আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবাস জীবন- আটকে পড়া তিমির দল

কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে.... বিদেশের জীবন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণ লিখলাম। এই জিনিসগুলো নিয়ে ইদানিং অনেক চিন্তা করি। আসলেই কী মধু আছে বিদেশে? আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা- মুখোশের আড়ালে এই জীবনের প্রকৃত চেহারাটা দেখার চেষ্টা করেছি আমি। এখানে আমার পরিচিত যে ক’জন বাংলাদেশী আছেন- সবাই ভালো চাকরী করেন। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কর্পোরেট অফিসের বড় বড় পোস্ট সামলান।

এঁদের কেউ কেউ ইলেকশনে পার্টির ক্যাম্পেইনে অনেক টাকা অনুদান দেন। তাঁরা অবসরে ফুটবল খেলেন, টেবিল টেনিস খেলেন, পরিবার নিয়ে ‘লং ড্রাইভ’-এ চলে যান প্রায়শঃই। প্রথম দেখায় এঁদেরকে খাঁটি আমেরিকান বলে মনে হবে। এঁদের সাথে মিশছি আজ অনেক দিন হলো। বাইরে থেকে এঁদের ঠিক চেনা যায় না।

এখানে যখনই কোনো বাংলাদেশী তার বাড়িতে সবাইকে দাওয়াত করেন, সেখানে দেশী খাবারের ধুম পড়ে যায়। চার-দু’গুনে আট ঘন্টার ড্রাইভ করে শিকাগো থেকে শুঁটকি নিয়ে আসেন কেউ কেউ। গরুর মাংসে এদেশে হাড় থাকে না। তাই অনেকে গ্রামে গিয়ে আলাদা করে হাড় কিনে এনে মাংসের সাথে মিশিয়ে রান্না করেন, যেন সেটা খেতে বাংলাদেশী মাংসের মত হয়। বাংলাদেশী সল্টেড বিস্কুট ছাড়া কারো কারো চলেইনা।

ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, আর সব হাতি-ঘোড়া মারা হয় ঠিক বাংলাদেশী কায়দায়। অন্দরমহল থেকে চা, বিস্কুট, মিষ্টি সাপ্লাই হতে থাকে কিছুক্ষণ পর পর। এই লোকগুলো অনেকেই এদেশে এসেছেন ২০-৩০ বছর আগে। অনেকে এখানে এসেছেন ১৮-২০ বছর বয়সে। কেউ কেউ দেশ দেখেননি ৪-৫ বছর।

কাজেই চাপে দেশে যাওয়ার সময় হয় না। এত বছর বিদেশে থেকেও এঁরা কখনোই সম্পূর্ণ ‘আমেরিকান’ হয়ে যেতে পারেননি। সম্পূর্ণ দূরে থাক, তাঁরা ছিঁটেফোঁটাও আমেরিকান নন। তাঁরা আমেরিকান সংস্কৃতির কিছুই আপন করে নিতে পারেননি। তাঁরা কখনও কোনো আমেরিকান সামাজিক আড্ডায় যোগ দেন না।

কখনোই কোনো আমেরিকান পার্টিতে যান না, একান্ত বাধ্য না হলে। তাঁদের কোনো আমেরিকান বন্ধু নেই। আমেরিকানদের সাথে তাঁদের সম্পর্ক হয় শুধুমাত্রই কাজের খাতিরে, যেটুকু না হলেই নয়। যে দেশে তাঁরা গত কয়েক দশক ধরে আছেন, সে দেশের মাটি-পানি-বাতাস, কিংবা মানুষগুলোর সাথে আজও তাঁদের বিন্দুমাত্র সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। তাঁদের প্রায় কেউই ভোট দিতে যান না।

আমেরিকান থ্যাংকসগিভিং, ক্রিসমাস কিংবা ইস্টার তাঁদের কাছে নিছকই ছুটির দিন। আজও তাঁরা শীতের প্রথম বরফ দেখে উৎফুল্ল হন না। এঁদের সবার মাঝেই একটা ‘ভার্চুয়াল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রচেষ্টা প্রকট। একে অপরের থেকে ৫০-১০০ মাইল বা তার চেয়েও বেশি দূরে থেকেও তাঁরা একে অপরের আত্মীয়ের মতই আপন। অথচ পাশের বাড়ির প্রতিবেশীকেও চেনেন না অনেকে।

যে কোনো ছুতোয়, কোনো সুযোগ পেলেই সবাই দূর-দূরান্ত থেকে এসে এক হন। কয়েক ঘন্টা গল্প করেন, সুখ দুঃখের আলাপ করেন। হাড় মেশানো গরুর মাংস, শুটকি ভর্তা আর ডাঁটার তরকারী খান। এঁদের সন্তানরা ইংরেজীতে কথা বলে। বাংলা বোঝে, তবে বলতে কষ্ট হয়।

আমেরিকান উচ্চারণে জড়িয়ে জড়িয়ে থেমে থেমে বাংলা বলে এরা। বাবা-মা’রা জোর করে এদেরকে শাড়ি-লুঙ্গি পড়ান, বাংলা নাচ-গান শেখান। এদেরকে বাংলায় কথা বলতে বাধ্য করেন। কোনো একটা বাচ্চা যখন সঠিকভাবে একটা বাংলা বাক্য বলে ফেলে- তখন তাঁদের মুখে একটা প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে। এই লোকগুলোকে বলে ‘ফার্স্ট জেনারেশন আমেরিকান’।

এঁরা ভাটায় সময় আটকে পড়া তিমির ঝাঁকের মত। এঁরা কেউই হয়তো দেশে ফিরবেন না। তবে ঘুমের মাঝে সবসময় দেশের স্বপ্ন দেখবেন, মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। এঁরা শিকাগো-নিউ ইয়র্ক- নিউজার্সি থেকে অনেক দাম দিয়ে গাঁদা ফুলের বীজ কিনবেন, নিজের ব্যাকইয়ার্ডের বাগানের জন্য। সেই হলুদ ফুল যখন থোকায় থোকায় ফুটবে, তখন বাইরে ‘প্যাটিও’তে ইজি চেয়ারে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, স্মরণ করবেন শৈশবে ফেলে আসা গ্রামের বাড়ির উঠোনের কথা।

দূরে দিগন্তে সূর্য অস্ত যাবে ধীরে ধীরে। সেটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করবেন। আমি কি নিজের জন্য এমন একটা জীবন চাই? আমি বেশ কিছুদিন ধরে এই প্রশ্নটা করছি নিজেকে। পিএইচডি একটা অভিশাপ। আমি দু’বছর আমেরিকায় পড়ালেখা করলাম; এখন আমি জানি, আমাদের দেশের পড়ালেখার সিস্টেম কত জঘন্য পঁচা।

আমি আর কখনোই দেশে গিয়ে সেখানকার সিস্টেমের সাথে মানিয়ে নিতে পারবো না। আমি কখনোই দেশে গিয়ে গবেষণা করতে পারবো না। আমি যদি কাজ করতে চাই, নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে চাই- তাহলে আমাকে এখানেই থাকতে হবে ওই ‘আটকে পড়া তিমি’ হয়ে। ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’- একটা কথা আছে। বিদেশে যারা একবার আসে- তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেরকম।

আমাকেও হয়তো সারাজীবন ওই ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’ হয়েই থাকতে হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।