ভালো।
সারাদেশে ক’দিনে লোডশেডিংয়ের গড় ৮ ঘণ্টার বেশি। কিছু কিছু এলাকায় এর মাত্রা আরও বেশি। গ্রামে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ দৈনিক ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা। মধ্যরাতেও এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
অবশ্য কিছু ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক ঘণ্টার জন্যও লোডশেডিং হয়নি। এছাড়া গোপালগঞ্জের অন্য এলাকায় দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হয় না। একই অবস্থা অর্থমন্ত্রীর নির্বাচনী আসন সিলেট সদর, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর নিজের এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের চিত্র। আর ভোলা লোডশেডিংমুক্ত শহর।
ভোলায় বাড়তি বিদ্যুৎ থাকার পরও নানা কারণে জাতীয় গ্রিডে দেয়া যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৪ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৪৭ মেগাওয়াট। ৩৫৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। অনেকের মতে, পিডিবির এই তথ্য ঠিক নয়।
চাহিদা আরও অনেক বেশি। কিন্তু পিডিবি চাহিদা কম দেখিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে এমন জাহির করতে ব্যস্ত।
বিদ্যুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, লোডশেডিং মঙ্গলবার থেকে কমে যাবে। মধ্যরাতে আর লোডশেডিং হবে না।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই ভয়াবহ লোডশেডিং হচ্ছে।
কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। এ কারণে আবাসিক গ্রাহকদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকের বাসার ফ্রিজ, টিভিসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
উত্তরা ৪নং রোডে শনিবার রাত ১২টা থেকে পরদিন রাত ১২টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় তার বাসায় লোডশেডিং হয়েছে ৭ ঘণ্টা। কল্যাণপুরের পীরেরবাগে রাত ১২টা থেকে পরদিন সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়।
মাদারটেকের হীরাঝিল আবাসিক এলাকায় রোববার থেকে ২৪ ঘণ্টায় মোট ১০ বার লোডশেডিং করা হয়। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই লোডশেডিংয়ের এই অবস্থা।
শহরের চেয়ে আরও খারাপ অবস্থা গ্রামের। গ্রামের বাসিন্দাদের বক্তব্য হচ্ছে, কখন বিদ্যুৎ যায় এমন প্রশ্ন করা ঠিক নয়। করতে হবে কখন বিদ্যুৎ আসে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগরের বাশারুক গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, রোববার সারাদিন বিদ্যুৎ ছিল না। মাঝে আধা ঘণ্টা করে দুইবার ছিল। আর রাত ১১টার পর বিদ্যুৎ এলেও ভোর চারটার সময় আবার চলে যায়। একই কথা জানালেন পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলার বেতুয়ান গ্রামের বাসিন্দা গোলাম মোস্তাফা। তিনি জানান, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, রাত ১২টার আগে বিদ্যুৎ আসে না।
আর যখন আসে থাকে মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা।
সারাদেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভয়াবহ হলেও কয়েকজন মন্ত্রীর এলাকায় কোন লোডশেডিং নেই। গোপালগঞ্জ পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় এক ঘণ্টার জন্যও বিদ্যুৎ যায়নি। এলাকাটি বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়ায় লোডশেডিং করা হয় মাত্র দিনে-রাতে দুই ঘণ্টা।
বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের নির্বাচনী এলাকা মুকসুদপুরেও একই অবস্থা। দিনে-রাতে মাত্র দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। তবে কাশিয়ানির পরিস্থিতি ভিন্ন। কিছুদিন আগে এই থানার জনগণ বিদ্যুতের জন্য রাস্তায় নেমে আসে।
অর্থমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা সিলেট সদরে কোন লোডশেডিং নেই।
তবে মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের যে সমস্যা হয় তা কেবল যান্ত্রিক ত্র“টির জন্য হয়ে থাকে। জানা গেছে, সিলেটের সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও সদর এলাকায় বিদ্যুতের লাইনের মেরামত করতে পিডিবি সম্প্রতি একশ’ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু সিলেটের অন্য অঞ্চল দিনে-রাতে লোডশেডিংয়ের মধ্যে ডুবে থাকে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের শাহবাজপুর ইউনিয়নে কয়েক মাস আগেই এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হতো। সম্প্রতি এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ওই এলাকায় লোডশেডিং করা হয় দুই ঘণ্টা।
শিবগঞ্জ ছাড়া চাঁপাইয়ের অন্য থানার পরিস্থিতি খারাপ হলেও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কোন নজর নেই।
এদিকে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ১১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ও ইউনিটের মধ্যে ৬৪টি কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এর মধ্যে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন জ্বালানি সঙ্কটে বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া এক হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যান্ত্রিক ত্র“টিতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড আওয়ামী লীগের : বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির রেকর্ড সব সময় আওয়ামী লীগের ঘরেই। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাতবার, বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে একবার ও সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। ১৯৯৮ সালের মার্চে আবার দাম বাড়ানো হয়। এর পরের বছর জুলাইতে এবং সেপ্টেম্বরে আবার দুই দফা দাম বাড়ানো হয়।
২০০০ সালের মার্চে এবং একই বছরের নভেম্বরে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলের মতো বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে চারবার বাড়ানো হয়েছে। প্রথমবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পায় ২০১০ সালের মার্চে, ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারিতে আবারও দাম বাড়ানো হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে দাম বৃদ্ধি করে সরকার। সর্বশেষ ২০১২ সালের এক ফেব্র“য়ারি বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার কার্যকর করা হয়।
দুর্নীতির কারণে লোডশেডিং : সরকারের দূরদর্শী কোন পরিকল্পনা না থাকায় ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং পরবর্তীকালে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার বিষয়টি সরকারের অপরিকল্পনার বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়। তারা বলেন, অপরিকল্পনার সঙ্গে দলীয় লোকদের দ্বারা এই খাতে সীমাহীন দুর্নীতিও লোডশেডিংয়ের অন্যতম কারণ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভুঁইয়া বলেন, লোডশেডিং হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
কিন্তু চাহিদাও বেড়ে গেছে। এই কারণে আমরা বিদ্যুৎ দিতে পারছি না। ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, লোডশেডিং আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। তবে আগামী বছরের শেষে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা সহনশীল হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ৫ বছর লাগবে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা কেমন হবে এ বিষয়ে সরকারের কোন আগাম তথ্য নেই। আর এ তথ্য না থাকায় সরকারের কথা অনুযায়ী যদি তিন হাজার মেগাওয়াট বাড়ানো হয়ে থাকে, তাহলেও লোডশেডিং থাকবে। কারণ চাহিদার তথ্য সরকারের কাছে নেই। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা কেমন হবে এ নিয়ে বাংলাদেশে কোন কাজ হয়নি।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, মহাজোট সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন নির্মাণকে একটি প্রকল্প হিসেবে নিয়ে যে লুটপাট করেছে, তার বিপরীতে বিদ্যুৎ দিতে না পারার কারণে লোড ম্যানেজমেন্টের নামে এদেশের উৎপাদনশীল শিল্প খাতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, কাগুজে-কলমে তিন হাজার মেগাওয়াট যে বলে তা ঠিক আছে। গোলমাল মাঠে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেগুলো চালু হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই উৎপাদন ক্ষমতার চাইতে কম উৎপাদন করছে। ফলে লোডশেডিংয়ের মধ্যে আমাদের চলতে হচ্ছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।