় সুনসান নিরবতা।

প্রত্যেতে যে যার কাজে। একটা পাতার ঘরের সামনে লেখা 'পাঠশালা'। আমি পাঠশালা দেখি নি। এখানে পড়ালেখা কেমন হয় তাও জানিনা। একদিন এক ডাক্তারের চেম্বারে একজন মহিলাকে একটা অসুস্থ বাচ্ছা কোলে নিয়ে মাটিতে বসে থাকতে দেখে খুব খারাপ লাগলো।

টাকা পয়সা না পেলে যে রঙিন দুনিয়ায় চিকিৎসা হয়না মহিলা হয়ত সেদিন ভাল করে বুঝেছেন। আমাদের কিছু বাগানী ছেলেকে টেকনিক্যাল থেকে ট্রেনিং দিয়ে যখন চাকরি দিয়েছি তখন দেখা গেল ওরা কেউই কর্মক্ষেত্রে টেকসই হচ্ছে না। এরা আমাদের সভ্য সমাজের সাথে খুব একটা খাপ খাওয়াতে পারেনা। যখন দেখে তার চেহারা কালো,ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলে তখনই আমাদের সভ্য সমাজ ধরে নেয়'এদেরঠকানো যায়'। এদের বেতন তিনহাজার টাকা দেবার কথা থাকলেও মূলে এরা পায় পনেরশ টাকা।

এরা মুখ বুঝে থাকে কোন কথা বলেনা। প্রতিবাদ করতে এরা ভুলে গেছে। যেদিন চাবাগানে কাজ করানোর জন্য ইংরেজ সরকার এদেরকে রাতের অন্ধকারে চোখ মুখ বেধে নিজেদের বসত বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলো সেদিন তাদের যারাই প্রতিবাদ করেছে তারাই প্রাণ দিয়েছে। তাদের কেউ বাঁচতে পারেনি। যারা বাঁচতে চেয়েছে তারা কোনদিন প্রতিবাদ করেনি।

সেই থেকে তারা প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে। এদের ঘরে বিদ্যুৎ দেয়া হয়না। যাতে এরা টেলিভিশন দেখতে না পারে। লেখাপড়ার কোন সুযোগ দেয়া হয়না যাতে এরা সচেতন হতে না পারে। চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়না যাতে এরা বেশিদিন না বাঁচে।

যাতে বাগানের জনসংখ্যা একটুও প্রয়োজনের বেশি না হয়। চাবাগানের মানুষ খুব বেশি ধর্মপরায়ন। সবসময় চারদিকে পূজার ঢাকঢোল বাজে। এখানে আসলে বুঝা যায় যে ধর্ম সত্যিই একটা আফিম। চারদিকে নেশার ছড়াছড়ি।

কর্তৃপক্ষ এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে এখান থেকে যা পাচ্ছে যাতে এখানেই শেষ হয়। যেন গীতার সেই অমর বাণী- (তোমার কি হারিয়েছে যে তুমি কাঁদছো তুমি যা নিয়েছো এ্যখান থেকেই নিয়েছো যা দিয়েছো এখানেই দিয়েছো) সঞ্চয় করতে দেয়া যাবেনা। সঞ্চয় করলে ভালভাবে বাঁচার স্বপ্ন দানা বাঁধতে পারে। সুতরাঙ সেটা হতে দেয়া যাবেনা। তাই পূজা করে করে স্বর্গে যাও আর নেশা করে সিদ্ধি লাভ করো।

বেঁশি বেঁচে লাভ নেই। যত বাঁচবে তত পাপ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একপাশে সিগারেট টানছিলাম আর ভাবছিলাম। তারপর একটা ছোট ছেলেকে ডেকে নিয়ে উজ্জ্বলদের বাড়িতে যাই। যে আমার বাগানের ছাত্র।

নেশার আখড়া যে চা বাগান আমি উজ্জ্বলের কাছ থেকেই জানতে পারি। তার পাশে দাঁড়ালেই গাঁজার উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়। উজ্জ্বলকে পেয়ে হাড়িয়ার জন্য টাকা দিই দেড় লিটারের। আর বকশিশ ৩০ টাকা। সে হাসিমুখে আমাদেরকে একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে চলে যায়।

বলে যায় আপনারা এখানে আধ ঘন্টা অপেক্ষা করেন আমি আসছি। বসে বসে ভাল লাগছিলোনা। একটা ছোট ছেলেকে ডেকে কথা বলতে থাকি পিঠে আটার বস্তা। -এই ছেলে এদিকে এসো। নাম কি? -রুবেল।

(ভাঙ্গা বাংলা) -তোমার বাবা মা কি করেন? আমার মা চা বাগানে কাজ করে। বাবা হাড়িয়া বানায়। -আচ্ছা তোমারা কি বাসায় মা-বাবার সাথে বাংলায় কথা বলো? -না আমাদের ভাষায় । -তাহলে তোমাদের ভাষায় বলো যে তোমার মা চাবাগানে কাজ করে। -হিহিহি!মো মা চা বাগানে কাজ করচি।

তোমাদের এ ভাষাটার নাম জানো? -উড়িছা। (উড়িষ্যা) -তোমার মা প্রতিদিন কতটাকা পায় কাজ করে। -হাজিরা ৪০ করে আর সপ্তাহে ২.৫কেজি আটা। আমাদের হাতের মোবাইলটা দেখে বলে - একটা গান দিখাও। -আচ্ছা গান তোমাকে আমি শোনাবো চলবে।

-হিহিহি। চলবি। চলবি। শোনাও। ওরে কৃষ্ণ এদিকে আয় বাবু গান শোনাবে।

ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল। তোর দ্যাছের ঐ ছ্যামল গ্রাম,পাশে নদী অবিরাম কী দারুণ বয়ে চলে ,ছিলাৎ ছিলাৎ ঢেউ ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল। তোর দ্যাছের ঐ পাহাড়ে, ছোন্দর মেঘ আহারে! ছাদা ছাদা ছেঁড়া ছেঁড়া উড়ি উড়ি যায় ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল। তোর ছোন্দর দ্যাছে যাব ভালবেছে পোলা বুড়া ছকল ছাথে খেলিবরে ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল। তোর ঘরের কাছে ,বনের মো মো ডালে নানান পাখি চিউ চিউ গায় ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল।

ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে,ঢালু মাঠের আড়ে বছে হাত ধরে সুখের কথা কবরে ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল। এই ছহরের নীড়ে,মেকী রঙের ভীড়ে মন আমার ছয় নারে আর,না না না রে ফ্রো ফ্রো তোর দ্যাছে যাব ছঙ্গে নিয়ে চল। তা নানা নানা তানা নানা না। -কেমন লাগলো? -ভালো লাগলো। আরেকটা শোনাও।

-না তোমাকে আর শোনাতে পারবোনা। তুমি বরঙ পারলে আমাদের একটা শোনাও। তোমাদের নিজের ভাষায়। পারবে? একজন আরেকজনের দিকে তাকায় । কি যেন ভাবে তার মাথা নাড়ায়।

দ্বৈতকণ্ঠে আরম্ভ করে- ওরে পোন তিন তিন তিনতা তিঙকিঙতিনতা খোঁপাতলে গুজে দিলি ফুল গজোরা তোকে দেখে বায় হেলাম মন ভোমরা ওলেওলেওলে তারারারা তারারারা ওরেলাম মিন্দিয়া হায়কো বিন্দিয়া ঝমঝম পায়ে লিয়া গোরী। -আর পারিনা। -আরেকটা বলো। আবার একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। চল চম্পা চল পয়দল পয়দল এক নম্বর বাগানে পাতা তোলার কামলে বাবু সাহেব দেখলে ধুরায় দিবে চটলে নাই পাবি পুরা তেলব রে একটি কুড়ি দুটি পাতা আগে যায় অজন দিবি পুরা কাম কল্লে বোনাস পাবি ঢেল্লে পূজাতো আইসে গেলোরে।

(চল চম্পা চল পায়ে পায়ে চল এক নম্বর বাগানে পাতা তোলার কাজে বাবু সাহেব দেখলে রাগ করবে পুরো মজুরি পাবিনা একটি কুড়ি দুটি পাতা আগে গিয়ে হাজির হবি পুরো কাম করলে বেশি বোনাস পাবি পূজা যে এসে গেলোরে) আচ্ছা তোমার মা যে টাকা পায় তাতে চলে? সে বুঝতে পারেনা। তাদের চলে নাকি থেমে থাকে নাকি থমকে থাকে। বলি তোমরা বাহিরে গিয়ে কাজ করতে পারোনা? -বাবুরা শুনলে বাগানে থাকতি দিবি না। পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করে না? -বাবুরা জানলে রাগ করে। তবুও কেউ কেউ পলায় পলায় পড়ে।

ইংরেজ বেনিয়ারা এদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করেছে। কারণ এটা এদের দেশ ছিলো না। এরা এদের কেউ ছিলোনা। তারপর পাকিরা এলো এরা দাসই থেকে গেলো। এরা মানুষ হতে পারলোনা।

তারপর বাংলাদেশ হলো এরা যেমন ছিলো তেমনই রয়ে গেলো। এদের গায়ে হাজারো ক্ষত চিহ্ন। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দিতে গেলে বাগান থেকে লাভ করা দুরুহ ব্যাপার। তাই একদল মানুষকে আমাদের সভ্য মানুষের সেবার জন্য গিনিপিগ বানিয়ে রাখতে হবে? সারাবিশ্বের আনাচে কানাচে নির্য়াতিত মানুষের আসলেই কোন দেশ নাই। এদের একটাই পরিচয় এরা অন্যের সেবাদাস।

অত্যাচারিদেরও কোন দেশ নাই। সব কুত্তার বাচ্চার এক রা। এরা সব দেশে সব কালে একই রকম। সেটা হোক বাংলাদেশ হোক পাকিস্তান হোক ব্রিটেন। অনেক্ষণ অপেক্ষার পর আমার ছাত্রটা হাড়িয়া নিয়ে ফিরে আসে।

মুখে পান। শরীরে হাড়িয়ার গন্ধ। একটা বোতল ধরিয়ে দেয়। আমি দেখে বলি এখানে দেড় লিটার হবে? সে হেসে বলে-ছন্দেহ আছে! আমি মনে মনে বলি এটা কি কোন জীবন? কে যে বলে 'ছন্দেহ আছে!' আজকে এক কাপ রঙ চা আমার সামনে রাখতেই আমি চমকে উঠি। চায়ের রঙ এমন রক্তিম কেনো?কার রক্তে কাদের রক্তে।

এই রক্ত পান করে এত আয়েস!এই আয়েসে আমি তরল ছিটাই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।