আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিপাই মুখে বাঁধ সর্ম্পকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফেরদৌসরে বক্তব্য।

আসুন উষ্কানী মূলক রাজনৈতিক বক্তব্য পরিহার করি। টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা এবং এর বিপক্ষে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের ব্যাপক প্রতিবাদের চিত্র ফুটে উঠেছে । টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে আমরা কথা বলেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফেরদৌস হোসেনের সাথে । রেডিও তেহরান : টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের সরকারের সাথে বিরোধী দল ও পরিবেশবাদীদের মতপার্থক্য এখন অনেকটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে । বিরোধী দল এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও পরিবেশবাদীরা বলেছেন, ভারত টিপাইমুখে যে বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অপরদিকে সরকারের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তারা এখনো নিশ্চিত নয় যে, ঐ বাঁধের ফলে আসলেই বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে । বাংলাদেশের ভেতরেই টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দুই মত সৃষ্টি কেন হলো ? অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন : এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, একটি আন্তর্জাতিক নদীর স্রোতধারা বা জলধারা যদি দু'টি দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং সেই নদীর উপর কোনো ড্যাম বা বাঁধ নির্মাণ করতে হয়, তাছাড়া সেই বাঁধের উচ্চতা যদি ১৫ মিটারের বেশী হয় তাহলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতেই সে ধরণের ড্যাম বা বাঁধ তৈরী করা যাবে । অন্যথায় আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো ড্যাম, বাঁধ কিংবা কোনো ধরণের স্ট্রাকচার নির্মাণ করতে পারবে না কোনো দেশ । আর এ ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে, ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বা আইনকে তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে টিপাইমুখ বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে । কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী প্রথমদিকে একবার বললেন, এই ড্যাম আগে নির্মিত হোক তারপর ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা প্রতিক্রিয়া জানাবো ।

মন্ত্রীর এই বক্তব্যে মানুষের মধ্যে অনেক শঙ্কা তৈরী হয়েছিল। জনগণ ধরেই নিয়েছিল সরকার এই বাঁধ নির্মাণের ফলে দেশের যে ক্ষতি হবে, সে ব্যাপারে উদাসীন। সরকার বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার জন্যে আন্তরিকভাবে কাজ করছে না । আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের পরিবেশবিদ, পানি বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এরই মধ্যে এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে সোচ্চার হয়েছেন । অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও এ ব্যাপারে বলেছেন, সরকারকে নীরব থাকলে চলবে না ।

তিনি এ বিষয়ে আরো বলেছেন, সরকারকে এ বিষয়ে ভারতের কাছে কঠোর প্রতিবাদ জানাতে হবে যাতে তারা টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ না করতে পারে । ভারত যদি টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করে তাহলে বাংলাদেশের অবশ্যই ব্যাপক ক্ষতি হবে এবং এ ব্যাপারে পরিবেশবিদ, পানি বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ একমত । এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, ভারত বাংলাদেশের স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে রুদ্ধ করবে এতে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না এটা ভাবার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না । আমি মনে করি, যে কোনো পর্যায়ে যদি পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে রুদ্ধ করা হয় তাহলে হয় বাংলাদেশের পানির প্রবাহ কমে গিয়ে নদীগুলোর নাব্যতা হারাবে অথবা বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির প্রবাহে বন্যা প্লাবিত হবে । অর্থাৎ বাংলাদেশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।

আর পরিবেশবিদরা ও পানি বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়টি যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছেন । কিন্তু সরকারের একেক একেক মন্ত্রী এ বিষয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তিমূলক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে - আমি মনে করি এই বিভ্রান্তি থেকে জাতিকে বেরিয়ে আসতে হবে । তাছাড়া এ ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার । সরকার যদি এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট না করে তাহলে জনমনে নানা প্রশ্ন , শঙ্কা ও সন্দেহ সৃষ্টি হবে । আর সেটি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয় ।

রেডিও তেহরান : আচ্ছা আপনি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কথা তুললেন তো এ প্রসঙ্গে ধরেই আমি জানতে চাইবো, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছেন, যারা টিপাইমুখ বাঁধের পক্ষে তারা দেশের বন্ধু নন । আপনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের এই মন্তব্য সম্পর্কে কি বলবেন ? অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন : অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের এ কথা অবশ্যই সত্য । কারণ টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এতে দেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে সব মহল অভিমত ব্যক্ত করেছে। সেখানে এই বাঁধের পক্ষে যারা অবস্থান নেবে তারা অবশ্যই দেশের বন্ধু নয় ।

তিনি কিন্তু আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের দায়িত্বে থেকে যেসব মন্ত্রী মহোদয় দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না, তাদের এত বড় দায়িত্বে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই । কারণ দেশের মানুষ ভোট দিয়ে যে সরকার নির্বাচন করে সেই সরকারের মন্ত্রীরা যদি দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থাকার অধিকার হারায় । মন্ত্রীরা যদি জনগণের কাছে তাদের দেয়া যে প্রতিশ্রুতি বা দায়বদ্ধতা সেখান থেকে সরে আসে তাহলে সেই সরকারের প্রতিও মানুষ অনাস্থা জ্ঞাপন করবে । রেডিও তেহরান : টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যে দুটো মত সৃষ্টি হয়েছে সে প্রসঙ্গ টেনেই আমি জানতে চাইবো, তাহলে এটা কি বলা যাবে যে, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশেই জাতীয় পর্যায়ে ঐক্যমত্য নেই ? অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন : হ্যাঁ, বাস্তব প্রেক্ষাপটে এ কথা বলা যাবে ।

আর এ বিষয়টি কিন্তু বেশ শঙ্কার । কারণ যেহেতু বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত । টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে এবং দেশটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারপরও যদি বাঁধের বিষয়ে জাতীয় সমঝোতা তৈরী না হয় তবে সেটি হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক একটি বিষয় । আপনারা লক্ষ্য করবেন, আসাম এবং মনিপুর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকাতেও এ বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে ।

কিন্তু বাংলাদেশের সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ বিষয় ছাপাই গাওয়া হচ্ছে , আবার বিরোধী দলও এ ব্যাপারে যে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে তা মনে হয় না । আর এসব কারণে বিষয়টি আমার কাছে খুবই হতাশাজনক বলে মনে হয় । আমি মনে করি এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের সচেতন জনগণ ও দেশ প্রেমিক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদ জানাবে । রেডিও তেহরান : বাঁধের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের ধারণাও তো ভুল হতে পারে । যেমন ভারতের হাইকমিশনার বলেছেন, না জেনেই বাঁধের বিরোধীতা করা হচ্ছে ।

কাজেই এমন কি হতে পারে না যে, জলবিদ্যুৎ তৈরীর জন্য যে বাঁধ তাতে আসলেই বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না । অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন : দেখুন, এ বিষয়টি নিয়ে অনুমানের উপর নির্ভর করে কিছু বলার কোনো যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই । এ বিষয়ে আমি দুটি বিষয় উল্লেখ করব । প্রথমত : দুই দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত একটি নদীর উপর উজানের দেশের এ ধরণের কোনো স্ট্রাকচার নির্মাণ করার অধিকার বা এখতিয়ার নেই । তারা আইনগতভাবে এ ধরণের কোনো বাঁধ নির্মাণই করতে পারে না ।

ফলে এটি করাটাই হচ্ছে ভারতে অন্যায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবার পদক্ষেপ । দ্বিতীয়ত: বাঁধ নির্মিত হলে ক্ষতি হবে কি হবে না এ বিষয়ে তো কোনো যৌথ সমীক্ষা আজ পর্যন্ত পরিচালিত হয়নি । যেহেতু যৌথ সমীক্ষা পরিচালিত হয়নি এবং বাংলাদেশের এক্সপার্টদেরকে সে বিষয়ে ইনভলভ করা হয়নি - তো এসব না করে কিভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হচ্ছে যে, এতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না । আমি বলবো আগে বাংলাদেশের এক্সপার্টদের নিয়ে যৌথভাবে সমীক্ষা পরিচালনা করে তারপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক বা বলা হোক ক্ষতি হবে কি হবে না । আর এসব কোন কিছু না করে ভারতের পক্ষ থেকে যদি দাবী করা হয় যে, এ বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতি হবে না এবং বাংলাদেশ সেটা বিনা স্টাডিতে মেনে নিচ্ছে - আমি মনে করি এ বিষয়টি অত্যন্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে বাংলাদেশের পক্ষে ।

বরং বাংলাদেশের উচিত হচ্ছে ভারতের এই বাঁধ নির্মাণ প্র্রক্রিয়ার বিরোধীতা করা এবং যৌথ সমীক্ষার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক নদী সক্রান্ত বিধি-বিধান কনভেনশন বিষয়ে স্টাডি করে সুনির্দিষ্ট প্রতিবাদ ভারতের কাছে উত্থাপন করা এবং প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক ফোরামে এ ইস্যুটিকে উত্থাপন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।