পথ্য তো রোগীরও লাগে না ভালো! যদিও এটা তার রোগ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে,তথাপিও! নিশ্চয়ই গীতা সকল মানুষের গ্রন্থ। কিন্তু বেদ ও মনুসংহিতা যখন বলে নারীদের মন্ত্রে কোন অধিকার নেই, স্মৃতি ও ধর্ম শাস্ত্রে ইহাদের অধিকার নেই; তখন কোনটাকে ধরি আর কোনটাকে ছেড়ে দিই! শুদ্রের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম এ পর্যায়ে।
নাসত্দি স্ত্রী নাং ক্রিয়া মন্ত্রৈদিতি ধর্মে ব্যবস্থিতি।
নিবিন্দ্রিয় হামন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহ নৃতমিতি স্থিতিঃ \\\\ ১৮ \\\\
অর্থ: মাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে নারীদের মন্ত্রে কোন অধিকার নাই, স্মৃতি ও ধর্ম শাস্ত্রে ইহাদের অধিকার নাই, এই জন্য ইহারা নিতানত্দ হীন ও অপাদার্থ। " (সূত্রঃ মনুসংহিতা- ৯ম অধ্যায়, পৃষ্ঠাঃ ২৫০, শ্লোক-১৮, মূল সংস্কৃত-মনু, অনুবাদ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
এ পর্যায়ে স্মৃতি এবং শ্রুতি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক: স্মৃতি হল= গীতা আর শ্রুতি হল=বেদ
গীতোক্ত জ্ঞান্ বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি-গীতা আদিমানব মহারাজ মনুরও পূর্বে উদ্ভাসিত হয়েছিল- 'ইমং বিবম্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম' (৪/১) অর্জুন! আমি এই অবিনাশি যোগ-সম্বন্ধে কল্পারম্ভে সূর্যকে বলেছিলাম এবং সূর্য মনুকে বলেছিলেন।
মনু তা স্মৃতিতে ধারণ করেছিলেন, কারণ শ্রবণ করার পর বিষয়-বস্তু স্মৃতিতেই সুরক্ষিত করে রাখা সম্ভব ছিল। এই জ্ঞান সম্বন্ধেই মনু রাজা ইক্ষবাকুকে বলেছিলেন। ইক্ষবাকুর কাছ থেকে পরবর্তীকালে রাজর্ষিগণ জানতে পারেন এবং এই মহত্ত্বপূর্ণকালে এই অবিনাশি যোগ এই পৃথীবীতে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আদিকালে ব্রক্ষ্মার কাছে শ্রবণ করে তা স্মৃতিতে ধারণ করে রাখার পরম্পরার ছিল। লিপিবদ্ধ করে রাখার কথা কল্পনার বাইরে ছিল।
মনু মহারাজ এই জ্ঞান স্মৃতিতে ধারণ করেছিলেন এবং স্মৃতি-পরম্পরার প্রবর্তন করেছিলেন। অতএব এই গীতোক্ত জ্ঞানই বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি।
সৃষ্টির প্রথম মানুষ মনু মহারাজ যাঁর থেকে অন্যান্য মানুষের সৃষ্টি হয়েছে তিনি বেদকে শ্রুতি এবং গীতা শাস্ত্রকে স্মৃতির সম্মান দিয়েছেন। বেদ মনুর সমক্ষে আবির্ভূত হয়েছিল। বেদ শ্রবণ যোগ্য, শ্রবণ করুন।
যদি পরবর্তীকালে ভুলেও যান কোন ক্ষতি নেই; কিন্তু গীতা স্মৃতিগ্রন্থ, সর্বদা স্মরণ রাখবেন। এই গ্রন্থ শাশ্বত জীবন, শানত্দি, সমৃদ্ধি এবং ঐশ্বর্যসম্পন্ন জীবন প্রদানকারী ঈশ্বরীয় গায়ন। সূত্রঃ "যথার্থ গীতার উপসংহার থেকে গৃহীত, স্বামী অড়গড়ানন্দ।
গীতাকে যথার্থ শিরোনাম দিয়ে যথার্থ স্থানে উন্নীত করতে বেদকে টেনে নিচে নামিয়ে মনুস্মৃতির মান বাড়িয়ে দিয়ে উক্ত গ্রন্থকে সবার গ্রন্থ হিসেবে প্রতষ্ঠিত করার নিমিত্তে ভারতবর্ষের সাহিত্যকর্মের উদ্ধৃতি প্রদান করে উহার মাহাত্ম বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
"শ্রীকৃষ্ণকালীন মহর্ষি বেদব্যাসের পূর্বে কোন শাস্ত্র লিপিবদ্ধ ছিল না। শ্রুতজ্ঞানের এই পরম্পরা ভঙ্গ করে তিনি চার বেদ, ব্রহ্মসূত্র, মহাভারত, ভাগবত এবং গীতার মত গ্রন্থগুলিতে পূর্বসঞ্চিত ভৌতিক এবং আধ্যত্মিক জ্ঞানরাশিকে সঙ্কলিত করে শেষে নির্ণয় করলেন যে, 'সর্বোপনিষদো গাবো দোদ্ধা গোপালনন্দন।
' সমসত্দ বেদের প্রাণ, উপনিষদগুলোরও সার হল গীতা, যা গোপাল শ্রীকৃষ্ণ দোহন করে, অশানত্দ জীবকে পরমাত্মার দর্শন এবং সাধনের স্থিতি, শাশ্বত শানত্দির স্থিতি পর্যনত্দ পৌঁছিয়ে দেয়। সেই মহাপুরুষ নিজের গ্রন্থগুলির মধ্যে গীতাকে শাস্ত্রে পরিভাষা দিয়ে স্তুতি করছেন এবং বলেছেন,
'গীতা সুগীতা কবর্্য কিমন্যৈ: শাস্ত্রবিসত্দর্য:
যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্বিনি: সৃতা।
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, অ, ৪৩/১)
অর্থঃ গীতা উত্তমরুপে মনন করে হৃদয়ে ধারণ করার যোগ্য, যা পদ্মনাভ ভগবানের শ্রীমুখ নি:সৃত বাণী, এই যদি হয় তাহলে অন্যশাস্ত্র সংগ্রহের কি প্রয়োজন?
বহু যুগ ধরে যে 'স্মৃতি' বা সংহিতা ভারতের হিন্দুসমাজকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নানা বিধি-নিষেধের প্রাচীর ও শৃঙ্খল। কিন্তু আদপে তা নয়।
একটা সময়ে যখন সমাজ ও সামাজিক রীতিনীতি বৃহদাকার এবং জটিল হয়ে যায়, সেই সময় মনুসংহিতার ভূমিকা ছিল পথ প্রদর্শকের। ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ধর্মশাস্ত্রের (স্মৃতিশাস্ত্র) শিক্ষা গ্রহণ করেন স্বয়ং ব্রহ্মার কাছে। এটিই হল হিন্দু ধর্মের মনুসংহিতা আর এই মনুসংহিতাই হল হিন্দু আইনের মূল উৎস।
ন শূদ্রে পাতকংকিঞ্চিন্ন চ সংস্কারমর্হতি।
নাস্যাধিকারো ধম্মর্েহসত্দি ন ধমর্্মাৎ প্রতিষেধনম্ \\\\ ১২৬ \\\\
অর্থ: "শূদ্রের (নিষিদ্ধ দ্রব্য ভক্ষণে) কোনো পাপ নেই, সে (উপনয়নাদি) সংস্কারের যোগ্য নয়, ধর্মে তার অধিকার নেই, (শূদ্রের জন্য বিহিত পাকযজ্ঞাদি) ধর্ম থেকে তার নিষেধ নেই।
" (মনুসংহিতা- ১০ম অধ্যায়, পৃষ্ঠা: ২৯৮, শ্লোক-১২৬। মূল সংস্কৃত-দেবতা মনু, অনুবাদ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
যেখানে নারী আর শূদ্রের মন্ত্রে-স্মৃতিতে-শ্রুতিতে অধিকার নেই সেখানে কীরুপে গীতা সবার গ্রন্থ হতে পারে? তবে কি এখানে 'সবার' বলতে নারী এবং শূদ্র ব্যতিত সমসত্দ পুরুষের কথা বলা হয়েছে? এটা অনিস্বীকার্য যে গীতাতে অনেক বাক্যই রয়েছে যা একেশ্বরীবাদের মূলমন্ত্র, কিন্তু বহুঈশ্বরীয় ধারণা থেকে মুক্ত নয়। আবার আজন্মা স্রষ্টার সাথে সাথে বহুবার জন্ম নেয়া স্রষ্টার কথাও বাদ পড়েনি (গীতা ১০ঃ৩ কৃষ্ণ আজন্মা আর ৪ঃ৫ কৃষ্ণ বহুবার জন্ম নিয়েছেন)। তবে এমন একটি গ্রন্থকে তার স্বকীয় স্থানে উন্নীত করতে মহাভারতের মত কল্প-কাহিনীসম্বলিত গ্রন্থের সাফাই গাইলেন উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা? বরং সেই অধিক উত্তম হত যদি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণই গীতাতে বলেছেন যে ইহা সবার জন্য; -এইরূপ একটি শ্লোকের উল্লেখ করাটাই যথার্থ ছিল কি না? যিনি গীতার রচয়িতা, তিনিই মহাভারতের রচয়িতা বটে। আরো একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, চার বেদ থেকে শুরু করে ব্রহ্মসূত্র, মহাভারত, ভগবত এবং গীতার রচয়িতা যদি তিনিই হন তবে এসমসত্দ গ্রন্থের রচনাকাল একই হবার কথাছিল।
কিন্তু বিভিন্ন স্থানে ইহাদের রচনাকাল বিভিন্নরূপ! প্রাচীন পন্থী পন্ডিতদের মতে মহাভারতের রচনাকাল ধরা হয় ৩০০০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দ, আর বেদের রচনাকাল ধরা হয় ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ অব্দ পর্যনত্দ। কেননা, বেদ সম্পূর্ণ হতে বহুকাল সময় লেগেছিল। পন্ডিতগণের মতে গীতার রচনাকাল খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২০০ থেকে ২০০ অব্দ পর্যনত্দ। এইমতে বেদের পূর্বে মহাভারত রচনা হয়েছিল। অপর মতে মহাভারতের রচনাকাল ৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।
তাহলে মহাভারত বেদের অনেক পড়ে রচনা হয়েছিল। কোথায় ২৫০০ আর কোথায় ৪০০? গীতার ক্ষেত্রে বাড়তি ২০০-৪০০ বছরের তফাত! তবে কি বেদ-গীতা-মহাভারত প্রণেতা এতকাল অবদি উক্ত গ্রন্থ রচনার জন্যই বেঁচে ছিলেন? হয়ত! পুন: পুন: জন্মগ্রহণ করেছিলেন? প্রকৃতপক্ষে তা নয়, গীতা ধর্মের স্বতন্ত্র কোন গ্রন্থ নয়, বরং এটা মহাভারতের অংশ বিশেষ। সুতরাং, বেদব্যাসের মহাভারত থেকে গৃহীত হওয়ার ফলে এটার মূল লেখকও একই থেকে গেল। তবে পুরাণ কিংবা উপনিষেদগুলোর রচনাকালের দিকে লক্ষ্য করলে পুনরায় একই প্রশ্নে ফিরে যেতে হয়!
সে যাই বলুন, বিকৃত করে কি যথার্থ বানানো যায়? যা করা যায় তা নামেই মাত্র। যেমন ধরুন, প্রকৃত বিকৃতকারীদের কথা।
কতবার পরিবর্তন, পরিমার্জন-পরিবর্ধন হল; তবু কি মনুষ্য রচিত গ্রন্থের কোন উন্নতি হলো? ধাপে ধাপে সংশোধন করেও যীশুকে এখনো ক্রুস থেকে নামানো গেলনা। কেননা, কারো মতে তিনি ক্রুসবিদ্ধ, আবার কারো মতে তিনি উধর্্বগামী। তেমনি যোহনের মতে মধ্যপান স্বীকৃত, কিন্তু অপরাপর লেখকদের মতে পরিহারকৃত। পলের মতে মিথ্যা বলাতে দোষ নেই যদি তা হয়ে থাকে ঈশ্বরের ধর্ম প্রচার-প্রসারের জন্য, আবার একই গ্রন্থে পাওয়া যায় মিথ্যা বলো না।
সূত্রঃ ‘কেন এই মিথ্যাচার?’ লেখকঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
http://www.oneallah.org ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।