আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাজন “পৃথিবীর ফুসফুস”

নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । আমাজন “পৃথিবীর ফুসফুস” । অবা্ক হবেন হয়তো পৃথিবীর ফুসফুস ব্যাপারটি আবার কি , এরকমটা ভেবে ! এটা তো জানা আছে ফুসফুস ছাড়া মানুষ বাঁচেনা । কারণ বেঁচে থাকতে হলে তাকে অক্সিজেন গ্রহন করতে হয় ।

আর এই অক্সিজেন আমরা পেয়ে থাকি বাতাস থেকে। ফুসফুসের কাজ হলো বাতাস থেকে এই অক্সিজেন গ্রহন করে দেহে সরবরাহ করা । বাতাসে রয়েছে ৭৭-৭৮% নাইট্রোজেন এবং ২২% অক্সিজেন গ্যাস। বাকী ১% এ রয়েছে যতো ধরনের গ্যাসের কথা এযাবৎ আপনি জানেন তা । পৃথিবীতে যতোটুকু অক্সিজেন আছে তার ২০ শতাংশই যেহেতু উৎপাদিত হয় আমাজনের জঙ্গল থেকে তাই আমাজনকে “পৃথিবীর ফুসফুস” বলতেই হয় ।

পৃথিবীতে যতোটুকু “রেইন ফরেষ্ট” বেঁচে বর্তে আছে এখোনো, তার ৫৪% ই আছে আমাজন এলাকার আড়াই মিলিয়ন ( ২৫ লক্ষ ) বর্গমাইল জুড়ে । প্রতি বছর পৃথিবীতে যে বৃষ্টিপাত হয় তার বেশীর ভাগটাই পতিত হয় এই এলাকায়, এখানকার উষ্ণতা আর আদ্রতার কারনে । সারা বছর জুড়ে গড়পড়তা বৃষ্টিপাতের পরিমান ৬৯ ইঞ্চি থেকে ৭৯ ইঞ্চি । যদিও কখোনও কখোনও এই মাত্রা ৩৯০ ইঞ্চি ছাড়িয়ে যেতে পারে । তাই এই জঙ্গলকে ডাকতে হয় “রেইন ফরেষ্ট” বলেই ।

পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীনতম ইকোসিস্টেম হলো এই রেইন ফরেষ্ট, অদ্ভুত সুন্দর আর বিষ্ময়কর । জুড়ে আছে পৃথিবীর আয়তনের ৬ শতাংশ এবং পৃথিবীতে যতো বৃক্ষরাজি আর পশু-পাখী আছে তার অর্ধেকের বেশীটাই রয়েছে এখানে । আর আমাজন হলো এদের ভেতরে সর্ব-বৃহত্তম । ছবি-২ General distribution of tropical rainforest আমাজনকে বুঝতে হলে পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রেইন ফরেষ্টগুলির কথাও একটু জেনে রাখা ভালো । বেশীর ভাগ রেইন ফরেষ্টগুলিই পৃথিবীর মৌসুমী খাত বা আধার (monsoon trough ) এলাকায় ছড়িয়ে আছে যাকে ভুগোলবিদরা জানেন “ইন্টারট্রপিক্যাল কনভার্জেন্স জোন” হিসেবে ।

এরা ছড়িয়ে আছে নিরক্ষীয় এলাকায় (equatorial zone), দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা-মায়ানমার থেকে শুরু করে ফিলিপিনস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া-নিউগিনি হয়ে উত্তরপূর্ব অস্ট্রেলিয়া পর্য্যন্ত । সাব-সাহারান এলাকাতে ক্যামেরুন থেকে কঙ্গো । দক্ষিন আমেরিকার আমাজন, মধ্য আমেরিকার বোসাওয়াস, ইউকাতান পেনিনসূলা, এল-পাতেন, বেলিজ আর হাওয়াই সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দ্বীপে । আমাজনের কথায় ফেরা যাক । একদিন লক্ষ-লক্ষ বছর আগে বর্তমান আফ্রিকার বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে প্রোটো-কঙ্গো (জায়ারে) নদী ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আমাজন নদী বয়ে চলেছিলো পশ্চিমে যখন আফ্রিকা আর দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশ দুটি মিলেমিশে ‘গন্ডোয়ানাল্যান্ড’ (Gondwanaland)নামের সুপার-কন্টিন্যান্ট এর অংশবিশেষ অবস্থায় ছিলো ।

৬০০ মিলিয়ন বছর আগে “প্রি-ক্যাম্ব্রিয়ান” যুগে এই সুপার-কন্টিনেন্ট এর জন্ম পুরো হয় । দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এ্যারাবিয়া, মাদাগাস্কার, ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর এ্যান্টার্টিকা মিলে গড়ে উঠেছিলো এই সুপার-কন্টিন্যান্ট । ১৮০ মিলিয়ন বছর আগে “জ্যুরাসিক” যুগের (Jurassic Period)শুরুতে এর থেকে আলাদা হতে থাকে এক একটি ভুখন্ড । যার বর্তমান রূপ আমরা দেখছি এখোন বিভিন্ন মহাদেশ হিসেবে । [ এখানে এসে আপনার নিশ্চয়ই মনে পরবে “দ্য জ্যুরাসিক পার্ক” ছবিটির কথা ] ছবি-৩ বিশ্বের আদিম মানচিত্রে ‘গন্ডোয়ানাল্যান্ড’ মাত্র ১৫ মিলিয়ন বছর আগে ভু-ত্বাত্তিক ভাবে আফ্রিকান প্লেটের সাথে নাযকা প্লেটের ধাক্কা লেগে যে আন্দিজ পর্বতমালার জন্ম হয় তা এই আমাজনের গতিপথকে আটকে দিয়ে তাকে একটি অন্তর্দেশীয় সাগর (Inland Sea)বানিয়ে ফেলে ।

ধীরে ধীরে এটি হয়ে ওঠে বিপুলায়তনের বিশাল এক জলাভুমি আর সুপেয় পানির লেক । দশ মিলিয়ন বছর আগে এর বিপুল জলরাশি নতুন যাত্রা শুরু করে । উৎসমুখ আন্দিজের নেভাদো মিস্‌মি নামক চূড়া । পশ্চিমের স্যান্ডষ্টোনের তৈরী ভুখন্ড কেটে কেটে আমাজন বয়ে চলে পূর্বাভিমুখি । এই সময়কালেই জন্ম হয় আমাজন রেইন ফরেষ্ট এর ।

বরফযুগে (Ice Age) সমুদ্রের পানির স্তর নীচে নেমে গেলে খুব দ্রুতই লেকের পানি অপসারিত হয়ে নদীর আকার ধারন করে আমাজন । এর তিন মিলিয়ন বছর পরে সমুদ্রের পানি এতোটাই নীচে নেমে যায় যে বেড়িয়ে পরে মধ্য আমেরিকান যোজক (Central American isthmus) ভুখন্ডটি । এ ঘটনাটি দুই আমেরিকার মধ্যে প্রানীদের ব্যাপক হারে “মাইগ্রেশান”এর সুযোগ তৈরী করে দেয় । আজ এই আমাজনই হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়তনের (voluminous) নদী যা মিসিসিপি নদীর আয়তনের ১১ গুন বড় । পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান একটি এলাকাকে বিধৌত করছে এই নদীর জল ।

নীলনদের পরেই পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী এটি । পাড়ি দিয়েছে ৩০০০ মাইল পথ আর পাঁচ পাঁচটি দেশ । এর শাখানদী রয়েছে ১১০০টির মতো যার ভেতরে ১৭টি শাখা নদীই দৈর্ঘ্যে ১০০০ মাইলের বেশী । জোয়ারের সময় এর সমুদ্র মুখটি ৩০০ মাইল ব্যাপী চওড়া হয়ে ওঠে আর প্রতিদিন ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট সুপেয় পানি গিয়ে পড়ে আটলান্টিকের বুকে । এই ঝাপিয়ে পড়া পানির গতিবেগ এতোটাই বেশী যে নদীর মুখ থেকে আটলান্টিকের মধ্যে প্রায় ১৫০ মাইল পর্যন্ত আপনি আমাজনের সুপেয় পানি ছাড়া সমুদ্রের স্বাভাবিক লবন পানি পাবেন না ।

আর নিউইয়র্ক শহরকে যদি আপনি নয় বছর ধরে খাবার পানি সরবরাহ করতে চান তবে আটলান্টিকের বুকে ঝাপিয়ে পড়া এই একদিনের পানিই যথেষ্ঠ । আমাজনের এই অববাহিকা ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রেইন ফরেষ্ট এর জঙ্গল । আয়তনে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি অঙ্গরাজ্যের সমান । আর তা আছে দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলাম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, গিয়েনা আর সুরিনাম নামের দেশগুলো জুড়ে । অর্থাৎ দক্ষিন আমেরিকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভুখন্ড জুড়েই আপনি এই গাঢ় সবুজের অরণ্য দেখতে পাবেন ।

দেখতে পাবেন প্রকৃতির আদিম রূপ । শুনতে পাবেন হাযার হাযার বছরের সময়কে ছুঁয়ে আসা নিঃশব্দ আরণ্যক কথকতা । ছবি-৪ আকাশ থেকে আমাজন । শখের আমাজন এক্সপ্লোরার লেসলি টাইলার তার বিশাল এক ওয়েবপেজে লিখেছেন – “একটি রেইনফরেষ্টে একবারও পা না রাখা ছাড়া কারো পক্ষে এর সৌন্দর্য্য বর্ণনায় সুবিচার করা অসম্ভব । কোনও ছবিই, কোনও চলচ্চিত্রই বা কোনও বইয়ের পক্ষেই এর ভয়ঙ্কর সুন্দরতাকে তুলে ধরা সম্ভব নয় ।

আমি এই আমাজনকে নিয়ে যতো ছবি তুলেছি তার কোনওটিতেই আমি এর সত্যিকার রহস্য আর শ্বাসরূদ্ধকর সৌন্দর্য্যের প্রতি সুবিচার করতে পারিনি । আমার শ্বান্তনা এটুকুই, আমার মতো সবাই-ই এই একই হতাশায় ভুগছেন । ” ছবি-৫ কূহকী অরণ্য আর আমার নিজের (লেখকের) কথা যদি বলি, তবে বলতেই হয় – আমাজন এবং তার রেইনফরেষ্টের জন্যে ইন্টারনেট, আমাজনের উপরে লেসলি টাইলার এর তোলা ব্যক্তিগত ছবির পেজ ঘেটে ঘেটে মনে হয়েছে কোনটা রেখে কোন ছবিটি আমি এই পোষ্টে দেবো । ছবি ডাউনলোড করতে গিয়ে আমিও সুবিচার করতে পারিনি হয়তো আদিম আমাজনকে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে ! আদিম মানুষ আর পরিবেশগত অবস্থার প্রভাবে রেইনফরেষ্ট, সিজনাল ফরেষ্ট, ক্ষনস্থায়ী ফরেষ্ট, জলপ্লাবিত ফরেষ্ট আর আদিগন্ত বিস্তৃত বৃক্ষহীন প্রান্তরের (সাভান্না) সমাহার নিয়ে আমাজন হয়ে উঠেছে একটি “মোজাইক অব ইকোসিষ্টেম”, একবার আপনি এখানে পা রাখলে আপনার মনে হবে , সময় যেন থেমে গেছে এখানে । অক্সিজেন সমৃদ্ধ নির্মল ভারী বাতাস আপনার বুকে এনে দেবে আলাদা এক অনুভূতি ।

ঘন পাতায় ছাওয়া এই অরণ্যের ছাদের ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে বাইরের বাতাসের কোনও দোলা লাগবেনা আপনার গায়ে । আদ্রতা আর উষ্ণতার কারনে মাটি থেকে আদিম গন্ধ নিয়ে উঠে আসা ধোঁয়াসা ঘিরে থাকবে আপনাকে সারাক্ষন । মনে হবে কুয়াসার ভেতর থেকে উঠে আসছেন আপনি, পৃথিবীর প্রথম মানুষটি । আপনার চারপাশ ঘিরে আছে আদিম অরণ্য শব্দহীন, মন জুড়ানো রংয়ের প্রজাপতি আর পাখি । বিশ্বের তাবৎ প্রজাতির পাখিদের এক-তৃতীয়াংশ পাবেন আপনি এখানে ।

যাদের মধ্যে “toucan” নামের ছোটখাটো এই পাখিটি আমাজনের “আইকন” হয়ে আছে এর শোরগোল পাতানো স্বভাবের কারনে । এরা এতো শব্দ করে যে, আধা মাইল দূর থেকে আপনি এদের বাঁকানো আর শরীরের তুলনায় লম্বা ঠোটের ডাক শুনতে পাবেন। ছবি-৬ টুকান স্কারলেট ম্যাকাওর দিক থেকে আপনি চোখ ফেরাতে পারবেন না এর রংধনু রংয়ের কারনে । পাবেন তোতা-পাখি শ্রেনীর এই ম্যাকাওর আরো হরেক রকম । বর্তমানে কিন্তু এরা একটি “এনডেঞ্জার্ড” প্রানী ।

ছবি-৭ স্কারলেট ম্যাকাও পৃথিবীর ১০মিলিয়ন প্রজাতির গাছ-গাছড়া, পাখি, প্রানী আর পতঙ্গের আধেকটাই আপনি পাবেন এখানে । সবচেয়ে কিম্ভুত কিমাকার দেখতে প্রানী থেকে শুরু করে নয়নকাড়া সুন্দর, বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল আর সবচেয়ে ক্ষুদ্র, বিকট শব্দে ডাক দিয়ে ওঠা আর সবচেয়ে শান্ত, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর থেকে সবচেয়ে নিরীহ প্রানীটির দেখা পাবেন আপনি এখানেই । “এ্যানাকোন্ডা” ছবিটি দেখেননি এমোন কেউ কি আছেন এখানে ? হাযারো বিচিত্র রকমের প্রানীদের ভেতরে বোয়া কন্সট্রিকটর গোত্রের ভয়ঙ্কর সেই এ্যানাকোন্ডাকেও আপনি দেখবেন এখানে । লম্বায় ২১/২২ ফুটের মতো প্রানীটি আস্ত গিলে খেয়ে ফেলে তার শিকারকে । ছবি-৮ এ্যানাকোন্ডা... মারো টান হেইও..... বারো হাত কাকুঁড়ের তের হাত বীচির মতো ১২ ইঞ্চি লম্বা আর ১২/১৩ ইঞ্চির লেজ আর মাত্র দু’পাউন্ড ওজন নিয়ে সিংহমুখী খুঁদে বানরকে দেখবেন গাছের ফলমূল, পোঁকা-মাকড়, টিকটিকি খেয়ে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে ।

ছবি-৯ সিংহমুখী সোনালী বানর । আরো দেখতে পাবেন- গাছের ডালে লেজ বাঁধিয়ে ঝুলে থাকা স্পাইডার মাংকি, কাঠ-বেড়ালী মুখের স্কুইরেল মাংকি, উলের মতো পশম দিয়ে গা ঢাকা উলি মাংকি, খূঁদে পিগমী মাংকি, শ্লথ নামের ভীষন আলসে মাংকি , জায়ান্ট এন্টিয়েটার, বিশালাকৃতির ৬ ফুট লম্বা জলজ ভোঁদর, লম্বায় ২ ফুট আর ১০০ পাউন্ড ওজন নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল আর তীক্ষ্ণ দাঁতওয়ালা ইঁদুর ক্যাপিবারা । আছে বিশালাকৃতির জলজ স্তণ্যপায়ী “মানাতী” দেখতে সীল আর তিমির মতো হলেও থলথলে এই প্রানীটি কিছু কিছু দিকে কিন্তু অসাধারন । দেখতে কিম্ভুত কিমাকার হলেও মানুষের মতো এদের ফুসফুস আছে । তাই বাতাস টেনে নিতে এদের বারেবারে উঠতে হয় পানির উপরে ।

ছবি-১০ আমাজনের মানাতী পাবেন আমাজন নদীর সবচেয়ে সুন্দর প্রানীটির দেখা । গোলাপী ডলফিন । পৃথিবীর আর কোথাও নেই । আমাজন অরন্যের সব রহস্য আর কল্পকাহিনী দিয়ে ঘেরা একটি বিরল প্রজাতি । ছবি-১১ “গোলাপী সুন্দরী” নদীর জলে আপনি যখন আট ফুট লম্বা “ইলেক্ট্রিক্ ঈল” এর দেখা পাবেন তখন ১০০ হাত দূরে থাকতে হবে আপনাকে ।

কারন এই মাছটি ৬০০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক দিতে পারে আপনাকে । ছবি-১২ ঈল... ভয়ঙ্কর আর আমাজনের পিচ্চি কিন্তু ভয়ঙ্কর জলজ প্রানী “পিরানহা”র ধারেকাছেও যাবেন না আপনি । এর শক্তিশালী চোয়াল আর ব্লেডের মতো ধারালো দাঁত আপনার হাড় থেকে চোখের পলকে খুঁবলে নেবে মাংশ । মাত্র পাঁচ থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা, আমাদের রূপচাঁদা মাছের মতো দেখতে এই মাছটির ঝাঁকের মধ্যে পড়ে গেলে মূহুর্তে আপনার হাড্ডি ক’খানা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেনা । ছবি-১৩ “রাক্ষুসে পিরানহা” আমাজনের আর এক ঘাতক প্রানী “জাগুয়ার” ।

সাহস, শক্তিমত্তা আর ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর চিতা জাতীয় এই প্রানীটি ছুটতে পারে দ্রুত, চড়তে পারে গাছে, পারে সাঁতরাতে । পালাবেন কোথায় ? ছবি-১৪ সুন্দর কিন্তু ভয়ঙ্কর আমাজনের কুমিরের কথাই বা বাদ যাবে কেন ? আমাজনের নদীগুলোতে এর চেয়ে বিশাল কোন ঘাতক নেই । আর এর কোনও শত্রুও নেই বরং অনেক প্রজাতির ভেতরে “ব্লাক কেইম্যান” নামের কুমির প্রজাতিটি সবার শত্রু । বাগে পেলে হাতি থেকে শুরু করে খেয়ে ফেলে সব । সরীসৃপ বর্গের মাংশাসী এই প্রানীটিকে নিয়ে অনেক “হরর” চলচ্চিত্র আপনারা দেখে থাকবেন অনেকেই ।

ছবি-১৫ কুমির কালো পৃথিবীর গাছপালা-তৃণলতার দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে আমাজন জুড়ে । ৮০,০০০ প্রজাতীর গাছপালা (plant species)রয়েছে এখানে । বৃক্ষরাজী এখানে এতোই ঘন হয়ে ছেয়ে আছে যে একফোঁটা বৃষ্টির পানি মাটির স্পর্শ পেতে সময় নেবে দশ দশটি মিনিট । এই গাছগাছালীর আধেকটাই বৈশ্বিক আবহাওয়া নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে । ছবি-১৬ আমাজন লিলি ….পদ্মপাতার পালঙ্ক ।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুলটি পাবেন আপনি এখানেই, আমাজন লিলি । একটি সকার বলের মতো বড় । বেঁচে থাকে মাত্র তিনদিন । ফুঁটে ওঠার সময় এর রংটি থাকে সাদা । ফোঁটে রাতের বেলা ।

পরাগায়নের সময় হলে রং পাল্টায় ফুলটি । ঠিক যেন মেয়েদের প্রেমে পড়ার মতো । হতে থাকে পিংকি পার্পল । আমাজন লিলি গাছের পাতাটিও ঢাউস সাইজের । আধা মিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে গোলাকার পাতাটি ১৩৬ কেজি ওজন বইতে পারে ।

আপনি নিশ্চিন্তে পাতাটির উপর একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠতে পারবেন । গড়িয়ে পানিতে পড়ার ভয় নেই কারন পাতার ধারটি উঁচু কার্নিশের মতো । উপরি ভাগটি সবুজ হলেও নীচের দিকটি এর মেরুন রংয়ের । এর আদি এলাকা ব্রাজিল আর আমাজনে এটি ফুঁটে থাকে বারোমাস । আছে “বার্ড অব প্যারাডাইজ” নামে খ্যাত নয়ন কাড়া “হ্যালিকোনিয়া” ফুলটি ।

আনারস জাতীয় গাছ “ব্রোমিলাদ” । রংয়ের বাহারে শ্বাসরূদ্ধ হবেনা তো কি ! অর্কিড আছে হাযারো রকমের । তিনটি বৃতি আর তিনটি পুষ্পপল্লব নিয়ে আছে শ্বেত শুভ্র “ট্রিলিয়াম” ফুল। সাপের বিষ নামাতে আর সন্তান প্রসব সহজ করাতে আদিবাসীদের মোক্ষম দাওয়াই । আছে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ২০০ ফুটের চেয়ে বেশী উঁচু “কাপোক” গাছ ।

আছে দিনে ৯ ইঞ্চি করে বেড়ে ওঠা লম্বা লম্বা বাঁশগাছও । আছে শরীর উত্তেজক “ কোকো” গাছ । এই রেইন ফরেষ্টে খাওয়ার যোগ্য ফলমূল আছে ৩০০০ রকমের যা আপনা আপনিই গাছে গাছে ধরে থাকে , প্রকৃতির দান । আমাজনের লোকজন এ থেকে মাত্র ১৫০০ রকমের ফলমূল খেয়ে থাকে । অথচ খাওয়ার জন্যে নিজেরা জন্মায় মাত্র ২০০ রকমের ফলমূল তাও ইদানিং কালে ।

এই এলাকার বৃক্ষরাজীর ভেতর ৭০% গাছগাছালিতেই পাওয়া যায় ক্যানসার বিরোধী কিছু না কিছু গুনাবলী । অথচ এই সব গাছগাছালীর ৯০% আধুনিক বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি আজও । এতো অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে এই বিশাল অরণ্য । অবহেলিত হয়ে আছে আমাজনের আদিবাসীরাও । ১৪৯২ সালে ক্রিষ্টোফার কলম্বাস যখোন “নতুন দুনিয়া” আবিষ্কার করে ভাবলেন তিনি ‘ইন্ডিয়া”র মাটিতে পা রেখেছেন, তার পিছে পিছে ১৫০০ সালের দিকে সম্পদের লোভে অন্যান্য ইউরোপিয়ান অনুপ্রবেশের আগে যেখানে আনুমানিক ৯০ লক্ষ আদিবাসী ছিলো এই বিশাল অরণ্যের আরণ্যকতা গায়ে মেখে, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২/৩ লাখে ।

সম্পদ আর বসতি স্থাপনের কারনে স্পেনিয়ার্ডদের হাতেই মারা গেছে এর অধিকাংশ আদিবাসী । পৃথিবীতে যা হয়ে থাকে - “জোর যার, মুল্লুক তার” সভ্যতার সংমিশ্রনে শংকর হয়ে যাওয়া থেকে আর সকল প্রতিকূলতাকে ঠেলে যারা রয়ে গেছে তাদের মধ্যে আছে ২১৫টি এথনিক গ্রুপ আর এরা কথা বলে ১৭০ টি ভাষায় । অরণ্যের গহন গভীরে এখোনও ৫০টির মতো এথনিক গ্রুপ রয়েছে যাদের এ পর্য্যন্ত সভ্য জগতের আলো দেখা হয়ে ওঠেনি । ছবি-২১ আদি অকৃত্রিম…. ওদিকে ভাস্কোদা-গামা সত্যিকারের “ইন্ডিয়া”তে পা রেখেছেন ফেলেছেন তার পরে পরেই। কিন্তু “ইন্ডিয়ানস” নামটি গায়ে মেখে আছে আজো এই অরণ্যের গহনচারীরা ।

এই আদিম অরন্যের মানুষগুলি এই মাটিতে কি করে এলো তা নিয়ে আর্কিওলজিষ্টদের ভেতরে রয়েছে নানা অনুমান, নানা বাদানুবাদ । এর ভেতরে সবচেয়ে প্রাচীন এবং বহুল প্রচারিত হাইপোথিসিসটি হলো – শেষ বরফ যুগের পরেপরেই সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে এদের আগমন ঘটে এখানে । এটি যে সম্ভব তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কে “কনটিকি” আর “কানতুতা”র মতো এক্সপিডিশানের জন্ম । “কনটিকি” এক্সপিডিশানের কথা আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন, পড়েছেন ইংরেজী পাঠ্যপুস্তকে । হামবোল্ট স্রোতের (Humboldt Current ) সহায়তায় দক্ষিন আমেরিকার পশ্চিম অংশ থেকে যে পলিনেশিয়ান দেশগুলিতে যাওয়া যা তা-ই প্রমানিত হয়েছে এই সব সমুদ্র যাত্রা থেকে ।

ছবি-২২ প্রকৃতির সন্তানেরা… একদিন এমোনতরো রহস্য আর আদিমতা নিয়ে পড়ে থাকা আমাজন কালের বিবর্তনে আজ তার রং-রূপ হারাতে বসেছে । প্রতি বছর লক্ষ্ লক্ষ্ একর জমির গাছপালা পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে । কেন ? বসতি চাই… চাই টাকা । গ্লোবাল অর্থনীতির সাথে জুড়ে দিতে হবে একে । এর অফুরন্ত সম্পদকে শুষে নিতে হবে ।

তাই জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করতে হচ্ছে “টিম্বার” সরবরাহের জন্যে । মাংশ আর চামড়া রফতানীর জন্যে গড়ে তুলতে হচ্ছে “ক্যাটেল গ্রেজিং ফিল্ড” । “ক্যাটেল র‍্যাঞ্চ” বানানোর নামে চলছে অরণ্য কেটে জমি দখলের উৎসব, ঠিক যেন আর একটি বাংলাদেশ ! তেল-গ্যাস আর খনিজের খোঁজে হেক্টরের পর হেক্টর জঙ্গল সাফ-সুতেরো হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই । তাই আদিম অরন্য থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সামিল হতে আমাজনকে খোঁয়াতে হচ্ছে তার আব্রু তার সতীত্ব । প্রতি সেকেন্ডে একটি ফুটবল মাঠের মতো এলাকার আরণ্যক আব্রু খসে পড়ছে মাইনিং আর বন-উজাড়ের কারনে ।

শিউরে ওঠার মতো । ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্য্যন্ত ১৪ লাখ হেক্টরেরও বেশী জঙ্গল হারিয়ে গেছে এভাবে । এইসব কারনে আর বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সৃষ্ট দাবানলে এর চেয়েও বেশী পরিমান এলাকা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ । রুক্ষ হয়ে গেছে প্রান্তর । হারিয়ে যাচ্ছে প্রানী বৈচিত্র ।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে আমাদের “সুন্দরবন” আর “মধুপুর শালবন” এর মতো দূর্ভাগ্য বরন করতে যাচ্ছে আমাজন । একদিন সভ্যতার বলি হয়ে আমাজন যদি হারিয়ে যেতে বসে তবে কি পৃথিবী ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগতে শুরু করবে ? ছবি ও সূত্রঃ Internet / The Amazon: The World's Largest Rainforest . By Rhett A. Butler / Indigenous peoples in Brazil From Wikipedia / Amazon -rainforest-plants.html / Amazon plants and trees By WWF. / And others.  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.