আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বইয়ের জগৎ : সমালোচনা-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র

বইয়ের জগৎ সম্পাদক : আহমাদ মাযহার প্রচ্ছদ : লুৎফর রহমান রিটন সংখ্যা : ৮ মূল্য : ১০০ টাকা বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের বড়ই অভাব। সমালোচনাকে আমরা সহজে মেনে নিতে পারি না, একে শত্রুতা মনে করি। সমালোচনা যে দোষ-গুন নিয়ে যথার্থভাবে পর্যলোচনা সে কথা বুঝতে চাই না। আবার অন্যদিকে দোষ ও গুন দুই-ই ভয়াবহ। দু’ক্ষেত্রেই আমরা ভাবালুতায় আচ্ছন্ন।

অতিরিক্ত ভাবালুতায় কেবলমাত্র জ্ঞান ও আবেগের সংমিশ্রন ঘটে, বিচারবোধ ও বাস্তববোধের অভাব দেখা দেয়। জীবনের নানা জটিলতাকে উপলব্ধি করার জন্য কেবল জ্ঞান ও আবেগ থাকলে চলে না, এর সাথে প্রয়োজন বিবেচনা বা বিচারবোধ আর বাস্তববোধ। বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের এই দৈন্যদশার ফলশ্রুতিতে এর বিকাশ হয় নি। এ-প্রেক্ষাপটে শুধু বই-সমালোচনা নিয়ে যে একটা পত্রিকা হতে পারে তা ছিল আমাদের চিন্তার বাইরে। আমাদের সমালোচনা-সাহিত্যে গল্প-কবিতা-উপন্যাস সমালোচনার সমাহার।

কিন্তু বইয়ের জগৎ এর বাইরে অন্যান্য বিষয়ের উপরও গুরুত্বের সঙ্গে আলোকপাত করে, যার দৃষ্টান্ত প্রতিটি সংখ্যায়ই দেখা যায়। এবারের সংখ্যায় রয়েছে স্মৃতিকথা, গল্প, কিশোর উপন্যাস, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, চলচ্চিত্র, বানিজ্য, রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্ম বছর উপলক্ষে ক্রোড়পত্র-২ (এর আগের সংখ্যাতেও রবীন্দ্রনাথের উপরে ক্রোড়পত্র ছিল)। আগের সংখ্যার (মে ২০১১) সম্পদকীয়তে আমরা জানতে পারি বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে-সব বই প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু বইয়ের সমালোচনা পর্যায়ক্রমে প্রকাশের প্রয়াস। এখানে উল্লেখযোগ্য যে রবীন্দ্রনাথের বই নয়, রবীন্দ্রনাথের বই নিয়ে লিখিত বইয়ের সমালোচনা ছাপা হয়েছে, যা বইয়ের জগৎ এর সতন্ত্র উদ্যোগ। বিষয় বৈচিত্রে সমৃদ্ধ বইয়ের জগৎ এর লক্ষ্যনিয় একটি দিক হল শিশুসাহিত্য, কিশোরসাহিত্য, ছড়াসাহিত্য এবং এরকম অনালোচিত আরো কিছু বিষয়ক বইয়ের উপরে সমালোচনা ছাপা হয়।

বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে যা বেশ উপেক্ষিত। এ-সংখ্যায় ফরিদুর রেজা সাগরের স্মৃতিকথা ভিত্তিক বই ‘একজীবনে টেলিভিশন’ নিয়ে আলোচনা করেছেন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, ‘একজীবনে ভালোবাসা’ শিরোনামে। ফরিদুর রেজা সাগর মূলত লেখেন শিশু-কিশোরদের জন্য। এ-বইটিতে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারনার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অনেক খন্ডচিত্র ফুটে উঠেছে। ‘ফরিদুর রেজা সাগরের একজীবনে টেলিভিশন স্মৃতির কাছে সমর্পিত সময়ের আস্বাদন!’ বলে অবহিত করেন সালাহউদ্দীন জাকী।

‘মাতৃহৃদয়ে মমতামাখা ছড়া’ শিরোনামে হাসান হাফিজের ‘ছড়াসমগ্র’ বইটি আলোচনা করেছেন ছড়াকার আমীরুল ইসলাম। স্পষ্ট ও যথার্থ রূপে তিনি হাসান হাফিজের ছড়ার স্বরূপ তুলে ধরেন : ‘চিরপ্রবহমান লোকায়ত ছড়ার ছন্দ-সুর ও বিষয়ভাবনাকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে আধুনিক মোড়কে নতুন প্রাণ দিয়ে থাকেন। নিপুন ছড়াকার না হলে সহজিয়া এই শিল্প সৃজন সম্ভব নয়। হাসান হাফিজের ছড়ার সহজ ও সরল ভাবটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ’ ‘জ্যামিতি ও দর্শন’ ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এবং এই দীর্ঘ সময়েও অনালোচিত; কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।

লেখক লিয়াকত আলি। বইটির আলোচনা করেছেন আহমেদ লিপু, ‘অভিজ্ঞতার নিরিক্ষে : দর্শন ও জ্যামিতির আন্তঃসম্পর্কের বিচার’ এই শিরোনামে। বইটি সম্পর্কে লিপুর অভিমত : ‘Textটিতে জ্যামিতি ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে নির্মোহ, নিস্পৃহভাবে। আলোচনা করা হয়েছে এদের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে। মানব ইহিহাসের উল্লেখযোগ্য চিন্তানায়কদের (পাশ্চত্য) জগৎ সম্পর্কিত চিন্তা কীভাবে জ্যামিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তা নিয়েও অনুপুঙ্খ আলোচনা করা হয়েছে।

’ যতীন সরকারের ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’ বইটির আলোচনা করেছেন আহমাদ মাযহার, ‘যতীন সরকারের রবীন্দ্রাবলোকন’ শিরোনামে। যতীন সরকারের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে আমরা যেভাবে পাই, তা আহমাদ মাযহারের ভাষ্যে : ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে অনুভব করার উপায় বলে দেয়। কারণ রবীন্দ্রনাথকে তিনি নিজের জীবনোপলব্ধির আলোকে যে পটভূমিতে দেখেন তাতে রবীন্দ্রনাথ নতুনভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে আমাদের কাছে’। সৈয়দ আকরম হোসেনের বই ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস চেতনালোক ও শিল্পরূপ’। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ধারাক্রম অনুসারে এরকম বিশ্লেষণধর্মী বই হয়ত আর নেই।

বইটি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের চেতনালোক ও শিল্পরূপ আমাদের সামনে নতুর নতুন মাত্রা উন্মোচন করে। আমাদের চোখ খুলে যায় নতুন দৃষ্টি নিয়ে। বইটি আলোচনা করেছেন আয়শা ঝর্ণা। মোট ২৩টি বইয়ের আলোচনা হয়েছে, এবং একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া। মে ২০১১ সংখ্যায় বিধান রিবেরু এর ‘চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা’ বইটির আলোচনা বা সমালোচনা করেন মাসউদ ইমরান।

বিধান রিবেরু তার পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এই সংখ্যায়। তার মানে কোন বইয়ের সমালোচনা হলে, তার পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ আছে। আমরা ধরে নিতে পারি শুধু বইয়ের লেখক নয়, যেকেউ পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন। এটিও পত্রিকাটির, সেই সাথে সমালোচনা-সাহিত্য সর্বপোরি বাংলা সাহিত্যের ইতিবাচক একটা দিক। বইয়ের জগৎ শুধুমাত্র বই-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ নিয়ে প্রায় নিয়মিতভাবে প্রকাশ হয়ে আসছে দু’বছর ধরে।

পত্রিকাটিতে নবীনদের সরব উপন্থিতির পাশাপাশি অভিজ্ঞ প্রবীণেরাও লিখছেন, তবে নবীনদের লেখাই বেশি। এছাড়া পত্রিকাটির প্রধান লক্ষ্যন সামপ্রতিক কালে প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনা। তবে নিকট অতীতের গুরুত্বপূর্ণ অনালোচিত বইয়ের সমালোচনাও অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের শিল্পনির্দেশনায় সূচীপত্রের গ্রাফিক্স এমনভাবে উপন্থাপিত হয়েছে যে, এর ফলে কোন বইয়ের আলোচনা কোনটি, বইয়ের বিষয় কী এবং লেখক কে তা পাঠক সহজেই ধরতে পারবে। পত্রিকাটিতে কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় না।

শুধুমাত্র বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, স্বল্পমুল্যে। বিজ্ঞাপন-বাবদ উচ্চ অর্থমুল্যের জন্য বইয়ের বিজ্ঞাপন দেয়া প্রকাশক ও লেখক উভয়ের আওতার বাইরে। সেক্ষেত্রে বইয়ের জগৎ এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর যত বইয়ের আলোচনা পত্রিকাটিতে হয়, সেই আলোচনা পড়ে কেউ তাদের বই সংগ্রহের বিষয়টি নির্বাচন করতে পারে। এছাড়া বাংলা সমালোচা-সাহিত্যের প্রেক্ষিতে বইয়ে জগৎ এর যে ভূমিকা, তা বলাই বাহুল্য।

বইয়ের জগৎ বাংলা সাহিত্যে খুলে দিয়েছে নতুন দুয়ার, একটি মুক্ত প্লাটফর্ম। এরকম একটি পত্রিকা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোন কারণ বা কোনরকম সংকট যাতে না ঘটে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। পত্রিকাটি দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশ হলে নিঃসন্দেহে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র গড়ে উঠবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।