নারীনীতি বাতিলসহ নারীদের অবরুদ্ধ রাখার কথা বললেও হেফাজতে ইসলাম নারী ও ইসলামকে নিয়ে রাজনীতি করছে। জামায়াত-শিবিরের একটি নতুন রূপ হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। গত শনিবার সমাবেশ থেকে হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছে তা সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। তাদের ১৩ দফা দাবি দেশকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র।
গতকাল একুশে টিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপর হেফাজতে ইসলামের হামলার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত নারী সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, কর্মজীবী নারী, বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে নাদিয়া শারমিনসহ গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হেফাজতে ইসলামের হামলার ঘটনায় এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে উল্লেখ করে হেফাজতে ইসলামকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। শীঘ্রই শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করে নারী সমাজ হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবে বলেও জানানো হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ডাকসুর সাবেক ভিপি কেন্দ্রীয় খেলাঘরের চেয়ারপারসন মাহফুজা খানম, মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী, জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য শিরিন আখতার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদা ভাট্টি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রোকেয়া প্রাচী, গণজাগরণ মঞ্চের সেস্নাগান কন্যা শারমিন আক্তার লাকি, জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের নাসিমা আক্তার জলি, বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরি গাইন, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জুবায়েদা নাসরিন কনা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু প্রমুখ। সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাংবাদিক শাহ-আলমগীর, মাহমুদুর রহমান বাবু, কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে তারা সংহতি প্রকাশ করেন।
মাহফুজা খানম বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৪২ বছর পরও যারা বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি, যারা যুদ্ধাপরাধী ও জামায়ত-শিবিরকে রক্ষা করতে সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাদেরই একটি নতুন রূপ হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। তাদের দাবি সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। যারা বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে সেস্নাগান দিয়েছে 'তোমার আমার ঠিকানা মক্কা মদিনা' তাদের ঠাঁই বাংলার মাটিতে হবে না। তাদের ১৩ দফা প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সব অর্জনকে ধূলিস্যাৎ করবে।
তাই তাদের একটি দাবিও নারী সমাজ মেনে নেবে না।
গত শনিবার বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি সরাসরি এবং খাদ্য, পানি দিয়ে হেফাজতের সমাবেশে সংহতি জানিয়েছে তাদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে সাবেক এই ডাকসু নেতা বলেন, যারা এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন তাদের প্রতি ধিক্কার জানাই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিল, হেফাজতের সমাবেশের ধিক্কার জানানো। কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি হেফাজতে ইসলামকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করতে পারলেও শাপলা চত্বরে কেন ১৪৪ ধারা জারি করলেন না?
নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার দাবি করে মাহফুজা খানম বলেন, অন্যথায় নারী সমাজ লাখ লাখ নারীকে এক করে সমাবেশ করবে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, গত শনিবারই দেশের জনগণ হরতাল পালনের মধ্যদিয়ে হেফাজতের ১৩ দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা সুপরিকল্পিতভাবে নারীদের নিগৃহীত করার জন্য মধ্যযুগীয় কায়দায় দেশ পরিচালিত করতে চায়। তারা বাংলাদেশকে মোল্লা ওমরের তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ও ১৮ দলীয় জোটের প্রতি নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, আত্মস্বীকৃতি ভুলে খালেদা জিয়া হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংহতি জানিয়েছেন। তিনি পুরো নারী সমাজকে অবমাননা করেছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নারী হিসেবে আমরা তাকে সম্মান করি। এখনও সময় আছে তিনি তার সেই অবস্থান থেকে সরে আসুন এবং মুক্তিযুদ্ধে স্বপক্ষের শক্তিকে সহযোগিতা করুন।
শিরিন আখতার বলেন, অনতিবিলম্বে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা বাতিল করতে হবে। তাদের এসব দাবি অবৈধ। কারণ, এসব দাবি স্বাধীনতা, সংবিধান ও নারী অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মাসুদা ভাট্টি বলেন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তারও ভোটার। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠী ও ভোটারকে ঘরে বন্দী রেখে কোন রাজনীতিই সম্ভব নয়। যে শাপলা চত্বরে দাঁড়িয়ে হেফাজতে ইসলাম নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার কথা বলেছেন_ সেখানকার ঘাসও বোঝে নারীকে অবরুদ্ধে রেখে অর্থনীতি ও দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। কিন্তু হেফাজতের বেকুবরা তা বোঝে না।
নারীকে নারী নয়, মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে।
রোকেয়া প্রাচী বলেন, ১৩ দফা যদি মানতে হয়, তবে সেনাবাহিনীতে যে নারী সদস্যরা রয়েছেন, তাদেরও বোরখা পরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রাজনীতি ছেড়ে বোরখা পরে ঘরে ফিরে যেতে হবে।
যেসব গণমাধ্যমে গত শনিবার গণমাধ্যম কর্মীর ওপর হামলার ফুটেজ রয়েছে সেগুলো জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি ওইসব ফুটেজ দেখে অপরাধীদের গ্রেফতার করার দাবি জানান।
শারমিন আক্তার লাকি বলেন, আজ নারীরা হিমালয় পর্বত জয় করছেন।
আর হেফাজত চায় নারীকে গৃহবন্দী করতে। দেশের উন্নয়ন নারীর হাত দিয়ে এসেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারী। সুতরাং ১৩ দফা দাবি বাতিল করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম আজ জামায়াতে ইসলামে পরিণত হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে সব নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করে লাকি বলেন, ধিক্কার জানানোর পরিবর্তে তিনি হেফাজতে ইসলামকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তার বক্তব্য ন্যক্কারজনক। হেফাজতের কর্মসূচি প্রতিহত করতে শাহবাগের গণসমাবেশের আন্দোলনকে আরও বেগবান করা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে এবং সংবিধান পরিপন্থি ও নারী উন্নয়ন নীতিবিরোধী তাদের সব দাবির প্রতিবাদে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে মহিলা পরিষদ।
গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে নগরীর জিরোপয়েন্ট হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে প্রতিবাদ মিছিলটি শেষ হয়। পরে সেখানে মানববন্ধন করে। মানববন্ধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রী ফওজিয়া মোসলেম, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, সাংগঠন সম্পাদক রাখী দাস পুরকায়স্থ, সহ-সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহান বেগমসহ সংগঠনের নেতারা। মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
গতকাল সকালে অপরাজেয় বাংলাদেশের পাদদেশে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ চলাকালে নাদিয়া শারমিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।
এ সময় 'বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও নাদিয়া শারমিনসহ গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হেফাজতে ইসলাম ও মৌলবাদীদের পৈশাচিক হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ' শিরোনামে কালো ব্যানার বহন করা হয়। মানববন্ধনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কালোব্যাজও পরিধান করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।