"ধর্মীয় কুসংস্কারে যারা আবদ্ধ তারা সব সময়েই দরিদ্র থাকে। " মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
“তথ্য-প্রযুক্তি” -আধুনিক বিশ্বে এই শব্দটির প্রয়োগ সর্বক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ সার্বিক কার্যক্রমকে গতিশীল তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর কোন বিকল্প নাই। “তথ্য-প্রযুক্তি” পরিণত হয়েছে একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মেরুদন্ড হিসেবে। সে বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের নির্বাচনী ইসতেহারে ই-গর্ভমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা বা জনগণকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবাদান নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন।
সেমোতাবেক, বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করছেন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এবং দেশের আপামর জনগণকে এই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করার জন্যে বদ্ধ পরিকর।
সময়ের সাথে সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রয়োগ সর্বত্র ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যবহার ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। উক্ত কার্যক্রমের সুষ্ঠু ও সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সকল ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির সুফল পাওয়া যাবে। বিশ্বের কোথাও আইসিটি বিহীন ভবিষ্যত অকল্পনীয়।
যেহেতু অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির তুলনায় আইসিটির ক্ষেত্রে সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনেক কম এবং যেহেতু মানব সমাজের ভবিষ্যত নিবিড়ভাবে আইসিটির সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাই দেশের কর্মসূচিতে এ প্রযুক্তিকে সম্পৃক্ত করা এবং বর্তমান পশ্চাদপদতা কাটিয়ে আইসিটিতে অগ্রগামী দেশ হিসেবে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে দৃঢ় কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদও অত্যন্ত সীমিত। সাধারণভাবে দেশে একমাত্র যে সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে তা হলো যুব সমাজ। এই যুব সমাজই হতে পারে আমাদের অর্থনীতির প্রধান উপাদান।
তাই আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ড তাদের কেন্দ্র করে পরিচালিত হওয়া উচিত। দেশের সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বহুল মানব সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সে লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন-২০০৯ এবং জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ অনুমোদন করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান এই অগ্রগতির সাথে সাথে এর অপব্যবহার তথা সাইবার অপরাধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও তা নিয়ন্ত্রনে সামর্থ অর্জনে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সাইবার অপরাধীদের চার ভাগে ভাগ করেছে।
এগুলো হলো- ভেতরের লোক, অনুপ্রবেশকারী, ভাইরাসের স্রষ্টা ও অপরাধী চক্র। কৌতূহলবশত কিংবা বিকৃত মানসিকতা থেকেই এরা এসব করে থাকে।
এখন দেশে ১০০ জনের মধ্যে তিনজন ইন্টারেট ব্যবহার করে। সেল ফোনের মাধ্যমেও ইন্টারনেট ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। যেভাবে সবকিছু এগোচ্ছে তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং এবং ইন্টারনেটের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়াবে।
কিছু কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানও ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়ার কর্মসূচি চালু করেছে। দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়। পাবলিক পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষার ফল এখন ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয় বিভিন্ন পরিশেবার বিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিশোধ করার সুবিধা চালু করা হয়েছে। বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রবেশ করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
স্বাভাবিকভাবে অপরাধীরা তাদের ক্ষেত্র হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। এ কারণে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে।
সম্প্রতি আশংকাজনকভাবে পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সাথে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। এ পর্নোগ্রাফি রোধে বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি যর্থাথ নয় বলে আবেদনে উল্লেখ করে এ বিষয়ে আদালতের একটি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালকের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে, দেশে বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি রোধে যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে একটি পূর্নাঙ্গ তথ্য-প্রযুক্তি আইন প্রণয়নে কেন নিদের্শ দেয়া হবে না- জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। একইসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে ওয়েবসাইট, মোবাইল ফোন, ভিসিডি, সিডি ও ম্যাগাজিনে পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেওয়া বন্ধে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- রুলে তাও জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগ (সূত্রঃ বিজয় নিউজ ২৪ ডট কম, শুক্রবার, ২৮ অক্টোবার, ২০১১)।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন-২০০৯ এর ৮ম অধ্যায়ে (যথাক্রমে ধারা ৫৪ থেকে ৬৭, ৬৮ থেকে ৮১ এবং ৮২ থেকে ৮৪) কম্পিউটার সম্পর্কিত অপরাধ, তদন্ত, বিচার ও দন্ড ইত্যাদি (যথাক্রমে অংশ-১: অপরাধ ও দন্ড; অংশ-২: সাইবার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা, অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপীল, ইত্যাদি; অংশ-৩: সাইবার আপীল ট্রাইব্যুনাল গঠন, ইত্যাদি) বিষয়ে বিশদ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বিশেষতঃ এই আইনের ৫৭নং ধারা অনুসারে- ‘ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দন্ড- (১) কোন ব্যক্তি যদি উচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বৎসর কারাদন্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।
৭৬নং ধারা অনুসারে- ‘অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা, ইত্যাদি- (১) ফৌজদারি কার্যবিধিতে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, নিয়ন্ত্রক বা নিয়ন্ত্রক হইতে এতুদদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা বা সাব-ইন্সপেক্টরের পদমর্যাদার নিম্নে নহেন এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তা এই আইনের অধীন কোন অপরাধ তদন্ত করিবেন। (২) এই আইনের অধীন অপারাধসমূহ অ-আমলযোগ্য (non-cognizable) হইবে। ’
তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনের সঠিক উপস্থাপন ও আইনের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ বাস্তবায়নে গুরুত্ব আরোপ অপরিহার্য। প্রয়োজনে আইন ও নীতিমালা পুনঃবিবেচনা করে সময়োপযোগী সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
[লেখকঃ প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।
ই-মেইলঃ ]
তারিখঃ ১১/১২/২০১১খ্রিঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।