আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেরী ফক্স দৌড় – ম্যারাথন অফ হোপ ( Terry fox Run- Marathon of Hope)

প্রবাসী মা বেটি ফক্স এর ভাষায় অতি সাধারন ছেলে ছিল সে । সেই অতি সাধারন ছেলে টেরী ফক্স আজ বিশ্ববরেন্য , কানাডার জাতীয় বীর। জন্ম ১৯৫৮ সালে ২৮শে জুন কানাডার মানিটোবা প্রদেশের উইনিপেগ এ। পুরো নাম Terrance Stanley Fox সংক্ষেপে "Terry" Fox। ফক্সের ছোট বয়সেই তার পরিবার চলে যায় বৃটিশ কলাম্বিয়ার বন্দর নগরী কোকুইটলাম এ।

ছোট বেলার স্কুলে খেলাধুলায় প্রচন্ড ঝোক ছিল তার। ৮ম শ্রেনীতে বাস্কেটবল টিমে খেলতে নেমে ভাল খেলতে পারেননি। কোচের পরামর্শ ছিল দুরপাল্লার দৌড়বিদ হতে। ফক্স আশা করতেন ভাল ক্রীড়াবিদ হওয়ার, হয়েছিলেনও। স্কুলের শেষ বছরে এসে বন্ধু আলোয়ার্ডের সাথে বছরের সেরা ক্রীড়াবি্দ হয়েছিলেন।

স্কুল শেষ করে গেলেন সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটিতে “physical education” পড়তে । ১৯৭৭ সালে হাটুর ব্যাথায় দাড়াতেও যখন অসুবিধা হচ্ছিল ডাক্তারের পরামর্শ নিলেন। হাসপাতালে ধরা পড়ল হাড়ের ক্যান্সার রোগ osteogenic sarcoma,। । কেটে ফেলতে হল ডান পা হাটুর ৬ ইঞ্চি উপর থেকে।

কোন উপায় ছিল না। দৌড় শেষ করার আগ মুহুর্তে টেরী ফক্স। হাসপাতালে ফক্সের দিনগুলো ছিল দুঃসময়ের । ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার অপ্রতুলতা ব্যাথিত করেছিল ফক্সকে। পা হারানোর পরও তার ইচ্ছে ছিল খেলা ধুলার জগতে ফিরে যেতে।

অপারেশানের মাত্র ৬ সপ্তাহ পর গলফ খেলায় অংশ নিয়েছিলেন ফক্স। প্রতিবন্ধীদের হুইলচেয়ার বাস্কেটবলে অংশ নেন মেরুদন্ডের আঘাতে পক্ষাঘাত গ্রস্থ চ্যাম্পিয়ন ক্রীড়াবিদ Rick Hansen এর সাথে। ক্যান্সার চিকিৎসার অপ্রতুলতায় তার ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার উন্নতির জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করবেন। মরন ব্যাধি ক্যান্সার তাকে সে সুযোগ দেবে কত টুকু? কিভাবে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা ব্যাবস্থার উন্নতি করা সম্ভব? সিদ্ধান্ত নিলেন কানাডার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দৌড়ে যাবেন এবং প্রতি কানাডিয়ানের কাছ থেকে অন্তত এক ডলার করে যোগাড় করবেন ।

কিন্তু এক পা যে নেই? কৃত্রিম পা নিয়েই দৌড়বেন এই ৮ হাজার কিলোমিটার পথ। দৌড়ানোর প্রশিক্ষন নিতে শুরু করলেন ফক্স। সেদিনও কেউ জানত না কি উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষন নিচ্ছেন ফক্স। পরিবারের সবাইকে বলতেন ভ্যানঙ্কুভারের প্যারা অলিম্পিক গেমসের জন্য তার এই প্রশিক্ষন। কৃত্রিম পা নিয়ে দৌড়ান সহজ ছিল না।

প্রথমবার হাটতে গিয়ে তো পড়েই গেলেন মেঝেতে। আবার উঠে দাঁড়িয়ে শুরু করলেন। ১ বছর যাবত ৪ হাজার ৮শ কিলোমিটার দৌড়ের প্রশিক্ষন শেষ করে সবাইকে জানালেন তার মনের ইচ্ছে। মা বেটি ফক্স বেকে বসলেন। অসুস্থ শরীর, এক পা নেই, এই অবস্থায় কানাডার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দৌড়ে যাওয়া?চারটি খানি কথা? কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফক্স।

অবশেষে মা সম্মতি দিলেন এবং পরবর্তীতে ফক্স এর অন্যতম উৎসাহ দানকারী হলেন মা বেটি ফক্স। ১৯৮০ সালের ১২ই এপ্রিল কানাডার পুর্বপ্রান্তের নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জন’স এর আটলান্টিক মহাসাগরের জলে কৃত্রিম পা ডুবিয়ে নিয়ে শুরু করলেন দৌড়। সাথে নিলেন দু বোতল আটলান্টিক মহাসাগরের জল। উদ্দেশ্য এক বোতল রেখে দেবেন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আর অন্য বোতল কানাডার অন্য প্রান্তে ৮,০০০ কিলোমিটার শেষে বৃটিশ কলাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া পৌছে ঢেলে দেবেন প্রশান্ত মহাসাগরে। তার এই দৌড়ের নাম দিলেন “Marathon of Hope.” টেরী ফক্স এর দৌড়ের পথ।

ফক্সের এই উদ্যোগকে অনেকে পাগলামী বলে উপহাস করতেও ছাড়ল না। হয়ত নিউ ব্রান্সউইকের সীমাও পেরতে পারবে না ফক্স। প্রথম দিনেই তুষারঝড়, বৃস্টির সম্মুখীন হলেন ফক্স। ঝড়, বৃস্টী, তূষারপাত , ঠান্ডা আবহাওয়া কিছু দমাতে পারল না ফক্সকে। ফক্সকে উৎসাহ দিতে এগিয়ে এলেন হোটেল “ফোর সীজনস” গ্রুপের মালিক ইসাডোর শার্প (Isadore Sharp)।

অল্প কিছুদিন আগে নিজের ছেলে্কে ক্যানসারে হারিয়েছেন শার্প । তিনি ঘোষনা দিলেন যাত্রাপথে ফক্স হবেন তার হোটেলএর সম্মানিত অতিথি। প্রতি মাইল দৌড়ের জন্য দুই ডলার করে অনুদান ঘোষনা করলেন শার্প এবং তার হাজার জন বন্ধুদেরকে অনুদানে উদবুদ্ধ করলেন। আমেরিকার গাড়ী নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান “ফোর্ড মোটরস” ফক্সের সাথে যাওয়ার জন্য একটা ভ্যানগাড়ী এবং ডুগ আলওয়ার্ড(Doug Alward, ) কে দিলেন ফক্সের পিছন পিছন ভ্যান চালিয়ে ফক্স এর সাথে সঙ্গ নিতে এবং খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে। ১৪৩ দিন দৌড়ে ওন্টারিও প্রদেশের স্যাডবুরিতে এসে আর পারছিলেন না ফক্স।

বুকে ব্যাথা , শ্বাসকস্ট হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক মাত্র দৌড়েছেন ফক্স- ৫, ৩৩৭ কিলোমিটার। গড়ে প্রতিদিন ম্যারাথন দৌড়ের সমপরিমান প্রায় ৪৩ কিলোমিটার। দৌড় বন্ধ করতে হল ফক্সকে। এম্বুলেন্সে তুলে নেওয়া হল ফক্সকে।

সে মুহুর্তেও ফক্স বলেন “ আমি হারতে রাজী নই, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাব আমি” ফক্সকে নিয়ে যাওয়া হল কানাডার সেরা ক্যান্সার হাসপাতাল ভ্যাঙ্কুভার এ। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানালেন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুসে। আর আশা নেই। ম্যারাথন অফ হোপ থেমে গেলেও ফক্স এর প্রচেস্টায় তখনও অনুদান আসছে। তার আশা ছিল ঐ সময়ে কানাডার ২ কোটী ৪০ লক্ষ অধিবাসীর জনপ্রতি এক ডলার করে ২ কোটী ৪০ লক্ষ ডলার যোগাড় করা ।

দৌড় থামানোর মুহুর্তে জমা পড়েছে ১ কোটী ৭০ লক্ষ ডলার। বাদবাকী টাকা যোগাড় হতেও সময় লাগে নি। ফক্সের মৃত্যুর আগেই ২ কোটি ৪১ লক্ষ ডলারের বেশী জমা পড়ে । হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ইসাডোর শার্প এলেন ফক্স এর কাছে। ফক্সকে প্রস্তাব দিলেন ফক্সের দৌড়কে স্মরনীয় করে রাখতে, ক্যান্সার রোগীদের সাহায্যার্থে বছরে এক বার “টেরী ফক্স দৌড় অনুষ্ঠিত হবে।

তিন শর্তে রাজী হলেন ফক্স ১) দৌড় হতে হবে অপ্রতিযোগিতামুলক অর্থাৎ এতে কেউ বিজয়ী, প্রথম বা দ্বিতীয় হবে না, কোন পুরস্কারও থাকবে না ২) দৌড়ে সংগৃহীত অর্থ ব্যায় করতে হবে ক্যান্সার চিকিৎসাএবং গবেষনায় ৩) কোন কোম্পানী বা সংগঠন এই দৌড়কে স্পন্সর করবে না। ১৯৮১ সালের ১৮ জুন মারা যান ফক্স। জীবিতাবস্থায়ই পেলেন কানাডার সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব “অর্ডার অফ কানাডা” ( Order of Canada )। তার মৃত্যুর আড়াই মাস পর ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৮১ তে অনুষ্ঠিত হল প্রথম টেরী ফক্স দৌড়। অনুদান এল ৩৫ লক্ষ ডলারের।

১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হল টেরী ফক্স ফাউন্ডেশান। এখন পৃথিবীর ৬০টির ও বেশী দেশে ক্যান্সার রুগীদের চিকিৎসা ও ক্যান্সারের সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর অনুষ্ঠীত হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে লেবার ডে’র পরবর্তী রবিবারে “টেরী ফক্স দৌড়”। টেরী ফক্স ফাউন্ডেশান এ পর্যন্ত ৫৫ কোটি ডলারের বেশী অনুদান পেয়েছে। ফাউন্ডেশানের অর্থায়ন যে সমস্ত গবেষনায় অবদান রেখেছে তা হল। ১) ক্যান্সার ডায়াগনোসিসে ২) প্রোস্টেট ক্যান্সারে।

৩) লিম্ফোমা চিকিৎসায়। ৪) ফুসফুসের ক্যান্সারে কানাডা এবং পৃথিবীর অনেক দেশে স্থাপিত হয়েছে টেরী ফক্স এর মুর্তি। অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে টেরী ফক্স এর নামে। . কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ভিক্টোরিয়া শহরে টেরী ফক্স এর মুর্তি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।