আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যাংক খাতে অশনি সঙ্কেত

আমি বাংলার গান গাই বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো তলবি আমানত অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাত বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কাজনক অবস'ায় পড়ে গেছে। ব্যবসায়বাণিজ্যে দুরাবস'ার কারণে তলবি আমানত ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এ অবস'া অব্যাহত থাকলে আর্থিক খাতে তহবিল সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। অর্থনীতির সর্বশেষ সূচক দিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) তলবি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অথচ আগের বছরও তলবি আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ধনাত্মক ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

তলবি আমানতের মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমে নেমেছে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। এতে ব্যাংকের সামগ্রিক আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও কমে গেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, ব্যবসায়বাণিজ্যে যখন স'বিরতা নেমে আসে তখন তলবি আমানত নেতিবাচক হয়ে পড়ে। কারণ এ সময়ে ব্যবসায়ীরা আগের মতো লেনদেন করতে পারেন না। তাদের হাতে টাকা থাকে না।

সবসময় ব্যবসায়ীরা টানাটানির মধ্যে থাকেন। আর মেয়াদি আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো সাধারণ মানুষ আর আমানত রাখতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতিই তাদের সঞ্চয় খেয়ে ফেলছে। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ দিন যাবৎ দুই অঙ্কের ঘরে অবস'ান করছে। আয়ের সাথে ব্যয় সঙ্কুলান করতে পারছেন না নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ।

এ কারণে এখন ভবিষ্যতের জন্য জমানো অর্থে হাত দিয়েছেন। মেয়াদপূর্তির আগেই ব্যাংকে জমানো স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি ডিপিএস ভেঙে ফেলছেন। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ায় কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর আমানত। তারা আরো জানিয়েছেন, বর্তমানে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশের ওপরে দাঁড়িয়েছে। সেখানে মেয়াদি আমনতের সুদের হার রয়েছে ১২ শতাংশ।

তলবি আমানতের সুদ আরো কম। এখানে প্রকৃত সুদ শূন্য বা নেগেটিভ হয়ে পড়েছে। এ কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করছেন বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তলবি আমানত সাধারণত কখনো নেতিবাচক হয় না। কারণ ব্যবসায়ীরা সবসময় ব্যাংকে লেনদেন করেন।

কিন' তলবি আমানত নেতিবাচক হওয়ার অর্থ হলো ব্যবসায়বাণিজ্যের গতি একেবারে শ্লথ হয়ে পড়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, এক দিকে শিল্পকারখানায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। কিন' পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। এতে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ের ব্যয় যখন বেড়ে যায় তখন ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

লোকসান হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। তখন ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে। এ কারণে ব্যাংকে লেনদেন কমে যায়। অপর দিকে ব্যাংকিং খাতের চেয়ে ব্যাংকবহির্ভূত খাতে অধিক মুনাফা পেলে তখন ব্যাংকে আর কেউ টাকা রাখেন না। অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন।

এ কারণেও তলবি আমানত কমতে পারে বলে তিনি মনে করেন। মেয়াদি আমানত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সাবেক এ গভর্নর জানান, মূল্যস্ফীতির কারণে যখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় তখন সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করতে পারেন না। উপরন' সংসারের ঘাটতি মেটাতে ভবিষ্যতের জন্য জমানো সঞ্চয়ে হাত দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় আমানত উত্তোলন হলে ব্যাংকিং খাতে নগদ অর্থের সঙ্কট দেখা দেবে। এটা সমন্বয় করতে না পারলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের সঙ্কটে পড়বে, যাতে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের তদারকি ব্যবস'া বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাতে বেশি মাত্রায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থনীতির সর্বশেষ সূচক দিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে ৭ দশমিক ৮০ শতাংশে। এ সময়ে তলবি আমানতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হওয়ার পাশাপাশি মেয়াদি আমানতও কমে গেছে। গত অর্থবছরের সাত মাসে মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসে কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর বিবেচ্য সময়ে তলবি আমানতের প্রবৃদ্ধি ধনাত্মক ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশে ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারক জানান, চলতি আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো ছোট ছোট সঞ্চয়লো মানুষ অভাবের তাড়নায় ভেঙে ফেলছেন। নতুন করে আর আমানত রাখতে পারছেন না। চলতি আমানতের অর্থ খরচ করার পর মেয়াদি আমানতে হাত দিচ্ছেন। এ দিকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ। উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে ধস নেমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র স'াপন বা এলসি খোলার হারের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮২ দশমিক ৪১ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ঋণাত্মক হয়েছে ৩৩ দশমিক ২২ শতাংশ। প্রকৃত পক্ষে বিবেচ্য সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে প্রায় ১১৬ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলার হারের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না।

সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস'ান। একে তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি অনেক চালু মিলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ হারাচ্ছেন কর্মক্ষম শ্রমিক। ফলে দুর্ভোগ আরো চরম আকারে বাড়ছে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মুর্শেদী জানিয়েছেন, গত বছর চার দফা বিদ্যুৎ, পেট্রল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েলের মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। মাত্র তিন মাস আগে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ২১ দশমিক ২৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল, যা রফতানি শিল্পের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

বিদ্যুৎ, গ্যাস, ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রফতানি শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বেড়েছে, যা রফতানিকারকদের সক্ষমতা হ্রাস করেছে। এ অবস'ায় বিশ্ববাজারে রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস'ান ধরে রাখা কঠিন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর ওপর সরকার ১২ ঘণ্টা শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ব্যবসায়বাণিজ্যকে আরো বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে। তিনি রফতানিমুখী শিল্পকে এ সিদ্ধান্তের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছেন।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস'াপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সঙ্কট চলছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে তারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এমনকি দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে পারছে না অনেক ব্যাংক। এ কারণে কলমানি মার্কেটের পাশাপাশি হাত পাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এর ওপর আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় তারা আরো সমস্যায় পড়েছেন।

তিনি মনে করেন, এ অবস'া চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। সুত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.