আজ নিশীথের হৃদয় রাগে
তোমার আমার মিলন বাগে
বাজবে মিলন বাঁশি।
কথাগুলো ভাবতে দিপ্তির একদিকে আনন্দে হৃদয় থর থর কাঁপছে অন্যদিকে একটা ভয় এসে তার হৃদয়কে একেবারে থামিয়ে দিতে চাইছে। আজ দিপ্তির বাসর। স্বামীর কোলে মাথা রেখে তার অতীত জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টকে মুছে দেবে। তার নতুন দৃষ্টি শত আঘাতের মলিন মূর্ছিত দাগগুলোকে নতুন জীবনের স্বাদে ও আনন্দে আলোকিত করবে।
রাত বারটা। দিপ্তির অপেক্ষার প্রহর ঘন এবং গভীর হয়ে আসছে। হৃদয়ের আন্দোলিত ধ্বনি যেন অধিক হয়ে উঠছে। দিপ্তি ভাবছে এই বুঝি তার প্রাণের পুরুষ ঘরে ঢুকে খট করে দরজা বন্ধ করে দেবে। দিপ্তি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে একটা প্রণাম করবে।
কিন্তু কেউ এলে না। দিপ্তির কান্না পেল। দরজার আড়াল থেকে একজন বলল, “দরজা বন্ধ করে ঘুমে পড়। ” দিপ্তির বুকে কেউ যেন বজ্রবাণ ছুড়ে দিল। হৃদয়টা ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে কাউকে দেখার সুযোগ পেল না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। দরজা খুলে বাইরে এলো। পাশের ঘরের জানালা দিয়ে আলো দেখা যায়। হেঁটে জানালার কাছে গেল।
স্বামীকে সে ভালো মত দেখার সুযোগ পায়নি। দেখল জানালার বিপরীত দিকে একজন তাকিয়ে আছে। দিপ্তি দরজায় ধাক্কা দিল। নিশীথ জানালার কাছে গিয়ে দেখল নতুন বউ। ধীরে ধীরে দরজার কাছে এসে বলল, “আজ তোমার বাসর আর আমার বিরহ।
”
“তোমার বিরহের মাঝে আমাকেও নিয়ে নাও। বিরহের প্রদীপ দিয়েই আমার বাসর উজ্জ্বল করব। ”
“তুমি চলে যাও। ”
“স্বামী ছাড়া বাসর হয় না। বিরহই হয়।
তুমি আমাকে দূরে রেখ না। ”
“বাবা যদি এটা দেখে তবে কোন দিনই তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। ”
“এতো বড় শাস্তি আমাকে দিওনা। তোমার পায়ে পড়ি। একবার আমাকে নাও।
তোমার বিরহ দিয়েই আমার বাসর সাজাব। ”
“বলছি তুমি চলে যাও। আমাকে ঘর ছাড়া কর না। ”
“আমি ঘর বাধাঁর জন্যই এসেছি, ভাঙ্গার মত দুর্সাহস আমার নেই। ”
“যে প্রদীপ জ্বলবে না তাতে মিছা-মিছি তেল ঢেলে লাভ নেই।
”
“তেল প্রদীপের জন্যই সৃষ্টি। প্রদীপের সলিতা বেয়ে বেয়ে উঠে প্রদীপের অন্তর দহনই তার সুখ। সে সারা জীবন ভাবে কবে প্রদীপের আগুনে পুড়ে নিজেকে বিলিয়ে দেবে। প্রদীপের অন্তর গহ্বরেই তার সুখের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সে খুঁজে পায় পার্থিব জীবনের প্রশস্ত সুখ।
তুমি যদি আমাকে দূরে রেখে সুখী হতে পার, আমি দূরেই থাকব। আজ হতে আজীবন থাকবে আমার বাসর। তোমার বিরহ নিয়েই জ্বালাব সে বাসরের প্রদীপ। তোমার জন্য সারা জীবন খোলা থাকবে সে বাসরের দরজা। যদি কোন দিন সময় আসে দেখে যেও, দিপ্তি কেমন প্রদিপ্ত করে জ্বেলে রেখেছে তোমার সুদিপ্ত বাসর।
”
দিপ্তি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। বিছানায় বসে কাঁদল। মামী তাকে ঠিকই বলতো, “তুই দুনিয়ার অমঙ্গল। পৃথিবীর উপর শনি গ্রহ। ” কিন্তু কেন? কি দোষ সে করে ছিল? তার বধূ সাজ খুলে ফেলতে ইচ্ছে হলো।
সে কারো বিলাসে সাজতে চায় না। নিজের সুকোমল হৃদয় দিয়ে অন্যকে সাজাতে চায়।
রাত্রি ভোর হলো। দিপ্তি ঘুম থেকে জেগে স্বামীর ঘরে গেল। দরজা খোলা ছিল।
ঘরে ঢুকে ব্রাসে পেস্ট নিয়ে জগের উপর রাখল। নিশীথ নড়ল চড়ল না। দিপ্তি বেরিয়ে এলো। শ্বশুরকে চা দিয়ে স্বামীর জন্য চা আনতে দেখল ব্রাশ সে ভাবেই আছে। কোন লোক নেই।
শিউলিকে বলল, চা’র কেটলি গরম রাখতে।
একদিন দিপ্তিও ছিল শিউলির মত অবস্থানে। কিন্তু সে সময়টুকুও সুখের ছিল। মামীর দেয়া ব্যথা যতই কষ্টকর হোক না কেন মামার দেয়া আদরে সব মুছে যেত। কিন্তু স্বামীর সোহাগ মাখা নিমগ্ন আনন্দহীনতা কে মুছে দেবে? কেবল বৃষ্টির জলই চাতকের পিপাসা মেটাতে পারে।
দিপ্তির সে গোপন দহন গোপনেই ছাই হয়ে যায়। সে পোড়ায় জল দেয়ার কেউ নেই।
দিপ্তির স্বামীর সাথে দেখা হয় রাত বারটার পর। তা আবার জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে। দূরে জল দেখলে পিপাসিত হৃদয় যেমন পিপাসা বাড়ে তেমনি জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে দিপ্তির ক্ষুধার্ত হৃদয়ে কামনার বহ্নি জ্বলে ওঠে।
সঙ্গহীন হৃদয়টা আসঙ্গের লিপ্সায় ভরে ওঠে। জীবনের অযতেœ গড়ে ওঠা যৌবনের জ্বালাময়ী বিন্দু সিন্ধুর তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মত ঢলে পড়তে চায়। স্বামী তার কত কাছের অথচ্ কত দূরের। চোখ খুললে দেখা যায় হাত বাড়ালে ধরা যায় না। ও যেন চাঁদের জোছনা নিভৃতে জীবনকে আলিঙ্গন করে যায়।
ছয় মাস কেটে গেল। দিপ্তির বাসর সাজ আস্তে আস্তে ম্ল¬ান হয়ে এলো। কোন রাত হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঐ জানালার পাশেই কেটে গেছে। ঐ জানালাই যেন ওর সুখ, শান্তি, সান্ত্বনা। অতীত বর্তমান ভাবতে ভাবতেই সময়গুলো চলে যাচ্ছে।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত গড়িয়ে শীতে ভর পুর হয়ে উঠছে পৃথিবী। ভোরের শিশির বিন্দুতে সিক্ত হচ্ছে সবুজ ঘাস। চিকচিক রোদের আশায় যুবক বৃদ্ধ বসে আছে আঙ্গিনায়, খোলা স্থানে। দিপ্তি ঘরের জানালা খুলে তাকিয়ে আছে সুদূর পানে। হঠাৎ মনে পড়ল মহামায়ার মন্দিরে যাওয়ার কথা।
বেরিয়ে এসে শ্বশুরকে বলল, “বাবা, আমি মন্দিরে যাব। ”
“নিশীথকে নিয়ে যাও। ”
“ওর হয়তো কাজ আছে। ”
“ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি। ”
“ওর হয়তো সময় হবে না।
”
“হবে। ”
শংকর সেন নিশীথকে ডেকে বলল, “নিশীথ, বৌ’মাকে নিয়ে মন্দিরে যেতে হবে। তুমি গাড়ি প্রস্তুত কর। ”
দিপ্তি গাড়িতে এসে বসল। সামনের সীটেই বসতে চেয়েছিল।
কিন্তু সাহস পেল না। গাড়ি ছাড়ল। দিপ্তি পিছন থেকে স্বামীর পানে তাকাল। অবিরাম গতিতে গাড়ি চলছে। চারিদিকের পরিবেশ বড়োই মনোমুগ্ধকর।
দেখতে দেখতে দিপ্তির দুচোখ আনন্দে ভরে উঠল। হঠাৎ গাড়ি থামল। দিপ্তি সামনে তাকাল। দেখল সুন্দরী একটি মেয়ে। ও সামনের সীটেই বসল।
নিশীথের কাঁধের উপর মাথা এলিয়ে দিল। দিপ্তি সে দিকে আর তাকাল না। বাইরে তাকাল। এত সময় যে মৌন আনন্দ তা যেন উল্টো-পাল্টা হয়ে গেল। বাইরের ঘন ঘেরা মাঠ তাকে আর আবেগে উচ্ছ্বাসিত করতে পারল না।
তবুও তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ অট্টহাসির ধ্বনিতে দিপ্তি সামনে তাকাল। মেয়েটি ডান হাত দিয়ে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরছে। দিপ্তি তবু নীরব। গাড়ি ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে মন্দিরের কাছাকাছি এলো।
দিপ্তি নামল। খানিক দাঁড়াল। ভাবল তার স্বামীও নামবে। তাকে মন্দির পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। কিন্তু নামল না।
বলল, “পূজার পর আমি ফিরে আসব। ”
গাড়ি দিপ্তির সামনে দিয়ে চলে গেল। দিপ্তি ভাবল, দেবতার পায়ে পূজা দেওয়ার চেয়ে তোমার সাথে পথ চলাই ছিল আমার কাছে বড় আনন্দ। তুমি আমার সে আনন্দটাকে দেবতার পায়ে ঠেলে দিলে। এ আনন্দ পেতে হলে তোমাকেও দেবতার দুয়ারে আসতে হবে।
দিপ্তি ধীরে ধীরে মন্দিরের কাছে গেল। আঘাতে ভক্তি বৃদ্ধি পায়। দিপ্তি এক মনে বলল, “ঠাকুর, সবাই তোমাকে চায় কিন্তু আমি তোমাকে চাইতে আসিনি। আমি আমার মনের দেবতাকে চাই। যাকে ভালোবাসার আলিঙ্গনে পূজা করা যায়।
ভালোবাসা আর ভক্তি একই কথা নয়। কিন্তু ভালোবাসাহীন ভক্তি মিথ্যাচারিণীর সাধনা। আমার মনের মন্দির আজও ফাঁকা রয়ে গেছে। তুমি আমার প্রাণের দেবতাকে ফিরে দাও। জানি তুমিও আমাকে ভালোবাস না।
আমার দুঃখকে কেউ বুঝল না। কিন্তু আমি কার তরে নিজেকে বিলিয়ে দেব? তুমি আমাকে আর কত কাঁদাবে ঠাকুর? আমার চোখের জলতো ফুরিয়ে আসছে। এরপর আমি কি নিয়ে থাকব। আমার চোখের জলে ভেঁজা একটা ফুলও কি তোমার পা স্পর্শ করেনি? নাকি তুমি কেবলি পাষাণ? তবে এতো লোক কেন পাষাণীর পায়ে লুটে পড়ে?”
দিপ্তি ফিরে এলো। গাড়ি ফিরে এসেছে।
ও এবার স্বামীর পাশাপাশি বসল। নিশীথ একই ভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দিপ্তি নীরবে তাকিয়ে আছে। তার হৃদয়ে কোন হিংসা নেই, কোন বিদ্বেষ নেই। ফাঁকা মাঠের ভিতর একটা গাছ দেখে দিপ্তি বলল, “একটু থামাও।
”
গাড়ি থামল।
“চলো না, একটু নামী। ”
দিপ্তি নেমে খানিক দাঁড়াল। নিশীথ নামল। গাছের পাশ দিয়ে চিকন নদী।
জলের শীতল হাওয়া ভেসে আসছে। দিপ্তি খানিক এগিয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করল। উনি যেন হাঁটতে শক্তি পাচ্ছে না। চোখের জ্যোতি যেন কখনও দিপ্তির পানে পড়ে না। গাছের নিচে গিয়ে দিপ্তি বলল, “একটু বসি?” দিপ্তি বসল কিন্তু নিশীথ বসল না।
দিপ্তি আবার বলল, “বসো। ” নিশীথ যেন এবার একটু তাকাল। বসার মত জায়গা কম। বসতে হলে দিপ্তির গা ঘেষে বসতে হবে। তবু বসল।
তবে মুখ বিপরীত দিকে। দিপ্তি এতোদিন পরে আজ স্বামীকে সবচেয়ে কাছে পেল। স্বামীর উল্টো দিকে না থেকে তার উরুর উপর হেলান দিয়ে মুখের পানে তাকাতে চাইল। কিন্তু স্বামী যদি রাগ করে । কি হবে এতোটুকু আদরের? জোর করে অধিকার আদায় করা উচিত।
কিন্তু ওর উপর জোর করবে না। তাকে যা দেবে তাই নিয়েই সে সাজাবে তার চলার পথ। দিপ্তি স্বামীর দিকে ঘুরে বসল। স্বামীর হাতখানা হাতের ভিতর পড়ল তবু শক্ত করে ধরল না। বলল, “আকাশটা কেমন?”
“মরুর বুকের বালুর মত দগ্ধ।
”
“পিপাসিত নয়?”
নিশীথ একটু দিপ্তির পানে তাকাল। এই প্রথম যেন দিপ্তিকে দেখল। দিপ্তির আখিঁ যেন নদীর জলের মত ভাসমান। বলল, “যাদের পান করার সাধ তারাই পিপাসিত। ”
“যার পিপাসা নেই সে তো দগ্ধ নয়, বরফের মত শীতল।
”
দিপ্তি স্বামীর পানে তাকাল। বুঝল উনি বিরক্ত বোধ করছে। বলল, “আমি তোমার স্ত্রী, তোমার অমঙ্গল চাই না। কোন কিছুর বিনিময় তুমি যদি সুখ খুঁজে পাও আমার কাছে চেও। আমি তোমাকে না বলব না।
তুমি আমাকে যতবারই ফিরে দাও আমি জানব সে আমার প্রাপ্য। সেই পাওয়ার আশাই আমাকে নিয়ে চলছে নতুন পথে। সে চলা অন্তহীন। দিনের পর দিন রাতের পর রাত। ” দিপ্তি খানিক নীরব থাকল।
তারপর বলল, “চলো। ”
আজ কেন জানি দিপ্তির ঘরে মন টিকছে না। একটু খানিক পাওয়া যেন আরো একটু খানি পাওয়ার আশাকে বাড়িয়ে দেয়। মানুষ বলে ভালোবাসা মনের সাথেই হয় দেহের সাথে হয় না। তাদের ধারণা ভুল।
দেহই ভালোবাসাকে গভীরে নিয়ে যায়। শিশু এবং বৃদ্ধার সাথে ভালোবাসা হয় না যে ভালোবাসা আকর্ষিত। আকর্ষণ আছে বলেই ভালোবাসা হয়। ভূতের সাথে ভালোবাসা হয় না। কারণ ভূতের দেহ নেই।
দেহের কামনাই ভালোবাসার প্রদীপে তেল দিয়ে ভালোবাসার প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখে। জানালার আড়ালে দিপ্তির প্রদিপ্ত কামনা জ্বলে ওঠে। দেহ শীতল কিন্তু সঞ্চালিত। স্বামীর ঘরের দরজা ঠেলা দিয়ে দেখল দরজা খোলা। টিপটিপ পায়ে ঢুকে গেল।
জানালা দিয়ে মাঘের হাড় কাঁপানো কনকনে শীত ঢুকছে। দিপ্তি লেপটা আস্তে আস্তে স্বামীর গায়ের উপর দিয়ে উঠিয়ে দিল। মাথার চুলগুলি হাত দিয়ে সাজিয়ে দিল। মুখের পানে নীরবে তাকিয়ে থাকল। কপালের সাথে ঠোঁট মিশাতে ইচ্ছে হলো কিন্তু পারল না।
এগিয়ে থাকা অশ্র“গুলি টপটপ করে নিশীথের মুখের উপর ঝরে পড়ল। নিশীথ চোখ খুলল। দিপ্তির পানে তাকাল।
“তুমি! কেন এসেছো? বলছিনা এ ঘরে আসবেনা। ”
দিপ্তি কোন জবাব খুঁজে পেল না।
ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে চাইল। নিশীথ বলল, “শোন, কাল আমার বিয়ে। ”
দিপ্তি ঘুরে দাঁড়াল। “তুমি বিয়ে করবে? তুমি যদি বিয়ে করে সুখী হতে পার আমি বাধা দেব না। কিন্তু কেন? কি ছিল না আমার? আমি কি পারি না কেন তা যাচাই করলে না? একটা দিন, একটা রাত, এমন কি একটা মুহুর্তও তুমি আমাকে স্ত্রী ভাবতে পারলে না।
অনেকগুলো ব্রহ্মমন্ত্র পাঠ করে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলে। ব্রহ্মার একই মন্ত্রে কিভাবে একজন আদরে আরেক জন অনাদরের। তাকেও আদর দেয়া যেত। আমি তোমাদের রাজ প্রাসাদের ভালোবাসা চাইনি। মন্দিরের দেবতাকেও চেয়েছিলাম না।
চেয়েছিলাম আমার প্রাণের পুরুষকে। কিন্তু ভগবান আমাকে একটা কিছুই দিতে জানে। সে হলো আঘাত। তুমি বলো, কিভাবে আমি এতো আঘাত সহ্য করব? জীবনে কোন দিন প্রতিবাদ করতেও শিখিনি। সব আঘাতকে নীরবে মেনে নিতে শিখেছি।
আমি ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। কিন্তু কেউ আমাকে ভালোবাসা দিল না। তুমি স্বামী; পাওয়ার প্রধান অবলম্বন। তুমিও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে। আমার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করলে।
ছোট বেলায় মা-বাবা ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে, যৌবনে তুমি, শেষ জীবনে ফাঁকি দেওয়ার মত কেউ সৃষ্টি হলো না। বাকি থাকল ভগবান। উনিতো আমাকে চিরদিনই ফাঁকি দিয়ে গেলেন। আমাকে ফাঁকি দেওয়ার মাঝেই যেন সবার আনন্দ। ” দিপ্তি চোখের জল মুছে, “যাই হোক, তোমার বিরহ মুছে বাসর হোক।
মিলনের মধুর বাঁশি বাজুক। ভালোবাসার আলিঙ্গনে ফুটুক হৃদয় কুসুম। আমি স্বপ্ন লোকে তার সুরভী নিয়ে জীবন সাধনায় মগ্ন থাকব। ”
দিপ্তি ধীরে ধীরে নিজের কক্ষে গেল। মনে মনে বলল, “ভগবান, সত্যিই তুমি বিচিত্র।
তোমার তরে আমার এতটুকুই পাওনা ছিল। আমি আমার পাওনা পেয়ে গেছি। আর বেশি দিওনা। আমি যে ঋণ শোধ করতে পারব না। ”
সকালে দিপ্তি ঘুম থেকে উঠে সব কিছু গোছাতে লাগল।
নিজেও একটা সুন্দর শাড়ি পরল। ও খুবই ব্যস্ত। কিন্তু কেন? কেউ তা জানে না। মা’র গলার হারটা আজ গলায় পরল। মনের অজান্তে কখন যেন স্বামীর ঘরে ঢুকে গেল।
টেবিলের কাপড় টান দিতেই কাঁচের গ্ল¬াস পড়ে পা কেটে গেল। ক্লান্তি লাগল বড় ক্লান্তি। গ্ল¬াসের কাঁচগুলো খুঁটতে খুঁটতে মাথাটা টেবিলের সাথে এলিয়ে দিল। খানিক পরে চোখ খুলল। দেখল নিশীথ ঘরে বসে আছে।
তড়িঘড়ি করে উঠতে চাইল। টেবিলের সাথে আর একটা ধাক্কা খেল।
নিশীথ কাছে এসে, “এ সব কি হচ্ছে?”
“বারে, আজ না তোমার বিয়ে? আমি সব কিছু গোছগাছ করছি। আমি ছাড়া তোমার বাসর কে সাজিয়ে দেবে বল? আমিতো বাসর সাজাতেই এসেছি। ” দিপ্তির অজান্তেই যেন চোখের জল গড়িয়ে গেল।
“আর কেউ তোমার বাসর সাজাতে আসবে না। আর আমি থাকতে কেনইবা আসবে?” দিপ্তি হেসে, “অথচ্ দেখ, পা’টা খানিক কেটে গেল। আজ না কাটলেও পারতো। ”
দিপ্তি রক্ত মাখা পায়ে বেরিয়ে গেল।
নিশীথ ভাবতে পারল না কি হচ্ছে।
যাকে সে চায় না সে তাকে জড়িয়ে ধরছে। ও বুঝি পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু স্টামে সই না করলে শ্বেতা তাকে বিয়ে করবে না। দিপ্তি যদি সই না করে শ্বেতা হৃষিকেশের হয়ে যাবে। যে কোন মূল্যেই হোক শ্বেতাকে সে চায়।
শ্বেতাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না।
দিপ্তি কক্ষে বসে মাথা আঁচড়িয়ে সিঁদুর পরছে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখল নিশীথ। দিপ্তি উঠে একটা প্রণাম করল। নিশীথ ঘুরে দাঁড়াল।
স্টামটা বের করে, “এখানে একটা টিপ সই দাও। ”
দিপ্তি নিশীথের আরো কাছে এলো। বলল, “সত্যিই কি তুমি আমাকে ত্যাগ করে দিতে চাও?”
“বলছিতো। ”
“আমার দিকে একবার তাকিয়ে বল। একটা টিপ কেন আমি এক হাজার সই করব।
”
“তাড়াতাড়ি দাও। ”
“একবার মাত্র অনুরোধ করছি। আমার দিকে তাকাও। ”
নিশীথ মাথা ঘোরাল। দিপ্তির সিঁথির সিঁদুর খাঁ খাঁ করছে।
“তুমি বল, আমি কোথায় যাব?”
“যেখানে খুশি। ”
“দাও। ” দিপ্তি স্টাম ধরে, সত্যিই বলছো তো? আমি সই করব? দাও। ”
দিপ্তি কলম ধরে নিশীথের দিকে তাকিয়ে থাকল। কলমটা স্টামের উপর ধরে গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নামটা লিখে দিল।
বলল, “আমার সিঁদুর মুছে দেবে না? দেখবে না আমার বিধবা রূপটা কেমন দেখায়? আমি কেমন অসহায় হয়ে নিষ্ঠুর ভাগ্যের প্রতি তাকিয়ে থাকি? দাও! এতটুকু কেন বাকি রাখবে। ”
“ওটা এমনিতেই মুছে যাবে। ”
দিপ্তি স্টাম এগিয়ে দিল।
নিশীথ বেরিয়ে গেল। শ্বেতা তার জন্য অপেক্ষায় আছে।
কিন্তু সব ভুল। নিশীথ দেখল নিদির্ষ্ট জায়গায় কেউ নেই। তাহলে শ্বেতা তাকে ফাঁকি দিয়েছে? শ্বেতা তাকে ফাঁকি দিতে পারে? নিশীথ আরো একটু পথ হাঁটল। শ্বেতা হৃষিকেষের কোলে মাথা রেখে হাসছে। রাগে নিশীথের মাথা ফুলে উঠছে।
ভাবছে এই মুহুর্তে ওদের দু’জনকেই পৃথিবীর আলো থেকে দূরে ঠেলে দেবে। কিন্তু থমকে দাঁড়াল।
শ্বেতা হৃষিকেশের কাছে বলল, “নিশীথের কাছে আমার প্রয়োজন শেষ। আমার যা দরকার ছিল সব কিছু নিয়ে নিয়েছি। নিশীথকে আমার দরকার নেই।
নিশীথের সাথে যে ভালোবাসা সে হলো আমার সৌন্দর্যের বিলাস। যারা বিলাস দিয়ে নারীকে জয় করতে চায় তারা কাপুরুষ। আমি কাপুরুষকে স্বামী ভাবতে পারি না। তোমাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। আমার নারী জীবনের সাধনায় তুমিই প্রকৃত পুরুষ।
”
নিশীথের মাথা যেন ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল। ও ভাবতেই পারল না যে নারীর মন এমন। একজন তার সব কিছু দিয়ে তাকে আবিষ্কার করতে চাইল আরেক জন সব কিছু কেড়ে নিয়ে হারিয়ে গেল। মনে মনে বলল, “শ্বেতা, তুমি আমার কাছ থেকে যা নিয়েছ আরো নিতে। আমি তোমাকে আরো দিতাম।
কিন্তু আরেক জনকে বঞ্চিত করতে গেলে কেন? আমি যে কাপুরুষ তুমি তা বুঝিয়ে দিয়েছ সে ভালো। কেন এ কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেলে না যে, আলেয়া তো খনিক আলোর নিশানা। প্রকৃত আলো ক্ষণিকে নেভে না। ”
নিশীথ দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো। দিপ্তির ঘরে গেল।
দিপ্তি নেই। বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, “নিশীথ, যে বাড়িতে লক্ষ্মী থাকে না আমি সে বাড়িতে থাকি না। তোমার জন্যই হয়তো এত কিছু করে ছিলাম। আমার জন্য করলে ঘরের লক্ষ্মী এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারত না। চলি।
”
নিশীথ টেবিলের দিকে এগিয়ে দেখল একটা কাগজ। কাগজটা উঁচু করতেই একটা স্বর্ণের হার পড়ে গেল। এ হারটা সকালেও দিপ্তি গলায় পরে ছিল। কাগজটার ভাঁজ খুলল।
“আমার আসুক যত বিরহ শোক
তোমার মিলন মধুর হোক।
”
দিপ্তি। ”
নিশীথ আস্তে আস্তে বসে পড়ল। দিপ্তির জলে ভরা চোখ তার চোখে ভেসে উঠল। পাগল দিপ্তি হয়েছিল না, পাগল তাকে করে গেছে। ও এখন সত্যিকারের পাগল।
নিশীথের শক্তি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ও দাঁড়াতে পারল না। চৌকির খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে ভাবছে, কত সহজেই সে আমার দুঃখকে মেনে নিল। যে পরের সুখের জন্য নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিল আমি একবারও তার দুঃখকে মুছে সুখ দিতে পারিনি। আমার প্রেম সে ঐ দুশ্চরিত্রাণী শ্বেতার সাথেই মানায়।
দিপ্তির প্রদিপ্ত ভালোবাসার কাছে নয়। আসল আর নকলের তফাৎ সেখানেই। নিশীথ স্টামখানা ছিড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু তাতে যে দিপ্তির দেওয়া টিপ চিহ্ন ও গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নাম লিখে গেছে। দিপ্তির দেওয়া ছাড়পত্রই যেন অকথিত ভালোবাসার সৃষ্টি।
সে স্মৃতি চিরকালের অহংকার, যা কোন দিন ম্ল¬ান হবে না। যাকে সে কোন দিনই কামনা করেনি সেই তার সর্বাঙ্গের অলংকার। দিল মুক্তি হলো বন্ধন। চাইল সুখ পেল বিরহ। চাওয়ার সাথে পাওয়ার এমনই মধুর সম্পর্ক।
যেদিন ছিল বিরহ সেদিনই ছিল যেন সত্যিকারের বাসর।
রাত গভীর। নিশীথ শূন্য ঘরে বসে আছে। এতদিন ও একাই ছিল কিন্তু শূন্যতা ছিল না। দিপ্তিই যেন তার পূর্ণ জীবনের প্রতিমা।
সবার জীবনকে আনন্দে ভরে নিজেই কেঁদে কেঁদে চলে গেল। হঠাৎ যেন নিশীথের দরজা খুলে গেল। ভাবল দিপ্তি বুঝি ফিরে এসেছে। সেতো আমার সুখ চায়। আমার বাসর কেমন হয় দেখতে এসেছে।
ওতো আমাকে ভুলে থাকতে পারে না। কিন্তু কেউ এলো না। এক ঝাঁক দমকা হাওয়া এসে নিশীথের দরজা খুলে দিয়েছে। নিশীথ উঠল। বেরিয়ে আসতে হঠাৎ পায়ে ব্যথা করে উঠল।
দিপ্তির অজান্তে ভাঙ্গা গ্লাসের একখণ্ড কাঁচ রয়ে গেছে। নিশীথ চেয়ে দেখল দিপ্তির পায়ের রক্ত ফোঁটা প্লাস্টারের সাথে লেপ্টে আছে।
“তোমার আমার মিলন হলো রক্তে রাঙ্গা পায়ের নিচে। ”
নিশীথ রক্তকে বাধা দিল না। ধীরে ধীরে দিপ্তির ঘরে গেল।
বলল, “দিপ্তি, যে রক্ত ঝরিয়ে তুমি বেরিয়ে গেছো সে রক্ত মেখে আমি এসেছি। কিন্তু এমন সময় এলাম যখন তুমি বাসরের সাজ খুলে চলে গেছ অনেক দূরে। তুমিতো কথা দিয়েছিলে, প্রতিদিনই তোমার বাসর সাজানো থাকবে। আমার যখন খুশি আসব। আমিতো এসেছি।
তুমি চলে গেলে কেন?”
একের পর এক ভোর হতেই আছে। চলছে দিনের পর দিন। জীবনে যাকে বেশি প্রয়োজন সেই একদিন সবচেয়ে দূরে চলে যায়, বেশি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। শ্বেতাকে আজকাল আর মনে পড়ে না। সে যেন একদিনেই মুছে গেল।
অথচ্ তাকে প্রয়োজন ছিল সারা জীবনে।
সেদিন ডাকে একটা বই এলো। নিশীথ খুলে দেখল, “শিশির হলো সিঁদুর, দিপ্তি। ” সবাই বলেছিল দিপ্তি লেখা পড়া জানে না। ওর মামাও তাই বলেছিল।
তবে সবাই মিথ্যাবাদী? দিপ্তি তার প্রদিপ্ত আলো দিয়ে সবাইকে আলোকিত করল। আমিতো নিশীথ, মধ্যরাতের আঁধার। দিপ্তির দিশারী আলো আমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। আমি কামনা করি, ও যেন সবার মাঝে আমাকে চিনতে পারে, অনেক লোকের ভিড়ে আমাকে ভুলে না যায়। অন্তত ক্ষমাটুকু চেয়ে নেব।
নিশীথ আজ ভিকারি, সন্ন্যাসী। যে ধর্ম ছিল নিশীথের জীবনের বাইরে আজ নিশীথ সে ধর্মের আঙ্গিনায়। ঘর ভেঙ্গে গেছে হয়েছে সন্ন্যাসী। খুঁজে নিয়েছে ধর্মের আখড়া। ধর্মই সন্ন্যাসীর প্রেম।
বিশাল গ্রাম ধর্ম সভা। নিশীথ বক্তব্য দেবে। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দেখল দিপ্তি। মনটা তার কোমল হয়ে গেল। বলল, “ধর্ম কাকে বলে আমি জানি না।
জানি ভুলে ভরা সংসার। একটা ভুল পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি ধর্ম পথে এসে গেছি। এই গেরুয়া বসনকে করেছি জীবনের সঙ্গী। ভুল সবার জীবনেই হয়। তবে সবার জানা উচিত, যারা ভুল করে তারা বোঝে না।
তাকে ক্ষমা করে দেওয়াই ধর্ম। আমি আমার ভুলের সংশোধন করার জন্যই এপথ বেছে নিয়েছি। যদি কারো স্পর্শে জীবনের কিছুটা পাপ মুছে যায়। সংসার ছাড়া ধর্ম হয় না। কিন্তু আমাকে নিয়ে সংসারও হয়নি।
সংসার হয়নি বলে আমি সন্ন্যাসী। সন্ন্যাস জীবন আমার কাম্য নয় কিন্তু প্রাপ্য। পাওনা ধন ফেলে দিতে নেই। আমি আমার সাধনার ধন পেয়েছি। আশীর্বাদ করবেন যেন সঙ্গে করে জীবনের পর প্রান্তে পৌঁছাতে পারি।
”
ধর্ম সভা ভেঙ্গে গেল। দিপ্তি ভাবল, এই তার স্বামী, সন্ন্যাসী ঠাকুর। সন্ন্যাসীর পায়ে একটা প্রণাম করতে দিপ্তির বড় সাধ হলো। মন্দিরের মাঝের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বলতে থাকল,
“যদি কোন দিন তোমার আসনে
আর কাহারেও বসাই যতনে
চির দিবসের হে রাজা মোর
ফিরিয়ে যেয়োনা প্রভু। ”
“নমষ্কার।
”
দিপ্তি মাথা ঘুরিয়ে দেখল সন্ন্যাসী ঠাকুর। দিপ্তির চোখে জল ভরে উঠল।
“দিপ্তি, আমি তোমার স্বামী। ”
“সে অধিকার মুছে গেছে। যা মুছে দাওনি তাই ধরে রেখে ছিলাম।
কিন্তু তাও ধীরে ধীরে আমাকে মুছে দিচ্ছে। ”
“তোমাকে একটা অনুরোধ করি। ”
“কেন?”
“জানি না তো। ”
“আর কিছু বাকী আছে?”
নিশীথ একটু নীরবে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকি দিল “না। ” নিশীথ পিছন ফিরে চলতে শুরু করছে।
“শুনুন। ”
নিশীথ ঘুরে দাঁড়াল।
দিপ্তি একটু হেঁটে এলো। “বলুন কি বলবেন?”
“না থাক। আমাকে ক্ষমা করে দিও।
”
“বলুন আমি চেষ্টা করব। ”
“মানুষ বংশ রক্ষার জন্য পুত্রকে কামনা করে কিন্তু আমি পিতাকে কামনা করছি। লক্ষ্মীহীন গৃহে আমার পিতা বাস করেন না। আমি সন্ন্যাসী। সে সন্ন্যাসী বেশ হয়তো কাউকে খুঁজে ফিরছে।
তুমি যদি আমার কাছে না আস আমি তোমাকে আসতে বলব না। শুধু একটা অনুরোধ, তুমি আবার সিঁদুর পর। সে সিঁদুর আমার না হলো তোমার দেবতারই হোক। ”
“যে সিঁদুর ভোরের উজ্জ্বল শিশির বিন্দুর মত আমার জীবনে উদয় হয়ে সূর্যের তাপের মত দহনে ধীরে ধীরে মুছে গেছে তাকে আবার কিভাবে পুনঃস্থাপন করব?”
“আর কোন দিন ফিরব না। তোমার সাথে আর কোন দিন দেখাও হবে না।
তোমাকে দেখে আমার সন্ন্যাস জীবন স্বার্থক হলো। যাকে খোঁজার জন্য আমি এই গেরুয়া বসনকে অঙ্গে জড়িয়ে এতকাল কেবল ভগবান নয় ভিকারির দ্বারেও ঘুরেছি আজ তাকে আমি পেয়েছি। পাওয়ার অনুভূতি যে কেমন তা আমি উপলব্ধি করতে চাই না। এতকাল ঘুরে ঘুরে শুধু এই তথ্যই পেয়েছি যে, মানুষকে ভালোবাসা দিতে হবে। ভালো ভাবে বাঁচার জন্য একটা সুকোমল হৃদয়ের ভালোবাসার দরকার।
মানুষ সেই ভালোবাসার অভাবেই বৈরাগ্য হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরে। ভালোবাসা চায়। আমি আমার ভালোবাসার সীমা ছেড়ে এসেছি। মানুষ নারীর মোহকে ত্যাগ করার জন্য সন্ন্যাসী হয় আর আমি নারীর বিরল সুধার খোঁজে সন্ন্যাসী সেজেছি।
হতে না পারি সেজেছি এই-ই ছিল তোমার কাছ থেকে আমার পরম পাওনা। চলি। ”
“দাঁড়াও। দেখবে না আমাকে কেমন দেখায়?”
“যে রূপ আমি আমার অন্তর আলপনায় একেঁছি তাকে ওখানেই রাখতে চাই। তাছাড়া সে অধিকার মুছে গেছে।
”
“তা হলে তুমি ফিরবে না?”
“অনেকগুলো ব্রহ্মমন্ত্র পাঠ করে সত্যের অঙ্গীকার দিয়েও আমি একজনকে কেবল দুঃখই দিতে পেরেছি। আজ এই গেরুয়া বসনকে ত্যাগ করে আরেকটা সত্যকে মিথ্যা করে নিজেকে সুখী করতে চাই না। এই পোশাক জড়ানোর সময় তোমার দেবতার কাছে প্রার্থণা করে ছিলাম, আমার এই দুটি চোখ বুজে যাওয়ার আগে যেন তোমাকে দেখতে পারি। আমার জীবনে আর কোন প্রার্থণা নেই। তোমার যদি কিছু দিতে ইচ্ছে করে আমাকে সত্যিকারে সন্ন্যাসী সাজিয়ে দাও।
তোমার সে সাজ আমি কোন দিন খুলব না। দ্বারে দ্বারে তোমার নাম বিলিয়ে দেব। ”
“আমি পারব না ঠাকুর। তুমি আমাকে এর জন্য ক্ষমা করে দিও। বিষ্ণু প্রিয়াকে ফাঁকি দিয়ে নিমাই যেমন চলে গিয়েছিল তুমিও কেন ফাঁকি দিলে না?”
“সারা জীবনতো ফাঁকি দিয়েই গেলাম।
তাই শেষ বেলা একটু ধরা দিতে এলাম। ”
“যে ধরা স্পর্শের বাইরে তা আমি চাইনি। আমি আমার সংসার চেয়েছি, আমি আমার স্বামীকে চেয়েছি। আমি গেরুয়া বসনকে চাইনি। আমার স্বামী আমার কাছে এমনিই ঈশ্বর, তাকে গেরুয়া বেশে দেখতে চাই না।
”
“দিপ্তি, তোমার স্পর্শহীন আলোতে আমার যতটুকু আলোকিত হয়েছে তা আমার শত জনমের সাধনা ছিল। চোখের জলে তার সমাধি হলো। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। চোখের জলে বুক ভিজিয়ে স্বামীর স্পর্শ পেতে চেওনা। চলি, নমষ্কার।
”
নিশীথ চলে গেল। পায়ের গতি ধীর। মন্দিরের সীমানায় দাঁড়িয়ে আবার পিছন ফিরে তাকাল। নিচের দিকে তাকিয়ে শুরু করল পথ চলা। অন্তহীন জীবনের খোঁজে।
দিপ্তি ঘরে এসে কাঁদল। কেন ওকে সন্ন্যাসী সেজে দিলাম না? মামাকে কথা দিয়েছিলাম, স্বামীর সব আদেশ মাথা পেতে নেব। কেন শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করলাম না? দিপ্তি উঠে এসে জানালা দিয়ে তাকাল। সন্ন্যাসী ঠাকুরকে আর দেখা যায় না। রাত্রি নেমে আসছে।
মন্দিরের জয় ধ্বনিতে চারিদিক মেতে উঠছে। দিপ্তি জানালা ছেড়ে মন্দিরে এল। ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য সাজিয়ে বলল, “ভগবান, তুমি যত মধুর তত কঠিন। আমি সিঁদুর পেয়েছি কিন্তু স্বামী পেলাম না। ঘর পেলাম সংসার হলো না।
আমিতো ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি, তুমি কেন ক্ষমা করলে না? কেন ওকে ঘর ছাড়া করলে? কেন ওকে পথে পথে ঘুরাছো? সংসারের স্বপ্ন নিয়ে যারা জন্মে তারা সন্ন্যাসী হয় না। ওকে তুমি আবার আমার কাছে ফিরে দাও ঠাকুর। আমি ওর সব পাপ ধুয়ে মুছে দেব। আমার দেবতাকে কষ্ট দিওনা ঠাকুর। আমার মনের মন্দির থেকে আমার দেবতাকে কেড়ে নিও না।
”
সারা রাত দিপ্তির ঘুম এলো না। মা, মামী, স্বামী সবাই যেন তাকে মুক্তি দিয়েই শান্তি পেল। কেউই বন্ধনে বেঁধে রাখতে চাইল না। যাদের দুঃখ জন্মে তাদের সুখ মেলে না। মামা বলেছিল, “যারা বেশি আঘাত দেয় তারাই ভালোবাসা শিখায়, বেশি ভালোবাসে।
ভালোবাসা ছাড়া আঘাত দেওয়া যায় না। ”
ভোর হলো। দিপ্তি øান করল। যে শাড়িটা পরে স্বামীর ঘর ত্যাগ করেছিল সেটা পরল। সিঁদুরের কৌটা এনে সিঁদুর পরল।
আয়নার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গেল। দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ল।
১০.০৫.০৫ইং
ডায়না প্যালেস
কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা ১৩১০।
দুই
মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি। মাথার চুলও অনেক বড়।
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। গেরুয়া বসন পরা একজন সন্ন্যাসী শংকর সেনের বাড়ি ঢুকল। প্রধান গেট পার হয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “মা, কিছু ভিক্ষা দেন। ”
শিউলি ভিকারির জন্য একটি পাত্রে কিছু চাল নিয়ে এলো। সন্ন্যাসী চালগুলো ব্যাগের ভিতর রাখতে রাখতে বলল, “একটু জল।
”
দিপ্তি শিউলিকে ডাকল। শিউলি বলল, “উনি জল খাবেন। ”
শিউলি ভিতরে ঢুকে গেল। দিপ্তি এক গ্লাস জল নিয়ে এলো। সন্ন্যাসীকে দিতে হাত হতে পড়ে গেল।
সন্ন্যাসী দিপ্তির পানে তাকাল। দিপ্তি সন্ন্যাসীর পানে তাকিয়ে আছে। সন্ন্যাসী এবার ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
শিউলি বলল, “বৌদি, সন্ন্যাসী চলে গেল। ”
দিপ্তি যেন অবাক পৃথিবীতে প্রবেশ করল।
ছুটে গিয়ে বলল, “সন্ন্যাসী ঠাকুর। ”
সন্ন্যাসী দাঁড়াল।
“জল খাবেন না ঠাকুর?”
সন্ন্যাসী ফিরে এলো। শংকর সেন বলল, “বৌমা, ওকে মন্দিরে বসতে দাও। আমি নিচে নেমে আসছি।
”
সন্ন্যাসী মন্দিরে বসল। দিপ্তি একপাত্রে কিছু খাবার আরেক পাত্রে কিছু পরিমাণ জল নিয়ে এলো। সন্ন্যাসীর সামনে প্লাস্টারের উপর বসল। শংকর সেন বলল, “তোমার কে কে আছে বাবা?”
“আমি সন্ন্যাসী। পৃথিবীর সবাই আমার কিন্তু আমি কারো নই।
আমি ঈশ্বরের এক নামহীন ভক্ত। ”
বৃদ্ধ চশমা জোড়া নামিয়ে, “সন্ন্যাস আমার সংসারটাকে শূন্য করে দিয়েছে। ”
“সন্ন্যাসের শক্তি নিয়ে যে জন্মায় সে সংসারে থাকতে পারে না। ”
দিপ্তি নীরবে বসে আছে। ওর মনটা কোমল।
সন্ন্যাসীর দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে, সন্ন্যাসীর পানে তাকিয়ে আছে। সন্ন্যাসী বলল, “আমি অন্যের হাতের রান্না গ্রহণ করি না। ”
দিপ্তি থালা নিয়ে গেল। ঘর থেকে চাল, ডাল নিয়ে এলো। সন্ন্যাসীকে বলল, “আমি সব কিছু গুছিয়ে দেই?”
সন্ন্যাসী আবার দিপ্তির দিকে তাকাল।
বৃদ্ধ বলল, “আজ, এখানে থাকবে। এ মন্দির আমি আমার সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য তৈরি করছি। আমার বৌ’মার তীর্থস্থান। আমার বৌ’মার জীবনের রাজ সিংহাসন। ”
বৃদ্ধ চলে গেল।
সন্ন্যাসী রান্না চড়িয়ে দিল। গরমের তাপে ওর গা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে। দিপ্তি সন্ন্যাসী ঠাকুরের জন্য øানের জল ভরে রাখছে। সন্ন্যাসী রান্নার পর øান করল। নতুন একটা গেরুয়া বসন পরে কপালে তিলক কাটল।
খাওয়ার পর মন্দিরের বারান্দায় বসল। দিপ্তি শিউলিকে বলল, “টেবিল ফ্যানটা নিয়ে আয়। ”
সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঘুম ঘুম ভাব আসছে। দিপ্তি একটা বালিশ এনে জিজ্ঞেস করল, “সন্ন্যাসী ঠাকুর, সুখ কি?”
“সুখ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই অথবা যা আছে সবই সুখ দুঃখ বলে কিছু নেই। ”
“দুঃখকে আমি চিনি।
তোমার কাছ থেকে একটু সুখের খবর নিতে চাচ্ছিলাম। সুখের সন্ধান আমি পেলাম না। ”
সন্ন্যাসী ঠাকুর আস্তে আস্তে ঢলে পড়ছে। দিপ্তি চলে গেল। ওর ঘরে এসে চুপ করে বসল।
একাকি খানিক সময় হাসল।
সন্ধ্যা নেমে এলো। চারিদিকে আঁধার হাত পা মেলে জায়গা করে নিচ্ছে। দিপ্তি মন্দিরে প্রবেশ করল। সন্ন্যাসী ঠাকুর ঘুম থেকে জেগে হাত মুখ ধূয়ে মন্দিরের পাশে বসল।
দিপ্তির ঊলূর ধ্বনিতে মন্দির যেন থর থর করে কাঁপছে। আকাশে বাতাসে মিলে গেল একটা আওয়াজ।
সন্ন্যাসী ঠাকুর মন্দিরের বাইরে আর কোথাও গেল না। বালিশটা মাথায় দিয়ে মন্দিরের ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। শিউলি একটা মশারি এনে দিল।
সন্ন্যাসী সেটাকে টাঙ্গাল না। রাত বেড়ে চলছে। দিপ্তি মন্দিরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে জল ভরে উঠছে।
অনেক রাত্রে সন্ন্যাসীর ঘুম ভাঙ্গল।
জানালা দিয়ে দিপ্তির মুখ দেখা গেল। কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে। সন্ন্যাসী উঠে বাইরে এলো। বলল, “তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? রাত অনেক হয়েছে ঘুমে পড়। ”
দিপ্তি দাঁড়িয়েই আছে।
কোন জবাব দিল না। সন্ন্যাসী ঠাকুরের পানে তাকিয়ে থাকল।
“যাও। ”
“আমার ঘুম আসছে না। আমি ঘুমাতে পারব না ঠাকুর।
”
“কেন?”
“যার স্বামী সোনার সিংহাসন ছেড়ে খোলা ফ্লোরে ঘুমাতে পারে তার ঘুম আসে না ঠাকুর। ”
“দিপ্তি, আমি সন্ন্যাসী। দেখলে, বাবা তার ছেলেকে চিনল না। ”
“বাবার কাছে ছেলে যতটা গর্বের আমার কাছে আমার স্বামী তার চেয়ে অনেক বেশি গৌরবের। ”
“তুমি চলে যাও।
বাবা দেখলে তোমাকে তাড়িয়ে দেবে। শুধু শুধু বদনাম নেবে কেন?”
“যার নাম নেই তার বদনাম দিয়ে কি হবে? আমি তোমার সন্ন্যাস জীবন চাই না। আমি তোমার সব কিছুকে মেনে নিয়েছি। তুমি আমার একটা কথাকে মেনে নাও। আমি তোমার কষ্টকে সহ্য করতে পারছি না।
”
“দিপ্তি, পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। পৃথিবীতে ক্ষণিকের আশা না পুরাতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। জীবন অনেক ছোট। যাকে জীবন দিয়ে ভালোবেসেছিলাম সে ব্যথা দিয়ে চলে গেল। যে আমাকে বুঝল তার সুখকে আমি মেনে নিতে পারলাম না।
সে তার ভগবানের কাছে নালিশ করেছে, তাকে পেতে হলে ভগবানের দ্বারেই আমাকে আসতে হবে। তাই ভগবানকে খুঁজতে বেরিয়েছি। যদি ভগবানের কাছ থেকে কোন দিন তাকে ফিরে নিতে পারি তবে আমি আবার সংসারে ফিরে আসব। নইলে এ জীবনে তুমি আর আমাকে পেলে না। ”
“তুমি কেন সন্ন্যাস গ্রহণ করলে?”
“আমার মনের মানুষকে খুঁজে আনার জন্য।
”
“আমাকে ফাঁকি দিয়ে যে পূণ্য তুমি সঞ্চয় করেছো তাতে কি সুখী হতে পারবে?”
“আমি সুখের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ করিনি। নিজেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সন্ন্যাস হয়েছি। ”
“আমি যদি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি তবে কিসের শাস্তি?”
“তোমার ক্ষমার আগে যে আমি সন্ন্যাস ধর্মকে গ্রহণ করেছি। কোন কিছু গ্রহণ করা যত সহজ ত্যাগ করা তত সহজ নয়। তুমি চলে যাও।
বাবা দেখলে খুবই মন্দ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।