তোর সাথে দেখা হবার প্রথম দিনটা আমার এখনো মনে পড়ে। স্পষ্ট। নিজের মতাদর্শের বিপরীতে অন্যদের স্থুলতার স্রোতের ঘোলাটে জলে আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে মনে হত পাগল হয়ে যাচ্ছি।
ঠিক এ সময়েই একদিন দেখা তোর সাথে।
প্রচন্ড ঝড়ের এক দিন....ধূলো, বাতাসের তোড় আর তার মাঝে এগিয়ে চলা রিকশা। কেন জানি তোর সাথে সব সমস্যাগুলো শেয়ার করে ফেললাম সেদিন।
জানতাম আমার এইসব সমস্যার সমাধান কারো কাছে নেই। সমাজটা বদলে দেবার যে প্রচন্ড নেশায়, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার যে মতাদর্শিক পাগলামী আমাকে পেয়ে বসেছিল, তাতে আমি সরে গিয়েছিলাম বাস্তব থেকে অনেক দূরে। ভুলে গিয়েছিলাম মতাদর্শের বাইরেও একটা জীবন মানুষ নিজের জন্য রেখে দেয়।
যে জীবনে মুখভরা সাম্যবাদী বুলির পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের স্বার্থপরতা, ক্যারিয়ার, নোংরামিগুলোও আছে। আমি বুদ্ধিমান ছিলাম না তাদের মত। হতেও চাইনি কোনদিন। ভাবতাম একদিন এই দেশে কোন গরীব থাকবে না, কোন বৈষম্য থাকবে না....আরো যে কত কী ভাবতাম তা এখন আর নিজেরও মনে পড়ে না।
যাই হোক. কিন্তু আমার মত নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক কেন তোকে সেদিন সব কথা খুলে বলেছিল তার উত্তর আজো আমি নিজের কাছে খুঁজে পাই না।
কিন্তু সেদি;ন থেকে তুই আমার সব দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছিলি আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়েই।
দুঃস্বপ্ন চোখে নিয়ে জেগে থাকার দিনগুলো পার করেছিলাম আমি তোরই হাত ধরে। মনে আছে, তুই আমাকে বলেছিলি, দেখিস আজ থেকে ৩০ বছর পরেও আমরা প্রমাণ করে দেব একটা ছেলে আর একটা মেয়ে শুধুই বন্ধু হতে পারে!
৩০ বছর পেরোতে হয়নি। আমাদের বন্ধুত্ব যে ৩ মিনিটের জন্যও দেখেছে তারাই বোঝে, বন্ধুত্বে লিঙ্গীয় পরিচয় কোনই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আমাদের বন্ধুত্ব তোর বা আমার ব্যক্তিগত জীবনকেও বাধাগ্রস্থ করেনি কখনো।
ভীষণ মনে পড়ে. আব্বুর অসুস্থতার সময় মাঝরাতেও আমার বাবাকে বাঁচাতে তোর বিরামহীন ছুটোছুটি। আত্মীয় স্বজনরা যখন নামাজের দোহাই দিয়ে মসজিদে পড়ে ছিল দায়িত্ব এড়াতে। সেসময় তোরই জন্য বেঁচে গিয়েছিল আমার বাবা। পরবর্তীতে সেই আত্মীয়রা কম কথা শোনায়নি, আামার পরিবারও স্বীকার করেনি তোর ঋণ। তাতে আজো তোর কিছু যায় আসে না।
সেই অসুস্থতার পরপরই ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। আমার চোখে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। আর আত্মীয়দের মানসিকতা কোন রকম একটা কলেজে ভর্তি করানো। আমার সেই স্বপ্ন সার্থক করতে তুই ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসেনি সেদিন।
আমার মনেপড়ে. তুই শুধু বলেছিলি, তুই শুধু ভালভাবে পড়।
ভার্সিটিতে তোকে চান্স পেতেই হবে। তোর সব দায়িত্ব আমার। আমার সেদিন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কখনো চবিতে পড়া হবে আমার। তবু ভীষণ মন দিয়ে পড়তাম।
পরীক্ষার আগে তুই চবিতে নিয়ে গেলি আমাকে। জীবনে প্রথম এত লম্বা জার্নি। রাতে জ্বর চলে এল। পরদিন পরীক্ষা দিলাম। চান্সও পেয়ে গেলাম মেরিট লিস্টে।
নৃবিজ্ঞান নিলাম।
তুই চলে গেলি মালয়েশিয়া পড়াশোনা করতে। ভীষণ একা হয়ে গেলাম। তবু আমাকে নিয়ে তোর স্বপ্ন সার্থক করার জন্য পড়তাম। বেশ পড়তাম।
অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট বেরুলো। ফার্স্ট হলাম। সবাই সেই পড়ন্ত বিকেলে মা বাবাকে জানাচ্ছে রেজাল্টের খবর। আর আমি মেসেজ লিখছি ....তোকেই.....আমি ফার্স্ট হয়েছি দোস্তো! জানি সবচে খুশি তুই ই হয়েছিস!!!!!
এরপর প্রতি বছরেই আমার প্রথম হওয়া আর তোকেই প্রথম জানানো। এর অন্যথা হয়নি কখনো....!
এরই মাঝে আমার জীবনে এলো দীপ।
আমার সবচে কাছের এই মানুষটাকে নিয়ে ভীষণ ভয়ে ছিলাম। কীভাবে ও নেবে আমাদের এই বন্ধুত্ব, কখনো যদি বাদ সাধে!!!আমি কৃতজ্ঞ এই অসম্ভব ভালো মানুষটার কাছে, যে আমার আরো অনেক দোষের সাথে সাথে তোর আমার বন্ধুত্বকেও প্রশ্রয়ের সাথেই গ্রহণ করেছে। গ্রহণ করেছে তোকে নিজেরও ভাল বন্ধু হিসেবে।
অনার্স শেষের পর পরই যোগ দিলাম ফুনডাসিয়ন ইন্টারভিডার প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে। যেদিন কনফার্মেশন পেলাম।
আমার মনে আছে মালয়েশিয়া থেকে ফোরে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে তুই বলছিলি,'দোস্তো,...তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না। আমার মনে হয়, তুই চাকরি পাওয়াতে তোর চেয়ে আমি ই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি। ' আসলে... আমার নিজেরও যে তাই মনে হয় রে!
তুই দেশে এসছিস এবার অনেক দিন পর। সারাদিন অফিস সেরে অনেক সময় তোর সাথে দেখা হয় না। তুই দেশে আছিস অথচ তোর সাথে দেখা না হওয়াটা অনেক বেশী কষ্টদায়ক।
তবু মেনে নিতে হয়। এটাই যে বাস্তবতা....!!!!
তবুও জানিস আমার কি মনে হয়? আমার মনে হয়, খুব শিগগীরই একদিন আবারো আকাশটা কালো করে ঝড় উঠবে। ২০০৫ সালের এগারোই সেপ্টেম্বরের মত। আমারা সেই প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে আমরা একটা রিকশায় লাফ দিয়ে চড়ে বসবো। নিউমার্কেটের নিচতলার সেই দোকানটায় লাচ্ছি খাবো।
আর ফেরার পথেও ঝড় একটুও কম
বে না।
কিন্তু তুই লম্বু ঠিকই একটা চলন্ত বাস থামিয়ে আমাকে উঠিয়ে দিবি। উঠে যাবার সময় হঠাৎ হাতটা বাড়িয়ে দিবি...
আর আমি ভাববো....বোধহয় অমি আজ একজন বন্ধু পেতে যাচ্ছি....সৈকত....আমার বন্ধুর পথের বন্ধু.....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।