আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভ্রমণঃ খাদিমনগর রেইন ফরেস্ট,সিলেট

ঘ এবারের সামার ভ্যাকেশনে তেমন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এই গরমে বাসায় থেকে পোকার খেলে আর মুভি দেখেই সবটা সময় পার করে দেয়ার প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু ঢাকা অনেক দিন ধরেই বৃষ্টির কোন দেখা নাই,গরমে হাফসাফ অবস্থা। তাই একটু বৃষ্টিময় পরিবেশের জন্য বলতে গেলে হঠাৎ করেই সিলেট চলে গেলাম। সিলেটে এর আগেও যাওয়া হয়েছে অনেক ঘোরাঘুরিও হয়েছে তবুও বন্ধুর দেখানো বৃষ্টির লোভ আর হাতে অলস সময় থাকার কারণে আমি সিলেট চলে আসলাম।

আসার পর বন্ধুকে দিলাম ঝাড়ি “গরম তো দেখি ঢাকার মতই,তোমার বৃষ্টি ঠান্ডা কই গেল,কয় দিন পর পর ঢাকায় গিয়া আজাইরা চাপা নাও নাকি" তারপর সেইদিন রাতেই ঝুম বৃষ্টি,রাস্তায় একদম হাঁটু পানি জমানো বৃষ্টি। তারপর দিনও রাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সিলেটের পরিবেশটা আসলেই অসাধারণ ছিল,দিনে রোদ গরম কিন্তু রাতে মেঘলা ঠান্ডা পরিবেশ। তো যাই হোক সিলেট আসলাম একটু আশেপাশে তো যাওয়া দরকার। বন্ধু আগেই বলেছিল খাদিমনগরের কথা।

খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান সিলেটের একদম কাছেই,সিলেট থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে জাফলং যাওয়ার পথে। ৬৭৮ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিকে ২০০৬ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এটার কথা অনেকের কাছেই অজানা এবং পরিবেশটাও একটু বুনো। ভেতরে পর্যটনের জন্য তেমন কোন অবকাঠামো এখনো তৈরী হয়নি। জীববৈচিত্রে ভরপুর খাদিমনগর রেইন ফরেস্টে রয়েছে প্রায় ২১৭ প্রজাতির গাছ ও ৮৩ প্রজাতির প্রাণি।

আর রয়েছে চা বাগান। জীবনে কখনো বন দেখিনি তাই কাছাকাছি এমন একটা জায়গা আছে শুনে আমরাও যাওয়ার জন্য আগ্রহী হলাম। সকালেবেলা সাস্টে একটু চক্কর দিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে আমরা তিন জন চলে এলাম টিলাগড়। সেখান থেকে গাড়িতে করে নামলাম খাদিম চৌমুহনীতে। নামার পর বায়ে একটা রাস্তা এই রাস্তা ধরে ৫ কিমি সামনেই খাদিমনগর ফরেস্ট।

কিছুদূর হাটার পরই লোকালয়ের ভীড় কমতে থাকল। পথে যেতে চোখে পড়ল খাদিম টি ফ্যাক্টরি। একটু পরই দেখলাম পাকা রাস্তা শেষ এখন শুরু মাটি-বালুর রাস্তা। যতই সামনে যাচ্ছি বাড়ছে সবুজ আর পাহাড়ি এলাকা। তারপর দেখি চা বাগান,দুইপাশে চা বিশাল বিশাল বাগানের মাঝে নির্জন মাটির রাস্তা।

আশেপাশে মানুষের আবাস নেই,অনেকসময় পর পর হয়ত একটা চা-পাতা বোঝাই ট্রাক্টর অথবা একটা সিএনজি চলে যায়। আর মাঝে মাঝে দেখা যায় জীবিকার সংগ্রহে বনে আসা দুই একজন মানুষকে। আর রাস্তার পাশ ধরেই এগিয়ে চলছে পাহাড়ি ছোট স্বচ্ছ পানির ঝিরি। গরমে যখন খুব ক্লান্ত লাগছিল তখন সেই পানিতে হাত পা ডুবিয়ে রাখা। অসম্ভব ঠান্ডা পানি,অনেকটা জাফলং এর পানির মত ঠান্ডা।

আর পাহাড় থেকে নামা পানির ঝিরি ধারা গুলো দেখতে ছোট ছোট ঝর্ণার মত। আসলে আমরা এসেছি বন দেখতে কিন্তু এর সাথে যে চা বাগানের এমন সুন্দর পরিবেশ পাব তা ভাবিনি। ঠিক যেন ছোটবেলায় টিভি সিনেমাতে দেখা নীরব-নির্জন চা বাগান। শ্রীমঙ্গলের চা বাগান গুলোতে এমন নির্জনতা চোখে পড়েনি। চা বাগানের মধ্যে অনেকটা সময় পার করলাম।

আরো অনেকটা পথ হাটতে হবে তাই ক্যাফেইনের জন্য চা গাছের পাতা খাওয়ার চেষ্টা করলাম,কিন্তু ঘাস পাতার সাথে তেমন পার্থক্য না পাওয়াই তা বাদ। তবে চায়ের ফলটা খারাপ না চা বাগান পার হবার পর শুরু বন। দুইপাশে উঁচু এলাকা বড় গাছ আর ঝোপ ঝাড় সাথে পোকার ঝিঝি শব্দ। ঝোপ ঝাড়ে কোন শব্দ হলেই আতকে উঠি,কোন সাপ সরীসৄ্প এসে পড়ল না তো,ওইখানে এটা অস্বাভাবিক না। অনেক অজগরও নাকি ধরা পড়েছে এখানে।

মাঝে মাঝে বড় গাছগুলাতে হনুমানের দেখা পাওয়া যায়। মানুষজনের আওয়াজ পেলেই দলবেধে আড়ালে চলে যায়। আর বনে পাখিও চোখে পড়বে অনেক। আমাদের দুইপাশের প্রকৃতি দেখা আর হাটা সমান তালেই চলছে। রাস্তাটাও অসাধারণ অনেক গাছগাছালির কারণে এখন আর আগের মত রোদ লাগছে না।

রাস্তা গুলো অনেক আঁকাবাঁকা,কোথাও কোথাও ইউটার্নের চেয়েও আরও বড় বড় টার্ন যে মনে হয় আরেকটু টার্ন নিলে হয়ত সার্কেল হয়ে যাবে। যতটা বনের ভেতরে যাচ্ছি মূল্যবান বড় বড় গাছ চোখে পড়ছে। এমন বড় গাছের এতো সমারোহ আমি আগে কখনো দেখিনি। একসময় আমরা পৌছে গেলাম বন বিট অফিসে,টিনশেডের দুটি ঘর। অফিসে যাওয়ার পথে গাছগুলোতে অনেক বানর দেখলাম,তারা অবশ্য হনুমানগুলোর মতো পালিয়ে গেলো না বরং ভয় দেখানোর চেষ্টা করল আওয়াজ করে।

অফিসে যাওয়ার পর ৩/৪ জনকে পেলাম তারপর তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। এরমধ্যে একজন ভেতর থেকে অর্ধেকটা কাঁঠাল নিয়ে আসল কিন্তু আমাদের তিনজনের কেউই কাঁঠাল তেমন পছন্দ করি না,বছরে হয়ত দুই একটা কোয়াও খাই না। তারপরও কি মনে করে জানি নিলাম,কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো ক্ষুধা ক্লান্তিতে আমরা প্রায় সবটাই খেলাম যদিও তেমন মিষ্টি ছিল না। তাছাড়া অফিসের পাশের গাছ থেকে বুনো লটকনও খেলাম বেশ কিছু,অসম্ভব টক। তবে বুনো খাওয়া দাওয়ার পর বেশ ভালো লাগল,আগের ক্লান্তি ভাবটা আর নেই।

আমরা মেম্বার কম মাত্র ৩ জন হওয়াতে বনের খুব গহীনে হয়ত যাইনি,তারপরো যা দেখেছি খুবই ভাল লেগেছে। তারপর আমরা আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে রাস্তায় দাড়ালাম ফেরার জন্য। এবার অবশ্য আর হেটে এতোটা পথ যাওয়া যাবে না। উল্টো দিকে যাওয়া একটা যাত্রীবাহী সিএনজি দাঁড় করিয়ে বলে দিলাম ফেরার সময় অবশ্যই আমাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর সিএনজিটা আসল তারপর সেটায় চেপে আগের হেটে আসা সেই পথটা ধরে চৌমুহনী মোড় এবং সেখান থেকে সিএনজিতে একটানে জান্নাতের বাসা মদীনা মার্কেট।

এভাবেই কেটে গেলো আমার প্রথম বন-দর্শনের একটা বেলা। সিলেটের অন্যান্য জায়গাগুলোতে ঘুরতে প্রায় একটা দিন লাগলেও খাদিমনগর খুব কাছে হওয়াতে একবেলার মাঝেই দেখা যায়। ট্যুরে গেলে সিলেট শহরের দর্শনীয় স্থান মানে মাজার,সাস্ট,কিন ব্রিজ,এমসি কলেজ দেখার জন্য বরাদ্দ রাখা দিনেই খাদিমনগর ঘুরে আসা সম্ভব। এমসি কলেজ,শাহ পরাণের মাজার,খাদিমনগর একই রাস্তার ১০ কিমি রেঞ্জের মধ্যেই। আমরা যেমন খাদিমনগর যাওয়ার পথে ফাকতালে এমসি কলেজটাও ঘুরে দেখেছি।

আর সাথে বলতে হয় সিলেটের পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টের কথা। খুব মজার ছিলো সেখানকার খাবার গুলো। ঢাকার হাজির বিরিয়ানি ছাড়া কোথাও এতো ভীড় চোখে পড়েনি। আর সবশেষে ধন্যবাদ আমার বন্ধুকে ওর পরীক্ষা সামনে রেখেও আমাদেরকে এভাবে সময় দেয়ার জন্য। ও সাস্টে পড়তে না গেলে হয়ত খাদিমনগর পাঁচ ভাই জায়গাগুলোতে আর যাওয়া হত না,যেমনটা হয়েছিল আগের সিলেট ট্যুরগুলোতে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।