I am Bangladesh supporter লেখক:মাহাবুবুর রহমান
এবার ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হলেন খালেদা জিয়া। গৃহকোণ থেকে রাজনীতিতে এসে বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হওয়ার আগেই ১৯৮৩ সালে তিনি সাতদলীয় জোটের নেত্রী হিসেবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। ৯ বছর রাজপথে আপসহীন লড়াইয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে তিনি ১৯৯১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। আর আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করতে ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠন করে তিনি রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন। ২০০১ সালের অক্টোবরের ভোট বিপ্লবে তার নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে।
স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদবিরোধী কিংবা দেশ রক্ষার আন্দোলন গড়ে তুলতে খালেদা জিয়া দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মোর্চা করেছেন বারবার। আপসহীন আন্দোলনে তিনি ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতির লাগাম টেনে ধরেন। এবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অঘোষিত বাকশালের লাগাম টেনে ধরতে বড় মাপের রাজনৈতিক জোট গড়লেন। আর জোট ঘোষণার শুরুতেই তার দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের প্রতিবাদে রোববারের হরতাল দিয়ে জোটবদ্ধ আন্দোলন শুরু হচ্ছে।
আন্দোলনের পথ বেয়ে এ জোট নির্বাচনী মোর্চায় পরিণত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন খালেদা জিয়া। ফলপ্রসূ আন্দোলনের জন্য ১৮ দলীয় জোট গঠনের কথা জানিয়ে আত্মপ্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়া বলেন, ‘সরকারের স্বৈরনীতি ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সমগ্র জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের জয় হবে। ’
গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে খালেদা জিয়া ১৮টি রাজনৈতিক দলের জোটের ঘোষণা দেন। ১৮ দলে রয়েছে—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্য জোট, খেলাফত মজলিস, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাপ ভাসানী, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ডেমোক্রেটিক লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ পিপলস লীগ।
রাজপথের আন্দোলনের পরীক্ষিত প্লাটফর্ম চারদলীয় জোটের নেতাদের পাশাপাশি নতুন এ রাজনৈতিক জোটে রয়েছেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি অলি আহাদ। আবার একাত্তরের রণাঙ্গনের সাহসী যোদ্ধা কর্নেল (অব.) ড. অলি আহম্মদ বীরবিক্রম এমপি ও মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। আছেন রাজপথের সাহসী উচ্চারণের প্রতীক জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, আবার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের নেতা পিপলস লীগের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট গরীব নেওয়াজ।
এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের পথ বেয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। ক্ষমতাসীন হয়েই পিলখানা হত্যাকাণ্ড, বিভিন্ন মামলার নামে বিরোধী রাজনীতিকদের হয়রানি, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেয়া, অসংখ্য গুম-খুন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-পানি-বিদ্যুত্ সঙ্কট, শেয়ারবাজারে লুট, ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর প্রদান এবং সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দেশকে একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দেয় শেখ হাসিনার সরকার।
এ পরিস্থিতিতে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ও সমমনা দলগুলো রাজপথের আন্দোলনে নতুন সংস্কৃতি যোগ করেন। হরতাল নৈরাজ্যকে এড়িয়ে খালেদা জিয়া দেশব্যাপী রোডমার্চ করেন। এতে জনজোয়ার নামে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে গড়ে ওঠা জনস্রোতের এসব কর্মসূচিকে তেমন পাত্তাই দেয়নি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। জনসমর্থন ব্যাপকভাবে হারিয়েও সরকার আরও কঠোরতা অবলম্বন করে।
বিরোধী দলের কর্মসূচি রুখতে র্যাব-পুলিশকে অ্যাকশনে নামায় রাজপথে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া ১২ মার্চ ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি দেন। এ কর্মসূচিকে ঘিরে সরকারের মধ্যে পতনের ভীতি সঞ্চার হয়। ফলে রাজধানী ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরকার-ই তিন দিনের অঘোষিত হরতাল পালন করে। সরকারের সে কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়।
সরকারের নির্যাতন ও কঠোরতার মাঝেও নয়াপল্টনে বিশাল জনসমুদ্রে খালেদা জিয়া মহাসমাবেশ করেন। আর সেই সমাবেশ থেকে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহালে আগামী ১০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। এ আল্টিমেটামে সরকার দাবি না মানলে ১১ জুন ঢাকায় মহাসমাবেশের মাধ্যমে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে নামার হুশিয়ারি দেন খালেদা জিয়া।
এর আগেই ক্ষমতাসীন মহাজোটকে মোকাবিলার জন্য ২০১১ সালের জুলাইয়ে জোট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন চারদলীয় জোট নেত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তিনি পর্যায়ক্রমে বৈঠক করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার চেয়ারম্যান ডা. অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীসহ উল্লিখিত ১৮ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে।
এছাড়া গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সিপিবি সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খানকেও সমপ্রসারিত জোটে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ১৮ দল ছাড়া বাকিরা কেবল ইস্যুভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে আন্দোলনে সমর্থন ও নির্বাচনী জোটে অংশ নেয়ার আগ্রহ দেখান। তবে ১৩টি দল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের চলমান অহিংস আন্দোলনে অংশ নিতে শর্তহীন আগ্রহ দেখায়। একই প্লাটফর্মে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের স্বৈরনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সম্মত হন ১৩টি দলের নেতারা। আর সে আলোকেই গত ১৮ এপ্রিল খালেদা জিয়া ১৮ দলীয় জোটের রূপরেখা ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের আগে এ জোট আরও বড় হতে পারে বলে বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী আদর্শের এই ১৮ রাজনৈতিক দলের জোট নিয়ে আন্দোলনের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন খালেদা জিয়া। জোটের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজ নিজ দল, জোট ও সমমনা রাজনৈতিক দল এবং আর্থ-সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে সব গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর পক্ষে ঘোষণা দিচ্ছি যে একের পর এক জনস্বার্থবিরোধী, রাষ্ট্রঘাতী, সংবিধানবিরোধী, জনগণের ধর্মবিশ্বাসবিরোধী, স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, জনগণের ভোটাধিকার নস্যাতের ষড়যন্ত্র এবং সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সব বৈধতা হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের দেশ, জাতিসত্তা ও জনগণের স্বার্থবিরোধী অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করার লক্ষ্যে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চারদলীয় জোটের পাশাপাশি আন্দোলনরত সমমনা বিভিন্ন দল ও শ্রেণী-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। সে দাবি পূরণেই চারদলীয় জোট সমপ্রসারণ করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করা হয়েছে।
’
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের সফল আন্দোলন : ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। বিরোধী দল দমনে পুরনো স্টাইলে ফিরে যায় ওই সরকার। নির্বাচন কমিশনে দলীয়করণসহ পুরো প্রশাসন যন্ত্রকে কলুষিত করে ফেলে। সে পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী শাসনের লাগাম টেনে ধরতে ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিস ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলে।
রোডমার্চ, লংমার্চ ও হরতালে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের মাধ্যমে সেদিন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে নিয়ে ফলপ্রসূ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সেই আন্দোলন ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে ক্ষমতায় আসে।
সাতদলীয় জোট ও আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া : দলের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ওই বছরই রাজপথের আন্দোলনে নামেন তিনি। দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হওয়ার আগেই ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাতদলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে সফল করতে গঠিত এ জোটে ছিল—বিএনপি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি), জাতীয় লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নুরুর রহমান), বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ এবং ডেমোক্রেটিক লীগ (রউফ)।
এ সাতদলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়া রাজপথে সভা-সমাবেশ ও হরতাল কর্মসূচির মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৬ ও ৮৮-এর নির্বাচন বয়কট করে আপসহীন নেত্রীর অভিধা পান তিনি। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৮৯ সালের ১ নভেম্বর সাতদলীয় জোটের মাত্র ২৭ জন নেতাকে নিয়ে খালেদা জিয়া গুলিস্তান চত্বরে অনশন করেন। সেখানে অসংখ্য রাজনীতিক এসে সংহতি জানানোর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সফলতার দিকে এগিয়ে যায়।
এভাবে কখনও গৃহবন্দি, কখনও আত্মগোপন আবার কখনও গুলি-টিয়ারশেল-রাবার বুলেটের মধ্যে রাজপথে আপসহীন অবস্থানের ধারাবাহিক লড়াইয়ের পথ বেয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি এরশাদ বিদায় নিতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়।
দৈনিক আমার দেশ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।