যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে পঞ্চম দিনের মতো আজ বুধবার তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনকে জেরা করেছেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। তদন্ত কর্মকর্তা মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আলামত হিসেবে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের যে ভিডিও সিডি জমা দেন তার ওপর তাকে জেরা করা হয়।
সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। কিন্ত আজকের জেরায় বের হয়ে এসেছে তদন্ত কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে সিডি দিয়েছেন সেই ভাষণের সাথে সংবিধানে সন্নিবেশিত ববঙ্গবন্ধুর ভাষণের অনেক গরমিল রয়েছে। জেরায় দেখা যায় সিডির ভাষণে এমন কিছু কথা আছে যা সংবিধানে বর্ণিত ভাষণে লেখা নেই।
আবার সংবিধানের ভাষণে এমন কিছু কথা লেখা আছে যা সিডির ভাষণে নেই।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, হয় সিডিতে না হয় সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কমবেশি করা হয়েছে। কোনটা যে আসল তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এটুকু বোঝা গেছে সংবিধানে মুল ভাষণ হুবহু তোলা হয়নি।
এছাড়া মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ১৯৭২ সালের কিছু খবরের ভিডিও ফুটেজ জমা দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে।
কিন্তু দেখা যায় সেই ফুটেজের সাথে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রঙিন ভিডিও কিপিং যুক্ত রয়েছে যা সাম্প্রতিক সময়ে ধারণ করা। মিজানুল ইসলাম বলেন, প্রসিকিউশন যে কত অসত্য তথ্য জমা দিয়েছেন এটি তার প্রমাণ।
জেরা
আইনজীবী : বস্তু প্রদর্শনী-৭ হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সিডি প্রদর্শন করেছেন। এ সিডি কার নিকট থেকে সংগ্রহ করেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা : বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর নিকট হতে সংগ্রহ করি।
আইনজীবী : বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে কোন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বলতে পারবেন?
তদন্ত কর্মকর্তা : আমি জানি না।
আইনজীবী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কপি বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম তফসিলে সংযুক্ত আছে তা কি জানা আছে ?
তদন্ত কর্মকর্তা : আমার জানা নেই।
আইনজীবী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কপি আর কোন কোন কর্তৃপক্ষের নিকট সংরক্ষিত আছে তা জানা আছে ?
তদন্ত কর্মকর্তা : আমার জানা নেই।
আইনজীবী : বাংলাদেশ ফিম আর্কাইভ হতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের যে সিডি সংগ্রহ করেছেন তা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের অরিজিনাল সিডি কিনা বা তা এডিট করা হয়েছে কিনা সে মর্মে কোনো তথ্য সংগ্রহ করেছেন?
তদন্ত কর্মকর্তা: না।
এ পর্যায়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সিডিটি ট্রাইব্যুনালে রক্ষিত প্রজেক্টেরে দেখানোর আবেদন জানান।
এ সময় প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিলে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সিডি প্রদর্শনের বিরোধিতা করেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সিডিটি প্রদর্শন করা হয়। এসময় মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার প্রদর্শিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সিডির কয়েক জায়গায় এডিট করা হয়েছে। যা সংবিধানে পঞ্চম তফশিলে সন্নিবেশিত ভাষণের সাথে মিল নেই। পরে সিডি প্রজক্টরে প্রদর্শনে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সাথে ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত সিডি এবং সংবিধানে পঞ্চম তফশীলে বর্ণিত ভাষণের সাথে বেশ কয়েক জায়গায় গরমিল রয়েছে।
বেশ কয়েক জায়গায় কিছু কথা সিডিতে আছে কিন্তু সংবিধানে নেই। আবার বেশ কয়েক জায়গায় সিডিতে নেই এমন কিছু কথা সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সময় মিজানুল ইসলাম তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনকে প্রশ্ন করেন বঙ্গবন্ধুর মুল ভাষণের সাথে প্রদর্শিত সিডির ভাষণের সাথে মিল নেই এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সংবিধানে আছে এমন কিছু কথা সিডিতে নেই এটা সত্য। হয়তো বা এডিট হয়েছে। এসময় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম আবারো সিডি প্রদর্শনের আপত্তি দেন।
জবাবে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, আপনারা ট্রাইব্যুনালে যে ডকুমেন্ট দিবেন সে বিষয়ে ডিফেন্সের জানার বা বুঝার অধিকার আছে। তখন জেয়াদ আল মালুম বলেন, মাই লর্ড তাহলে আমাদের অপত্তিসহকারে তা নেয়া হোক। তখন সিডি প্রদর্শন আবারো শুরু করলে জেয়াদ আল মালুম বলেন, সংবিধানে আছে কিন্তু সিডিতে নেই সেটা যেমন নেয়া হচ্ছে তেমনি সিডিতে আছে কিন্তু সংবিধানে আনা হয়নি যেসব কথা তাও নেয়া হোক।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সংবিধানে আছে কিন্তু সিডিতে নেই সেটি আগে নেয়া হোক। তারপর সিডিতে আছে কিন্তু সংবিধানে নেই সেসব কথা নেয়া হবে।
এরপর আবার ভাষণ প্রচার করা হয় এবং গরমিল বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রেকর্ডে লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হয় এবং তারওপর প্রশ্ন করা হয়।
আইনজীবী : ‘নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলী বসবে। আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব।
এ দেশের মানুষ অর্থনীতি রাজনীতি ও সাংস্কৃতিকমুক্তি পাবে। ’ এই শব্দ ও শব্দগুলি সংবিধানের ৫ম তফসিলে সংযোজিত বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে উল্লেখ আছে। কিন্তু আপনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে ভিডিও সিডি দিয়েছেন এবং যা বস্তু প্রদর্শনী -৭ হিসেবে প্রদর্শন করেছেন তাতে এ কথাগুলো নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা : হয়তো বা এডিটের কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে।
আইনজীবী : ‘তার ন্যায্য কথা মেনে নিব’ এই কথাগুলির পরে সংবিধানে লেখা আছে ‘ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরও আলোচনা হবে।
তারপর অন্যান্য নেতদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম। এই শব্দ ও লাইনগুলিও আপনার সিডির ভাষণে নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা : সম্ভবত এডিটের কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে।
আইনজীবী : ‘তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা হবে’, তারপর হঠাৎ করে ১ তারিখে এসেম্বলী বন্ধ করে দেয়া হল’। ...“ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেম্বলী ডেকেছিলেন।
আমি বললাম, আমি যাব। ভুট্টো বললেন তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া হলো। দোষ দেয়া হলো বংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে।
বন্ধ করার পূর্বে দেশের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপনার ইচ্ছায় জনগন রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো।
তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। এই শব্দ ও বাক্যগুলি সংবিধানের ৫ম তফসিলে উল্লেখ থাকলেও আপনার প্রদর্শনী-৭ (ভাষণের সিডি) এ রেকর্ড করা নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা : সম্ভবত এডিটের কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে।
আইনজীবী : ‘টেলিফোনে আমার সাথে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দেখে যান আমার গরীবের উপর, আমার মানুষের উপর বুকের উপর গুলি করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে।
কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। ’ এই শব্দ ও বাক্যগুলি সংবিধানের ৫ম তফসিলে উল্লেখ আছে কিন্তু আপনি সে সিডি প্রদর্শন করেছেন তাতে সংবিধানের মত ধারাবাহিকভাবে না থাকলেও, এক লাইন পরেই রেকর্ড আছে।
তদন্ত কর্মকর্তা : সম্ভবত এডিটের কারণে হয়ে থাকতে পারে।
আইনজীবী : ‘আমি তো অনেক অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সাথে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সাথে বসবো?” এই শব্দ ও বাক্যগুলি সংবিধানের ৫ম তফসিলে সংযোজিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উল্লেখ থাকলেও আপনার দেয়া সিডির ভাষণে নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা : হয়তো বা এডিটের কারণে হয়ে থাকতে পারে।
আইনজীবী : বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রথম অংশে ঢাকা, চট্টগ্রাম শব্দের পর রাজশাহী, রংপুরে শব্দের আগে ‘খুলনা’ শব্দটি ভাষণে থাকলেও সংবিধানে নেই। এদেশের মানুষেকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ শব্দগুলির পর এবং এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা শব্দগুলির পূর্বে আপনারা আমাদের ভাই। আপনারা একেবার দেশকে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না।
জীবনে আর কোনদিন মুখ দেখাদেখি হবে না। যদিও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফয়সালা করতে পারি তাহলে অন্তত পক্ষে ভাই ভাই হয়ে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেই জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি আমার এ দেশে আপনারা মিলিটারী শাসন চালাবার চেষ্টা করবেন না। ’ এই কথাগুলি বস্তু প্রদর্শনী -৭ এ রেকর্ড করা থাকলেও সংবিধানের ৫ম তফসিলে বর্ণিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে বর্ণিত নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫ম তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ যেভাবে লেখা আছে হুবহু সেই ধারাবাহিকতায় বস্তু প্রদর্শনী-৭ প্রদর্শিত ভাষনের সেই ক্রমে নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।