আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তালেবানি দাবি সভ্যতা ও সংবিধান পরিপন্থী

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। বাংলাদেশ একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। গেল ৪২ বছরে রাষ্ট্রের মৌল অস্তিত্বের ওপর এমন সংঘবদ্ধ আঘাত আগে কখনও আসেনি। আগে যারা নানা যুক্তিতর্কে মানতে চাননি যে, একাত্তরের পরাজিত শক্তি কোনোদিন আঘাত হানতে পারে, আজ মর্মে মর্মে তারাও বুঝেছেন, তাদের উপলব্ধি কতটা ভুল ছিল। তবে জামায়াতে ইসলামীর সহিংস রাজনীতিচর্চার মাঝেও হেফাজতে ইসলাম নামের নবগঠিত সংগঠনটি আলোচনায় বেশ জায়গা করে নিয়েছে।

বিশেষ করে ৬ এপ্রিল তাদের লংমার্চ এবং সুবিশাল ঢাকা সমাবেশের পর থেকে। হেফাজত অধুনা-পরিচিত হলেও তাদের ১৩ দফা দাবি ইতিমধ্যে দেশবাসীর নজর কেড়েছে। এসব দাবি নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। এমন প্রশ্নও উঠেছে, এসব দাবি তুলে মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি আসলেই কোথায় নিতে চায় বাংলাদেশকে? হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতে বলা হয়েছে_ আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করতে হবে। রাসূলের (সা.) কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ 'কথিত শাহবাগি' আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী 'নাস্তিক-মুরতাদ'দের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

বল্গগ কী, কীভাবে তা পরিচালিত হয় ইত্যাদি দেশের কতভাগ মানুষ জানে তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। শাহবাগ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা সবাই বল্গগে লেখেন, এমনটাও নয়। তবে এদের মধ্যে যদি কারও কারও বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ইসলামবিরোধিতার অভিযোগ আসে, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনেই তার তদন্ত ও প্রমাণসাপেক্ষে বিচারের কথা আসবে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে। বিশেষ ধর্ম অবমাননার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রবর্তনের দাবি সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ও নাগরিক সমধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

উলেল্গখ করা যেতে পারে, পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করে 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার'_ এই চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, রচিত হয়েছিল এ রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধান। জাতির দুর্ভাগ্য, সামরিক ফরমানের বলে সে সংবিধান কর্তন করা হয়েছিল, যা উচ্চ আদালতের রায়ে সম্প্রতি আবারও ফিরে এসেছে। হেফাজত তাদের ভাষায়, 'ইসলামবিরোধী নারীনীতি' ও 'ধর্মহীন শিক্ষানীতি' বাতিল করা এবং তাদের ভাষায়, 'ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ' ইত্যাদি বন্ধের দাবি তুলেছে। দেশের নারী সম্প্রদায় ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ যেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি সমধিকার ভিত্তিক প্রগতিশীল নারীনীতি এবং অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতির জন্য আন্দোলন করে আসছে, সেখানে এ ধরনের দাবি কেবল প্রতিক্রিয়াশীলই নয়, একই সঙ্গে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের নারী সমাজ আজ পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে, প্রতিটি পেশায় জায়গা করে নিচ্ছে, অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে তারা আবির্ভূত হয়েছে।

কাজেই হেফাজতের দাবি মেনে নারীদের নতুন করে গৃহবন্দি করার সুযোগ কোথায়? ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর সব ভাস্কর্য (হেফাজতের ভাষায় মূর্তি) অপসারণ ও মোমবাতি প্রজ্বালন নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব দাবি যে কোনো বিবেচক মানুষকেই তাড়িত করবে। সবাই প্রশ্ন তুলবেন, বাংলাদেশকে তারা কোন অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়? তারা কি আফগানিস্তানের মতো একটি তালেবানি রাষ্ট্র চান, নাকি পাকিস্তানের মতো? তাদের আরও একটি দাবি হচ্ছে, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। এ কাজটি কখনোই রাষ্ট্রের নয়। তাদের দাবি, মসজিদকেন্দ্রিক রাজনীতি অবারিত করা।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের এমন একটি মসজিদও কি আছে যেখানে মুসলি্লরা নামাজ পড়ার অধিকার রাখেন না? তাহলে এমন দাবির যৌক্তিকতা কী? তাদের ভাষায়, 'প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ' করার দাবি তুলেছে হেফাজত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব দাবিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে সাম্প্রতিক জামায়াত-শিবিরের সহিংস তৎপরতার প্রতি হেফাজতের সুস্পষ্ট সমর্থন জানান দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের দাবিতে নাটক-সিনেমায় 'ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা বন্ধের' দাবি তুলেছে হেফাজত। আমার বিশ্বাস, নাটক-সিনেমার তৈরি চরিত্রগুলো সম্পর্কে সম্যক না জেনে বা বুঝেই এমন দাবি তোলা হয়েছে। বরং এ দাবি মানা হলে বাংলাদেশ শুধু তার আধুনিকতাই হারাবে না, একই সঙ্গে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা মুখ থুবড়ে পড়বে।

সাধারণ বিশ্লেষণেই দেখা যায়, হেফাজতের ১৩ দফার প্রধান এবং বেশিরভাগ দাবিই বাংলাদেশের রক্তার্জিত সংবিধান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং পরিপূর্ণভাবে পরিপন্থী। এসব দাবি অগ্রসর-আধুনিক বাংলাদেশ তৈরির আকাঙ্ক্ষাবিরোধী। এসব দাবি আদায়ের আন্দোলনকে যারা সমর্থন করতে চান, তাদের ভেবে দেখতে হবে, তারা কোন বাংলাদেশ চান? যে দেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, ৪ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, লাখ লাখ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন, সেই বাংলাদেশে এ ধরনের দাবি উত্থাপনের সুযোগ আছে কি-না, সেটিও ভেবে দেখতে হবে। এদিকে বল্গগে ইসলাম ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য বা কটূক্তি করার অভিযোগে চার তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি বল্গগও বন্ধ করা হয়েছে।

আমি মনে করি, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অধিকার কেউ রাখেন না। কেউ যদি তা করেন তা দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এর জন্য প্রয়োজন অপরাধকর্মের যথার্থ প্রমাণ, বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নয়। শাহবাগের নতুন প্রজন্মের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এরই মধ্যে দুই মাস অতিক্রম করেছে। এ আন্দোলনের মূল দাবি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা।

দেখা গেছে, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় না গিয়ে এর উদ্যোক্তাদের ঢালাওভাবে 'নাস্তিক', 'ইসলামবিরোধী' আখ্যা দিয়ে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি অপপ্রচারে নেমেছে। এর সঙ্গে যোগ হলো হেফাজতে ইসলাম। প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে যে, জামায়াত-শিবিরের বেপরোয়া হিন্দু মন্দির-প্রতিমা ভাংচুর-অগি্নসংযোগ কিংবা এর আগে শতবর্ষী বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংসের ঘটনায় ধর্ম অবমাননার দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়েছে কি-না। ধর্ম অবমাননাকারীর ব্যাপারে নিশ্চয় সরকার ব্যবস্থা নেবে। তবে অপরাধী চিহ্নিত হতে হবে আইনানুসারে, যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে।

ঢালাও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কাউকে আটক করে প্রমাণের আগেই অপরাধী সাব্যস্ত করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। এতে করে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথ রুদ্ধ হবে। হেফাজতের বেশিরভাগ দাবিই বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান পরিপন্থী। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব দাবি মেনে নেওয়া হলে বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি নতুন তালেবানি রাষ্ট্রে।

এসব দাবি বাঙালি জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপরই কেবল আঘাত নয়, দেশের অর্থনীতির ওপরও সুপরিকল্পিত আগ্রাসন। এসব দাবি মানা হলে জাতীয় উন্নয়নের চাকা বন্ধ হবে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বিপন্ন হবে, জাতিকে ফিরে যেতে হবে মধ্যযুগের অন্ধকারে। এই যুগে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দাবি কেউ আশা করে না। এসব দাবি মানা হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা মূল্যবোধ আর আদর্শ থেকে বাংলাদেশ বিচ্যুত হবে। হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রতিটি দাবিই একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

কাজেই এসব দাবিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হেফাজতের সমাবেশে নারী সাংবাদিকদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, আফগানিস্তান-পাকিস্তানের তালেবানরা নারীদের যেমন পশ্চাৎপদ করে ফেলেছিল, বাংলাদেশেও ঠিক তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। বলাই বাহুল্য, এসব দাবি মেনে নিলে সমাজের প্রগতিশীলতা রুদ্ধ হবে, নারীদের ফিরে যেতে হবে যার যার ঘরে। ঠিক যে সময়ে ৪০ লাখ নারী শ্রমিক দিনান্তের শ্রম ও মেধা দিয়ে, পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, নিজেদের ও তাদের পরিবারকে সচল রাখছেন, সে সময়ে এসব দাবি ভয়ঙ্কর বৈকি। কাজেই এসব দাবির সঙ্গে আপসের কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের নারীরা হিমালয় জয় করছেন, আর হেফাজত চায়, নারীকে গৃহবন্দি করতে! ১৩ দফা যদি মানতে হয়, তাহলে সব নারীকে, এমনকি যারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে আছেন, তাদেরও বোরখা পরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রাজনীতি ছেড়ে বোরখা পরে ঘরে ফিরে যেতে হবে। এদের প্রতিটি দাবিই মৌলবাদী চিন্তাচেতনার ফসল, দেশকে আইয়্যমে জাহেলিয়ার যুগে ফিরিয়ে নেওয়া ষড়যন্ত্র। সুত্র  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.