বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ইস্কুলের ছুটিতে মা বললেন, তোদের যখন সবকিছু এতই বোরিং লাগছে তখন যা না তোরা তোদের মেজোমামার বাড়ি থেকে ক’দিন বেড়িয়ে আয়।
মায়ের কথায় উপল আর রোদ্দুরীর মুখেচোখে এক সঙ্গে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ল। তার কারণ আছে।
মেজোমামা থাকেন সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কাটারি বিলের পাড়ে বিশাল একটি মাটির দোতলা বাড়িতে । সেই বাড়ির নাম: ‘মৃত্তিকা। ’ কাঠের শক্ত কাঠামোর ওপর কাদার গাথুঁনি দিয়ে তৈরি সেই বাড়ির মাঝমধ্যিখানে নীলাভ পানির বিশাল একটি সুইমিংপুল। সুইমিংপুল ঘেঁষেই তৈরি করা হয়েছে দোতলা মাটির বাড়িটি। দোতলায় প্রশস্ত টানা বারান্দা।
দোতলার বারান্দা থেকে নীচের সুইমিংপুলে ঝাঁপ দেওয়ার কী যে আনন্দ! সুইমিংপুলে আবার একটি আটফুটি জলজ্যান্ত ডলফিনও আছে। ডলফিনের নাম- স্পন্দন। স্পন্দেনের সঙ্গে নীল পানিতে হুটোপুটি করতে কী যে ভালো লাগে!
এইই হল ওদের মায়ের কথায় উপল আর রোদ্দুরীর মুখেচোখে এক সঙ্গে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ার কারণ।
ওদের সুনামগঞ্জ যাওয়া কথা শুনে বাবা চুপ করে থাকলেও দাদু অবশ্য ভুঁরু কোঁচকালেন । গম্ভীরকন্ঠে দাদু বললেন, কাটারিবিলে কী সব জলদানোর উৎপাত শুরু হয়েছে শুনলাম ।
এখন কি ওদের ঝন্টুর কাছে পাঠানো ঠিক হবে বউমা?
এবারের বার্ষিক ক্ষুদে বিজ্ঞানী প্রতিযোগিতায় উপল ও রোদ্দুরীর তৈরি টিয়নগান দ্বিতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছে। ডিভাইসটা দেখতে ছোট হলে কী হবে- এর লাল রশ্মি দুশো ফুট দূর থেকেও ছ’ইঞ্চি পুরু ইস্পতকে মোমের মতো গলিয়ে দিতে পারে! সে জন্যই হয়তো ওদের মা হেসে বললেন, আপনি অত ভাববেন না তো বাবা। ওরা তো ওদের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই যাচ্ছে । সেরকম বিপদ-আপদ এলে ওরা ঠিকই নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। তাছাড়া মেজোভাই তো আছেনই।
দাদু কি বুঝলেন কে জানে । তিনি আবার ই-বুকে মন দিলেন। উপল ও রোদ্দুরীর দাদু ড. মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের অন্যতম। বিশ্বের অনেকেই তাঁর জীবনকাহিনী সম্বন্ধে আগ্রহী। তাই শেষবয়েসে অটোবায়োগ্রাফি লিখছেন।
মাঝেমাঝেই পান্ডুলিপি ই=বুকে ঢুকিয়ে পড়ে নিচ্ছেন। ভুলভ্রান্তি সংশোধন করছেন।
ঢাকা থেকে সকাল-সকাল রওনা হয়ে দুপুর-দুপুর সময়ে খালিয়াজুরী ইষ্টিশনে পৌঁছল কমলারঙের সোলার ট্রেনটা । ট্রেন থেকে নেমে লটবহর ওরা নিজেরাই বইল। বাংলাদেশে এখন আর রেলস্টেশনে কুলিটুলি নেই।
কুলি ছিল সেই ২০২৫ সালের আগে!
বর্ষাকাল। জুন মাস। আকাশে মেঘ-টেঘ ছিল না অবশ্য। কটকটে রোদ ছিল আর ভ্যাপসা গরম। প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামান্য ঘামছিল রোদ্দুরী।
হেলিকপ্টারে উঠেই এক গ্লাস চকলেট মিল্ক খেয়ে নেবে ও। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বলে কমলারঙের সোলার ট্রেনের ভিতর অবশ্য বেশ শীতই লাগছিল তখন। পথে ‘দ্য সাউন্ডস অভ পালসারস’ নামে একটা দুর্দান্ত ডকুমেন্টারি মুভি দেখাল কৃর্তপক্ষ । সময় ভালোই কাটল।
প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় কালো রঙের বিশাল একটা কংক্রিটের চত্ত্বর।
সেই চত্ত্বরে অনেকগুলি হেলিকপ্টার থেমে আছে। হলদে রঙের একটা ছোট্ট 'কপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আতর মিঞা । ওদের দেখে হাত নাড়ল। আতর মিঞা মৃত্তিকার কেয়ারটেকার। বাজার করে, বাগানে মালির কাজ করে আবার হেলিকপ্টারও চালায়।
বুড়োমতন লোকটার পরনে সাদা রঙের চোস্ত পাজামা আর মেরুন রঙের ফতুয়া। আতর মিঞার গায়ের রং বেশ ফরসা। মাথায় চকচকে টাক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নাকটা অবশ্য বড্ড বেমানান।
যাকে বলে থ্যাবড়া আর কী!
রৌদ্দুরী আতর মিঞার কাছে পৌঁছে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ আতর মিঞা?
আল্লাহর রহমতে আমি ভালোই আছি । অখন জলদি জলদি কপ্টারে উইঠা পড়েন দেখি।
দরজা খোলাই ছিল। রোদ্দুরী মুচকি হেসে কপ্টারে উঠে পড়ল। ওকে ফলো করল উপল।
হলদে রঙের পোলো গেঞ্জি আর সাদা থ্রিকোয়াটার পরেছে উপল। রোদ্দুরী নীল স্কার্ট আর কালো শার্ট।
ওরা যখন সিটবেল্ট বেঁধে নিচ্ছিল ততক্ষণে আতর মিঞা হেলিকপ্টারটাকে শূন্যে তুলে ফেলেছে।
রোদ্দুরী সিটের পাশে মাইক্রোফ্রিজ থেকে এক গ্লাস চকোলেট মিল্ক বের করে নিল। আর উপল নিল আখের রসের একটা শীতল ক্যান।
দাদু তখন বলছিল কাটারি বিলে কী নাকি জলদানোর উৎপাত শুরু হয়েছে। রোদ্দুরী ঝুঁকে জানালা দিয়ে নীচের দিকে চাইল। এই দুপুরের ঝলমলে রোদ পড়ে কাটারি বিলের কালচে পানি চিকচিক করছে। রোদ্দুরী সারা বিলে চোখ বোলাল। কই, তেমন তো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না।
কথাটা মেজোমামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই জানেন।
কাটারি বিলের পাড়ে বড় একটা ঘাসের সবুজ লন। একপাশে সাদা রঙের একটা গির্জে, আর ইউক্যালিপটাস গাছের সারি । অন্যপাশে ছোট্ট হেলিপ্যাড।
আতরমিঞা হেলিকপ্টারটা হেলিপ্যাডের ওপর ধীরে ধীরে নামিয়ে আনল। নিঃশব্দে।
ওরা দু’জন দরজা খুলে লাফিয়ে নামল।
তারপর দৌড়ে লন পেরিয়ে মৃত্তিকার বিশাল বারান্দায় উঠে এল।
বারান্দায় উঠে ওরা ঘুরে তাকিয়ে দেখল হেলিকপ্টারটা আবার আকাশে উড়াল দিয়েছে।
ঠিক তখনই অদৃশ্য কন্ঠস্বর ভেসে এল: আমি একটা জরুরি কাজে এখন ধর্মপাশায় আছি রে। তোরা খেয়ে নিস। বেলোরা খাতুন তোদের জন্য রেঁধে রেখেছে। আমি ঠিক চারটে তেরো মিনিটে মৃত্তিকায় ফিরব। আর শোন।
আমি হাওরের চিকড়া বাইম মাছের একটা ডকুমেন্টারি ফিলম তৈরি করেছি। খেয়েদেয়ে ওটা দেখিস।
দৌড়ে ভিতরে চলে এল ওরা । তারপর থমকে দাঁড়াল। কী নির্জন বাড়ি।
দুপুররোদে সুইমিংপুলের হালকা নীলাভ পানি টলটল করছে। খোলা আকাশের ছায়া পড়েছে। স্পন্দনকে অবশ্য দেখা গেল না। আছে কোথাও। নীলচে পানির তলায়।
হয়তো এক্ষুনি ভেসে উঠবে।
সুইমিংপুরের কিনারে পাথরের তৈরি একটি সাত ফুট উঁচু পরীমূর্তি। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ওই ভাস্কর্যটি সৃষ্টি করেছেন মেজোমামার ভারতীয় বাঙালি বন্ধু ভাস্কর গৌর বৈরাগী।
ওরা সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে- ঠিক তখুনি খ্যানখ্যানে কন্ঠস্বর শোনা গেল:গোছল করতে বেশি সময় নষ্ট করো না বলছি। আমার রান্না শেষ।
কেবল আলুভর্তা বাকি । এদিকে আবার শর্ষের তেলের শিশি খুঁজে পাচ্ছি না ছাই।
বেলোরা খাতুন । মেজোমামার রাঁধুনি। চশমা পরা ফরসা বৃদ্ধা।
কালো পাড়ের সুতির শাড়ি পরে আছে। বেলোরা খাতুনের রান্নার হাতটি ভারি চমৎকার। তবে বুড়ির মেজাজ ভারি চড়া। মেজোমামাকেও ধমক দেয়। মেজোমামা যখন কাজে ডুবে থাকেন ল্যাবে।
আর খেতে ভুলে যান।
রোদ্দুরী হাসি সামলে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন আছ বেলোরা খাতুন?
আমি ভালো নেই বাপু। আতর মিঞাকে কোনও কথা বললে আজকাল শোনে না। বাজার থেকে বুড়োকে চেলামাছ আনতে বললে আনে পানমাছ । এদিকে আবার শর্ষের তেলের শিশিটা কই যে রাখলাম।
রোদ্দুরী মুখ টিপে হাসল। তারপর বলল, বেলোরা খাতুন। আম্মু না মেজোমামার জন্য রসুনের আচার আর দাদি বেলের মোরব্বা পাঠিয়েছে ।
কথাটা রোদ্দুরী বলল বটে, তবে বেলোরা খাতুনের মুখ দেখে ভালোমন্দ কিছু বোঝা গেল না।
ওরা দোতলায় উঠে এল।
সিঁড়ি বেশ প্রশস্ত। ল্যান্ডিংয়ে শিল্পী শাহাবুদ্দীনের ছবি টাঙ্গানো। মৃত্তিকার মূল নকশা ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছেন মেজোমামার জার্মান বন্ধু জুডিথ হফনার।
কাপড় বদলে সুইমিং কষ্টিউম পরে নিল ওরা। তারপর দোতলার বারান্দায় এল।
উপল পড়েছে নীল রঙের কষ্টিউম; রোদ্দরী কালো রঙের। দোতলার বারান্দার একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে ছোট্ট লাফ দিয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিল ওরা। শরীরে ঠান্ডা পানির ছোঁওয়া লাগতেই কী আরাম। কী আরাম। একটু পর সুইমিংপুলের নীল পানি চলকে উঠল পানি।
একটা হাসিখুশি ডলফিন লাফিয়ে উঠল।
স্পন্দন! রোদ্দরী চেঁচিয়ে উঠল।
ব্যাস। শুরু হয়ে গেল স্পন্দনের সঙ্গে ঝাঁপাঝাঁপি । ছাই রঙের ডলফিনটার পিছল শরীর।
লম্বায় তো কম করেও ৮ ফুট তো হবেই, আর ওজন ২৫০ কেজির কম হবে না।
স্পন্দন কিন্তু আসলে একটা রোবট!
মেজোমামা বানিয়েছেন। উপল ও রোদ্দুরীর এই মেজোমামাটি কিন্তু বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। মেজোমামা দীর্ঘদিন ধরে বায়োরোবটিক্সের ওপর কাজ করছেন। হরেক রকম রোবট তৈরি করেন।
(মেজোমামার ল্যাবটা সুইমিংপুলের ঠিক নীচে। লিফটে চেপে যেতে হয়) ...সে যাই হোক। মেজোমামার নাম ড. রেজা হায়দার। হতে পারেন তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, কিন্ত মেজোমামার ডাকনাম ঝন্টু। সে যাই হোক।
মেজোমামা কিন্তু বেশ মজার মানুষ। তাই তাঁর বানানো রোবটগুলিও বেশ মজার। যেমন মেজোমামা এই মজার মাটির বাড়িটিতে থাকেন। এমআইটি-র স্নাতক হয়েও বাংলাদেশে ফিরে এসে নিভৃতে বায়োরোবটিক্সের ওপর গবেষনা করে যাচ্ছেন। গবেষনা ছাড়াও হাওরের মাছের ওপর ডকুমেন্টারি নির্মান করেন মেজোমামা ।
বাংলাদেশের প্রাণিবৈচিত্র নিয়ে মেজোমামা যেমন মুগ্ধ, তেমনি জলবায়ূ পরিবর্তন নিয়েও উদ্বিগ্ন।
গোছল সেরে ওরা খেতে বসল। খাওয়ার টেবিলটি সুইমিংপুলের পাশেই। সুতরাং মাঝে-মাঝেই স্পন্দনের কালচে পিঠ দেখা যাচ্ছিল।
দেখা গেল বেলোরা খাতুন এন্তার আয়োজন করেছে।
ভাত, আমডাল, লালশাক আর ... আর বাতাই মাছের ঝোল (এই বাতাই মাছটাকে আবার অনেকে আলনিমাছও বলে) বাগাই মাছের দো পেঁয়াজা, গুতুম মাছের পাতুরি, এলং মাছের ফ্রাই, ভূমমাছের চপ । কিন্তু, আলুভর্তা কই? বেলোরা খাতুন মনে হয় সর্ষের তেলের শিশি খুঁজে পায়নি।
খেয়ে দেয়ে ওরা দোতলায় এল। বসল বারান্দায় । দোতলার বারান্দায় অনেকগুলি বেতের সোফা।
সোফায় বসেই নীচের লন, হেলিপ্যাড, ঝিরিঝিরি ইউক্যালিপ্টাস, সাদা গির্জে আর কাটারি বিলের অনেকটাই দেখা যায়। এখন কেমন মেঘ করে এসেছে। হু হু করে বাতাস বইছিল। সে বাতাসে রোদ্দুরীর চুল উড়ছে।
উপল ঝুঁকে বেতের টেবিলের ওপর থেকে ছোট্ট একটা ডিভাইস তুলে নিল।
তারপর বাটনে প্রেস করল। শূন্যেই একটা বড় স্ক্রিন ভেসে উঠল। স্ক্রিনে সদ্য দেখা ভিডিও ফাইলের লিষ্ট। বাংলায় ‘চিকড়া বাইম’ লেখার ওপর ক্লিক করল উপল। স্ক্রিনজুড়ে হাওর তলার জলে রাজ্য ফুটে উঠল।
ছোটবড় মাছের বিচিত্ররাজ্য। মেজোমামা স্বচ্ছ কাঁচেঘেরা একটি পোর্টেবল ডুবোযানে বসে রয়েছেন। চিকড়া বাইম পোনা ছাড়ছে। তিন ফুট দূর থেকে অপূর্ব দৃশটি ফ্রেমবন্দি করছেন মেজোমামা । নিঃশব্দে।
জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে হাওরের মাছ হু হু করে কমে যাচ্ছে। টিকে থাকা মাছগুলির মধ্যে অন্যতম এই চিকড়া বাইম।
রোদ্দুরী ওর শার্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা ডিভাইস বের করে ওর বান্ধবী নৈশীকে ভিডিও ফাইলটা ট্রান্সফার করে পাঠিয়ে দিল।
ধর্মপাশা থেকে মেজোমামা ফিরলেন ঠিক চারটে তেরো মিনিটে ।
উপলই প্রথম হলদে হেলিকপ্টারটা দেখতে পেল।
ওরা হইহই করে দৌড়ে নীচে নেমে এল।
মেজোমামা ততক্ষণে হেলিকপ্টার থেকে নেমে এসেছেন। মেজোমামার পরনে নীল রঙের ফতুয়া আর কালো রঙের প্যান্ট। দেখলেই মনে হবে না মানুষটি বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের একজন। পঞ্চাশের মতন বয়েস।
ভরাট মুখটি ফরসা । কোনও কোনও মানুষকে টাক মানায়। মেজোমাজা সে ধরনের একজন মানুষ। চোখে চারকোণা সোনালি ফ্রেমের চশমা। মেজোমামাকে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাল ।
মজার হাসিখুশি মানুষটি কেমন যেন চুপসে গেছে। ম্লানস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, তোরা খেয়ে নিয়েছিস তো?
হ্যাঁ মামা। তুমি?
আমি ধর্মপাশায় একটি রিসার্চ সেন্টারের ক্যান্টিনে খেয়ে নিয়েছি । তা তোরা চিকড়া বাইম মাছের ডকুমেন্টারিটা দেখেছিস তো?
হ্যাঁ। মামা।
কেমন লাগল? বলে মেজোমামা ফ্যাকাশে হাসলেন।
কুল মামা, কুল!
ওরা বাড়িতে ঢুকে সোজা দোতলায় উঠে এল। তারপর বারান্দায় বেতের সোফায় বসল। ঠিক তখুনি বেলোরা খাতুন এসে উপস্থিত। হাতে নকশাদার একটি কাঠের ট্রে।
ট্রেতে তিনটে ঝকঝকে গ্লাস। তাতে সাদা রঙের তরল। আমের শরবত বলেই মনে হল ।
উপল এক চুমুকে ঘন টকমিষ্টি শরবতটা শেষ করল। আহ।
তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে বলল, মামা, শুনলাম কাটারি বিলে নাকি জলদানোর উৎপাত শুরু হয়েছে?
মেজোমামার ফরসা মুখে কালো ছায়া ঘনিয়ে উঠল। প্রশস্ত কপালে বিন্দু বিন্দু ফুটে উঠল ঘাম । শরবতটা ধীরে ধীরে খাচ্ছেন। দৃষ্টি দূরের সাদা রং করা গির্জের দিকে। তারপর হঠাৎই শরবতটুকু এক চুমুকে শেষ করে বললেন, ওটা আমারই বড় এক ভুল রে উপল।
তোমার ভুল মানে ? রোদ্দুরীর চোখ কপালে উঠল। চোখের মনি যাকে বলে-বিস্ফারিত!
মেজোমামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, এ বছরেরই গোড়াতে জার্মানির টুবিনজিনের একটা মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির জন্য প্রহরী রোবটের অর্ডার পেয়েছিলাম । কাজটা জুডিথই পাইয়ে দিয়েছিল। রোবটটা ওদের পছন্দ হলে আরও অর্ডার দেবে।
আমি যত ভালোই রোবট বানাই না কেন-বুঝিসই তো- সব কাজেই কমপিটিশন বলে একটা কথা আছে। সুতরাং কাজটা আমি ভালো করেই করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। বছর কয়েক ধরে আমি বায়োরোবটিক্সের ওপর একটা জটিল এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম, সেই মেথড অ্যাপ্লাই করলাম। আর তাতেই জিএক্স ফাইভটা গেল বিগড়ে ।
জিএক্স ফাইভ?
ওই রোবটের নাম।
ও। তারপর কি হল?
জিএক্স ফাইভটা পালালো।
পালালো মানে?
পালালো মানে পালালো। একরাতে ল্যাব থেকে পালিয়ে হাওরের পানিতে নেমে গেল।
কথাটা শুনে রোদ্দুরীর শরীর কেমন ছমছম করে উঠল।
ওটা এখন হিংস্র হয়ে উঠছে। জেলেনৌকা, হাওরপাড়ের গ্রাম, জেলেপাড়া আক্রমন করছে । এসব হয়তো সামান্য ব্যাপার। কিন্তু ধীরে ধীরে জিএক্স ফাইভ হিংস্র হয়ে উঠবে।
ধীরে ধীরে হিংস্র হয়ে উঠবে মানে? উপল অবাক হয়ে জানতে চাইল।
জিএক্স ফাইভের বায়োলজিক্যাল এভিউলুশান হচ্ছে। মেজোমামা গম্ভীরকন্ঠে বললেন।
ও মাই গড!
হ্যাঁ। এটাই দুশ্চিন্তার কথা। ওটা হাওরের সব মাছ খেয়ে শেষ করে ফেলবে।
কথাটা বলে মেজোমামা কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে রইলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুখটা ঝুলে গেছে। হঠাৎ করেই যেন বয়েস বেড়ে গেছে।
উপল ছোট্ট শ্বাস ফেলল।
এবার যেন সব বোঝা গেল। দাদু কেন উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। ও জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কিন্তু দাদু জানল কি করে?
জিএক্স ফাইভ পালিয়ে যাওয়ার রাতেই ওনার সঙ্গে আমি বিষয়টি নিয়ে কনসাল্ট করেছি।
ও।
দাদু মেজোমামার গুরু।
বাবা ও মেজোমামা দু’জনই দাদুর ছাত্র ছিলেন।
এখন কি যে হবে? ভয়ানক এই দুর্যোগটা নিয়ে রোদ্দুরীও সিরিয়াসলিই ভাবছে । ও উপলের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা উপল। টিয়নগান দিয়ে জিএক্স ফাইভটাকে শেষ করে দিলে কেমন হয়?
টিয়নগান মানে? মেজোমামা অবাক হলেন।
উপল বলল, হ্যাঁ, মেজোমামা।
টিয়নগান। মারাত্মক এক অস্ত্র। আমরা দু’জনে মিলে বানিয়েছি।
মেজোমামা রোবট তৈরিতে সিদ্ধহস্ত হলেও মারাণাস্ত্র কখনেই তৈরি করেননি। কাজেই খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলেন বলেই মনে হল।
উৎসাহিত কন্ঠে বললেন, যা, জিনিসটা নিয়ে আয় তো দেখি।
রোদ্দুরী এক দৌড়ে গিয়ে ব্যাগ খুলে নীল রঙের একটা মখমলের ছোট্ট বক্স নিয়ে এল। তারপর উপলের হাতে বক্সটা দিল। বক্সটা খুলতে খুলতে উপল বলল, মেজোমামা। ডিভাইসটা দেখতে ছোট।
কিন্তু এই লাল বোতাম টিপে দিলেই লাল রশ্মি বেড়িয়ে কেল্লা ফতে।
হুমম। তা রেঞ্জ কেমন রে?
এই ধরো দুশো ফুট। এট লিস্ট।
মেজোমামাকে কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে।
কি যেন ভাবছেন তিনি । দৃষ্টি নীচের লনে। নীচে আতর মিঞা হেলিকপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হেলিকপ্টার থেকে কী সব বক্স নামাচ্ছে।
উপল জিজ্ঞেস করল, মেজোমামা ওই বক্সগুলিতে কি আছে?
এক্সপ্লোসিভ।
ধর্মপাশা থেকে এনেছি।
এক্সপ্লোসিভ?
হ্যাঁ। এক্সপ্লোসিভ। বলা তো যায় না। জিএক্স ফাইভ যদি এদিকেও চলে আসে।
আগে থেকেই তৈরি থাকা ভালো।
কথাটা শুনে কপালে ঘামবিন্দু টের পেল উপল । রোদ্দুরীর দিকে তাকাল ও। রোদ্দুরীর মুখটাও কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। মেজোমামা কী যেন ভাবছেন।
হাতের ইশারায় আতর মিঞাকে ওপরে আসতে বললেন। আতর মিঞা একটু পর ওপরে উঠে এল।
আতর মিঞাকে টিয়নগানের ব্যবহার বুঝে দিল উপল । আতর মিঞা ব্যাপরটা বুঝে মাথা নাড়ল।
ঠিক তখনই সমস্ত বাড়িটা কেঁপে উঠল।
মাটি থরথর করে কাঁপছে।
ওই যে! জিএক্স ফাইভ! রোদ্দরী চিৎকার করে উঠল।
ওরা মুহূর্তেই রেলিংয়ের কাছে চলে এল।
মেজোমামা চিৎকার করে বললেন, আতর মিঞা। কুইক।
এখুনি তুমি নীচে চলে যাও। ফ্লাই করো। আর এটা ধরো। যত কাছ থেকে পার ফায়ার করবে। বলে টিয়ন গানটা দিলেন আতর মিঞাকে।
ওদিকে হাওরের পানিতে বিশাল এক জলদানো ভেসে উঠেছে । দশতলার সমান উঁচু হবে। মিশমিশে কালো শরীর। চৌকোন মুখ। তাতে সবুজ রঙের বড় বড় দুটি চোখ ।
সারা শরীরে আঁশ। আঁশ থেকে পানি ঝরছে। মূর্তিমান জলদানো দেখে রোদ্দুরী কেমন হিম হয়ে গেল। ওর মুখ থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এল-ও মাই গড!
বেলোরা খাতুনও চলে এসেছ। গজগজ করছে।
সারাদিন কাজকম্ম করে একটু গা এলিয়ে দিয়েছি । মুখপোড়াটা কোত্থেকে জুটে ঘুম ভাঙিয়ে দিল।
নীচের লনে আতর মিঞা দৌড়াচ্ছে। কাঁধ থেকে গামছা পড়ে গেল। থেমে আবার তুলে নিল।
মেজোমামা বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
থপ থপ করে পা ফেলে জলদানোটা পাড়ের দিকে এড়িয়ে আসছে। পানিতে ভীষণ আলোরণ উঠেছে। কয়েকটি নৌকা ভাসছিল। নৌকাগুলি বাদামের খোসার মতন হাওরের পানিতে তলিয়ে গেল।
হলুদ ফড়িংটা ততক্ষণে আকাশে উড়াল দিয়েছে। নিঃশব্দে ।
রোদ্দুরীর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আতর মিঞার যদি কোনও ক্ষতি হয়। ইশ! নৈশী এ রকম গা ছমছমে দৃশ্য মিস করছে।
রোদ্দুরী ডান হাত তুলে ওর চশমার ডাঁটির ওপর বসানো ছোট্ট বাটন প্রেস করল। দৃশ্যটা এখন নৈশীর কম্পিউটারে সরাসারি সম্প্রচার হতে থাকবে । নৈশী ঘুমিয়ে থাকলেও সমস্যা নেই। ওকে রিঙ্কি নামে একটা রোবট সব জানিয়ে দেবে।
ওদিকে হলুদ ফড়িং জলদানোর মাথা ঘিরে পাক খাচ্ছে।
মেজোমামা চাপাস্বরে বললেন, কপ্টারটার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে জিএক্স ফাইভ ।
হঠাৎই হেলিকপ্টার থেকে একটা তীব্র সরু লাল রশ্মি বেরিয়ে জলদানোটার সবুজ চোখের মধ্যে ঢুকে গেল। জলদানোটা বিকট চিৎকার করে উঠল। সেই বিভৎস চিৎকারে কাটারি বিলের অটুট নির্জনতা খান খান ভেঙে গেল। দিগন্ত অবধি ছড়িয়ে যায় জলদানোর সে মর্মান্তিক আর্তনাদ।
উপল অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলল, আতর মিঞা টিয়নগান চার্জ করেছে। টিয়নগান চার্জ করেছে।
বেলোরা খাতুন হেসে বলল, আতর মিঞারও দেখি এলেম আছে।
টিয়নগান চার্জের ফলেই কিনা কে জানে জলদানোটার আকার বাড়তে লাগল। বেলুনের মতন ফুলে উঠতে লাগল জলদানো।
একেবারে তিরিশ তলার সমান হয়ে গেল। গোবদা গোবদা পা ফেলে ফেলে প্রায় পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে দানোটা। চোখের সামনে জলদানোর অবিশ্বাস্য রূপান্তর দেখে ওরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। মেজোমামার মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিস্ময়ধ্বনি, ও মাই গড। এত শীঘ্রি মিউটেশন হল কি করে?
হলদে হেলিকপ্টারটা এখন ঠিক জলদানোর নাক বরাবার।
এই মাত্র ফুট দশেক দূরে। জলদানোটা বিরাট হা করল। যেন খুদে কপ্টারটাকে গিলে খাবে। ঠিক তখনই আতর মিঞা তীব্র বেগে চালিয়ে হেলিকপ্টাকে নিয়ে জলদানোর বিশাল গহ্বরে ঢুকে পড়ল।
রোদ্দুরীর মনে হল ও সেন্সলেস হয়ে পড়বে।
হিম আতঙ্কে ও চোখ বুজে ফেলল। একটু পরই বিস্ফোরণের প্রচন্ড আওয়াজে চোখ খুলল ও। চতুর্দিকে লাল আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছে আর প্রচন্ড কড়াৎ কড়াৎ শব্দে জলদানোটা দুমড়ে- মুচড়ে যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে কাটারি বিলের পানিতে তলিয়ে গেল।
ভাগ্যিস হেলিকপ্টারে এক্সপ্লোসিভের বক্স ছিল।
মেজোমামা বললেন। হাসছেন। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলেন।
ইশ! আতর মিঞা নিজের জীবন স্যাক্রিফাইস করল। রোদ্দুরী ফুঁপিয়ে বলল।
মেজোমামা হেসে বললেন, নারে রোদ্দুরী। আতর মিঞা আসলে একটা রোবট। Android robot বা synthetic organism -এর এক ক্লাসিক উদাহরণ। বলে রোদ্দুরীর চুলে আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন ওই মজার বিজ্ঞানী।
আতর মিঞা রোবট?
হ্যাঁ।
অ্যান্ড্রইড রোবট। তোদের বলা হয়নি। আমার মনে ছিল না।
রোদ্দুরী হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। রোবট হলেও বুড়োটাকে ভালোই লাগত ওর।
মেজোমামা বেলোরা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ফুপু, আমের শরবত আর আছে নাকি?
বেলোরা খাতুন দোয়াদরূদ পড়ছিল। এখন মাথায় আঁচল দিয়ে বলল, নেই আবার। আমি কি জানতাম না যে তোমরা আবার খেতে চাইবে। কত যত্ন করে করেছি।
মেজোমামা মুচকি হাসলেন।
ওরা অবশ্য শব্দ করেই হেসে উঠল। আনন্দের চোটে এই বেলোরা খাতুনও Gynoid (মেয়ে রোবট) কি না সেটি অবশ্য মেজোমামাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেল ওরা।
উৎসর্গ: রেজোওয়ানা আর ওর ছোট্ট কন্যাটিকে ...
এ গল্পে ব্যবহৃত মাছের নামের উৎস
http://www.prothom-alo.com/detail/news/194175 ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।