পারবে আমায় বলতে কোথায় ঐ দূর আকাশের শেষ কিংবা আমায় এনে দিতে নতুন সোনার বাংলাদেশ অনার্স মাষ্টার্স পাশ অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ভুরি ভুরি । কিন্তু বৈশ্বয়িক অগ্রগতিতে এই উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠির অবদান অতি নগন্য । সেই সাথে এত উচ্চশিক্ষিত মানুষ থাকার সত্ত্বেও দেশের কাঙ্কিত অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে না । এছাড়া বাংলাদেশে অনার্স মাষ্টার্স পাশ করে অনেকের এমন এমন চাকরি করতে বাধ্য হয় যা করতে এসএসসি পাশই যথেষ্ট । ।
তাই এই পথের একজন যাত্রী হিসেবে এক্ষেত্রে আমি বেশ হতাশাবাদী । ।
মুল বিষয় হল বাংলাদেশের পরিপেক্ষিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা অনেকটা "জ্ঞান বিতরন" কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে । । অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানের অনুশীলন,জ্ঞানের প্রচার- প্রসার, তদুপরি জ্ঞানের অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের মনষ্তাত্বিক জগতকে এমনভাবে তৈরী করা যাতে সে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, সেই সাথে যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে সমাজের অগ্রগতিতে অংশগ্রহন করে পারে ।
। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘটছে উল্টো ঘটনা । । অনেকটা সার্টিফিকেট নির্ভর , গবেষনাবিমুখী এবং গতানুগতিক এক ধরনের জগাখিচুরী মার্কা শিক্ষায় আমরা শিক্ষিত হচ্ছি । ।
আমাদের দেশের মেধাবীরা যখন ছোট বেলা হতেই বুয়েট,মেডিক্যাল কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন লালন করে বড় হয় তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্হানও বেশ নাজুক । আন্তর্জাতিক Ranking এ বুয়েটের অবস্হান ২৪১৫ তম , আর ঢাবির অবস্হান ৩৮৬১ তম ; মজার বিষয় হল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এই ranking খুজেঁও পাওয়া যায় নি । । আসলে এই Ranking দিয়ে কি বোঝায় ?? Ranking গুলো আসলে করা হয় মূলত বিশ্বদ্যালয়ের মৌলিক গবেষনা এবং এই গবেষনার ফলাফল বিশ্বের অগ্রগতিতে কেমন ভুমিকা রাখছে তার উপর । ।
অতএব Ranking এটিই বলে দিচ্ছে বৈশ্বয়িক অগ্রগতিতে আমাদের দেশের ভুমিকা বেশ নাজুক । । বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারন হতে পারে । । এমন হতাশাব্যাঞ্জক অবস্হানের পেছনে মুল কারন হল উচ্চশিক্ষার পদ্ধতি,প্রাতিষ্ঠানিক দুবর্লতা এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাব ।
প্রথমত, পাশ্চাত্যের মত আমাদের শিক্ষা নয়, আমাদের প্রেজেনটেশন দিতে হয় না, নতুন এসাইমেন্ট করতে হয় না, সহ শিক্ষা বলতে কিছুই নেই । বরঞ্চ দুইচারটা শিট গিলে, ল্যাব খাতা কপি পেষ্ট করে উচ্চশিক্ষিতের তকমা কপালে লাগাতে পারি । । আরো উদ্বগের বিষয় হলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি করলেও চার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবীর পাশাপাশি উপহার দেয় কতগুলো "শিক্ষিত সন্ত্রাস" আর প্রাইভেট বিশ্বিবিদ্যালয় উৎপাদন করছে একজাতীয় কিছু "হাইব্রিড শিক্ষার্থী" । ।
দ্বিতীয়ত, আসা যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে, এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো মেধাবীদের আশা আঙ্কাকার প্রতীক হলেও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ,রাজনৈতিক কলকাঠি , পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদাসীনতার কারণে কাঙ্কিত সামগ্রীক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয় না । । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সাড়া বছর ক্ষেপ মারার কাজে ব্যস্ত, অনেক ছুটি নিয়ে করেন প্রাইভেটে শিক্ষকতা,অনেকে উচ্চতর ডিগ্রীর নামে ঘুরে বেড়ান দেশে দেশে ; তখন নিজের প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির চিন্তা করার সময় কোথায় আর ছাত্রদের নিয়ে গবেষনা করারই বা সময় কোথায় ?? তবে এই কথাও সত্য যে উনারা প্রাইভেটে ক্লাশ না নিলে এইখানকার শিক্ষার্থীরা আমাদের মত শিক্ষাখরায় ভোগত । । ব্যর্থতার কারণ খুজঁতে গেলে অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু জাতীয় রাজনীতি হতে শিক্ষাঙ্গনকে দূরে না রাখা গেলে, সেশনজট দূরীভুত করা না গেলে এবং শিক্ষকরা গবেষণামুখী না হলে সমাধান খুজেঁ পাওয়া দুঃষ্কর হবে ।
আর রীতিনীতি তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলে শিক্ষাকে পন্য হিসেবে ব্যবহার করাটাও উচ্চশিক্ষার মান অবনমের অন্যতম প্রধান কারণ । । আগে কিছু মানুষের অল্প টাকা হলে একটা কোচিং সেন্টার দিত, এরপর দিত কেজি স্কুল আর এখন এই টাকা ইনভেষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার মাধ্যমে । । যে দেশে ভবনের নিচ তলায় দোকান কিংবা ফিলিং স্টেশন, ২/৩ তলায় বিশ্ববিদ্যালয় আর তার উপর ফ্ল্যাটবাসা সে দেশের উচ্চশিক্ষিতরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অবাক করার মত নয় ।
। ১৯৯২ সালের পর এদেশে ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এবং অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে নির্দিধায় !! এমন অবস্হায় দেশে মোট শিক্ষিতের যখন ১৮% উচ্চশিক্ষিত তখন বলতেই হয় "আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু মান কমে যাচ্ছে সমানুপাতিক হারে" ;এসব কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আমার মত হয়ত অনেকের মনে হতাশার বীজ অঙ্কুরীত হয়ে কবিতার চরণগুলো আপন বনে যায় ...
"ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !"
তৃতীয়ত, একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্হার মূল ভিত্তি হল শিক্ষক । কিন্তু বর্তমান সময়ে এই ভিত্তিটি বেশ নড়বড়ে অবস্হায় আছে । । বর্তমান সময়ে অনুকরনীয় বা অনুসরনীয় শিক্ষক বিলুপ্তই বলা চলে ।
শিট দেখে দেখে ক্লাস নেয়া, দুইচার প্রশ্ন লিখে দিয়ে ক্লাস শেষ করা, কোচিং সেন্টার স্টাইলে নোট দেয়া এসবের কোনটাই একজন আদর্শ শিক্ষকের গুন হতে পারে না । আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই স্যার হতে এইখাতাটা,বা এই শিটটা কিংবা ল্যাপটপের এই ফাইলটা চুরি করে ফেললে মনে হয় তিনি আর ক্লাস নিতে পারবেন না । আসলেই অনেকক্ষেত্রেই তাই । আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক দেখে এসেছি স্কুলের প্রণতোষ স্যার কিংবা কলেজের কয়েকজন স্যার ; যা এখন কেবলই ইতিহাস।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে UGC এর নিয়মের তোয়াক্কা না করা, মৌলিক গবেষণা বা প্রজেন্টেশন স্কিলে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল মুখস্ত করে অর্জন করা CGPA দেখে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া মানসম্মত শিক্ষকের অভাবের প্রধান কারণ ।
। এছাড়া বেশীর ভাগ শিক্ষকই প্রোফেশনাল না বরঞ্চ দিন গুনে সিলেবাস শেষ করতে পারলেই তারা যেন হাফ ছেড়ে বাচেঁন । এছাড়া আজকের শিক্ষকরাই তৈরি করে দিবে আগামী দিনের শিক্ষক তথা বর্তমান সময়ের ছাত্রদের । । কিন্তু তাদের বর্তমানের ব্যর্থতা চক্রাকারে যোগ্য শিক্ষকের অভাবকে আরো ত্বরান্বিন করবে ।
। আমার দৃষ্টিতে সবসময়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পেশা হল শিক্ষকতা ! ইনারায় এক একটা মানুষের,এক একটা প্রজন্মের পরিপূর্ণ স্বপ্নদ্রষ্ট্রা । চরম হতাশ,দিশেহারা মানুষকেও জীবনের নতুন কোন অর্থ খুজেঁ দিতে পারে শিক্ষকরা, আর কেউ নয় । কিন্তু একজন ব্যর্থ শিক্ষকের পক্ষে এসবের কিছুই করা সম্ভব হয় না যেকারণে তৈরী হচ্ছে না যোগ্য মানুষ কেবল উৎপাদিত হচ্ছে নামেমাত্র শিক্ষিত জনগোষ্ঠি । ।
এছাড়া গনহারে পাশের হার কিংবা ভুরি ভুরি A+ শিক্ষার মান কোনক্রমেই উন্নত করছে না বরঞ্চ শিক্ষাকে ক্রমেই নিয়ে যাবে অনিশ্চিত কোন সংকটে । যে জালে কোন মাছই আটকাই না, ঐ জাল দিয়ে করবটা কি?? ঠিক যে পরীক্ষা কোন ছাত্রকে আটকাতে পারে না সেই পরীক্ষা কি করে মেধা যাচায়ের মাধ্যম হয় ? তাই ভাল শিক্ষকের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মান্নোয়নে ভাল ছাত্রেরও বিকল্প নেই । ।
পরিশেষে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান্নোয়নে কয়েকটা সুপারিশ আছে আমার । এগুলো হল :
(১) উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে প্রথমই দরকার এমন শিক্ষক যার সমন্বিত ভাবে একাডেমিক ফলাফল আগাগোড়া ভালো, যিনি গবেষনা করতে পারেন, যার আউটপুট গ্রহনযোগ্য এবং যার নিয়োগ অস্থায়ী নয় ।
(২) উচ্চশিক্ষার আরো দরকার এমন ছাত্র যাদের সবাই বা অধিকাংশ পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে তবে এক্ষেত্রে বর্তমানের ভুরি ভুরি A+ উদ্বেগজনক ।
(৩) কোর্স কারিকুলামের পাশাপাশি কোর্স কারিকুলাম কিভাবে পড়ানো হয় তারও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে ।
(৪)ব্যাঙের ছাতারমত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুনগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে UGC কে কঠোর হতে হবে । ল্যাবফ্যাসিলিটি,ল্যাব এক্সপার্ট উপযুক্ত হতে হবে এবং যুগোপযোগী প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে ।
(৫) জাতীয় রাজনীতি হতে শিক্ষাঙ্গনকে দূরে রাখতে হবে , সেশনজট দূরীভুত করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়-কোম্পানীর মধ্যের সরাসরি সম্পর্ক স্হাপন করে চাকুরি ও গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে ।
। তাহলেই হয়ত পেয়ে যেতে পারি জাতীর কাঙ্কিত উচ্চশিক্ষিত মানুষ । ।
আমরা চাই না, আমাদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নের প্রতিফলন অনাকাঙ্কিত হোক । আমরা চাই না , আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস,ক্যাম্পাস আর করিডোরে অবহেলায় কাটুক আমাদের সোনালী ভবিষ্যত ।
সবশেষে জয় হোক সকল স্বপ্নবিলাসী শিক্ষার্থীর, জয় হোক মননশীলতার ,জয় হোক মনষ্তাত্বিক জাগরনের। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।