আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার

"ধর্মীয় কুসংস্কারে যারা আবদ্ধ তারা সব সময়েই দরিদ্র থাকে। " মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন জন্মের পর আমাদের মায়ের মুখ থেকে যে ভাষাশুনে আসছি, সেটাই আমাদের মাতৃভাষা। নিজের মায়ের মতোই মাতৃভাষাকে আমরা সবাই ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। ভাষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এথনোলগ: ল্যাংগুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের ২০০৯ সালে প্রকাশিত হিসাবমতে, সারা বিশ্বে প্রায় সাত হাজার ৩৫৮টি ভাষা এবং প্রায় ৩৯ হাজার ৪০০টি উপভাষা রয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য একমাত্র জাতি বাঙালীরাই লড়াই করেছে।

সর্বপ্রথম রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার ইতিহাস পৃথিবীতে কেবল বাঙালী জাতিরই রয়েছে। বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চরম প্রকাশ ঘটে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষাকে বিশেষভাবে সম্মান জানানোর জন্য একটি দিবস আছে। বাঙ্গালীর সেই দিনটি হলো ২১ ফেব্রুয়ারি আর ভাষাটি হলো বাংলা।

জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা ভাষা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ভাষা বটে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা। বর্তমানে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গসহ প্রায় ২৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের ঘটনাটিকে পুরো বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় করতে ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিকেই প্যারিসে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় ভাষার জন্য এই বিশাল আত্মত্যাগের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

এর ফলে পরের বছর থেকে বিশ্বের ১৮৮ টি দেশ একযোগে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। আজও বিশ্বের দরবারে আমাদের এই অর্জনটি একটা বিশেষ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। আমাদের বাঙ্গালী আর বাংলা ভাষা-ভাষীদের জন্য এটা কতো বিশাল একটা গর্বের আর সম্মানের বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সময়ের সাথে সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এর প্রয়োগ সর্বত্র ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার সুফল দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে ছড়িয়ে দিতে হবে।

‘তথ্য-প্রযুক্তি’ -আধুনিক বিশ্বে এই শব্দটির প্রয়োগ সর্বক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। ‘তথ্য-প্রযুক্তি’ পরিণত হয়েছে একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মেরুদন্ড হিসেবে। বাংলাদেশে এর ব্যবহারও ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে। সরকার দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এবং দেশের আপামর জনগণকে এই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করতে হলে অবশ্যই একে সাধারণ মানুষের কাছে সহযবোধ্য করতে হবে। সে লক্ষ্যে এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব মার্তৃভাষার অর্ন্তভুক্তি প্রয়োজন। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা বাংলা এখনও অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বাইরে। আশা করা হচ্ছে আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই বাংলা ভাষা প্রযুক্তির সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্যথায় ডিজিটাল ডিভাইড তৈরী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আশার কথা এই যে, তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করতে, বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের ইনস্টিটিউশনাল সদস্য হয়েছে। গত ৩০ জুন ২০১০ তারিখে এই সদস্যপদ লাভ করে। ইউনিকোড পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার প্রতিটি অক্ষরের জন্য একটি একক সংখ্যা/নম্বর বরাদ্দ করে, সেটা যে প্লাটফর্মের জন্যই হোক, যে প্রোগ্রামের জন্যই হোক, আর যে ভাষার জন্যই হোক। ইউনিকোডে বিশাল লিপিসংকেতের সমর্থন থাকায় ক্লায়েন্ট সার্ভার বা বহুমুখী এ্যপ্লিকেশন এবং ওয়েবের গঠনে পুরনো লিপিমালার ব্যবহার না করে ইউনিকোডের ব্যবহার অনেক খরচ কমিয়ে আনতে পারে। ইউনিকোড কোনো বাড়তি প্রকৌশল ছাড়াই একটি সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইটকে বিভিন্ন প্লাটফর্ম, ভাষা এবং দেশে ব্যবহারযোগ্যতা দেয়।

এটা ব্যবহারের ফলে ডাটা বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে আনাগোনা করতে পারে কোনো রকম বিকৃতি ছাড়াই। অপরদিকে, কম্পিউটারে বাংলা ভাষা নানাভাবে লেখা যায়। কেউ বিজয়, কেউ অভ্র, কেউবা অন্য কোন কি-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করে বাংলা লিখছেন। কম্পিউটারে আমরা আমাদের দেশে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যে কি-বোর্ড ব্যবহার করছি, তাতে ইউএস-ইন্টারন্যাশনাল কি-বোর্ড লে-আউট অনুসরণ করেই ইংরেজি অক্ষরগুলো সাজানো থাকে। অধুনা কয়েকটি ব্র্যান্ড ইংরেজি কি-বোর্ড লে-আউট এর সাথে দ্বৈতভাবে বাংলা বিজয় কি-বোর্ড লে-আউট অনুসরণ করে ইংরেজি অক্ষরের পাশাপাশি বাংলা অক্ষরগুলোকেও তুলে ধরছেন।

ইউএস-ইন্টারন্যাশনাল কি-বোর্ড লে-আউট এর মত বাংলা লিখার জন্য দেরিতে হলেও বাংলাদেশের ন্যাশনাল (জাতীয়) কি-বোর্ড লে-আউট তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারকে আরো আগেই সিন্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। যাহোক, ইতোমধ্যে ন্যাশনাল (জাতীয়) কি-বোর্ড লে-আউট এর ব্যবহার/ পরিচিতি/ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তা অনুসরণ করে বাংলা টাইপ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলা একটি স্বাধীন দেশের একক ভাষা হিসেবে কম্পিউটার টাইপিং এর ক্ষেত্রে এর একক কী-বোর্ড লে-আউট থাকা আবশ্যক। তবে, ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেইস সফটওয়্যার ভিন্ন হতে পারে।

এতে করে কারো কোন বানিজ্যিক ক্ষতি হবে বলে মনে হয়না। বাংলা ভাষায় ইন্টারনেটে ডোমেইন (বাংলায় ওয়েব ঠিকানা লিখতে) রেজিস্ট্রেশন চালু প্রক্রিয়ধীন রয়েছে। ওয়েবসাইটের ডোমেইন নেম সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারনীমূলক যাবতীয় কাজ করে থাকে- ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন ফর এসাইন্ড নেমস এন্ড নাম্বারস (আইসিএএনএন)। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিতপত্র আইসিএএনএন বরাবরে পাঠানো হয়েছে। জাতীয় সংসদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসিকে সুপারিশ করেছিল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে অনলাইনে এ সম্পর্কিত একটি আবেদন করেন। আইসিএএনএন বাংলা ভাষার জন্য স্ট্রিং ইভ্যালুয়েশন (বাংলা অক্ষরগুলো চেনার জন্য নির্দিষ্ট কোড- আইডিএন সিসিটিএলডি) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এখন শুধু ইন্টারনেট এসাইন্ড নাম্বারস অথোরিটি (আইএএনএ) বাংলার জন্য কোডটি (আইডিএন সিসিটিএলডি) অনুমোদন (ডিএনস রুট জোন এ ডেলিগেট) করলেই ইন্টারনেটে বাংলায় ডোমেইন করা যাবে। ডেলিগেশন সম্পন্ন হলেই বিশ্বের সব বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বাংলায় নিজ নিজ ওয়েবসাইটের ডোমেইন নেম রেজিস্ট্রেশন করে ইন্টারনেটে প্রচার করতে পারবে। ইন্টারনেটে বাংলায় ডোমেইন লিখা নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার জন্য বড় সম্মানের।

খবরের কাগজে দেখলাম, আমদানি করা সব মোবাইল ফোন সেটেই বাংলা কি-প্যাড থাকতে হবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকেই মোবাইল ফোন সেট আমদানির ক্ষেত্রে বাংলা কি-প্যাড থাকা বাধ্যতামূলক। এটা হলে সাধারণ মানুষ আরও সহজে হ্যান্ডসেট ব্যবহার করতে পারবে এবং মোবাইল ফোনে বাংলা প্রচলন হবে। তবে টাচ স্ক্রিনের হ্যান্ডসেগুলো এই নির্দেশনার আওতা মুক্ত থাকবে।

পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আধুনিক হ্যান্ডসেটগুলোর ফিচারে বাংলা প্রচলন করার নির্দেশনা দেওয়া হবে। এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বিটিআরসিকে ধন্যবাদ। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলা কি-প্যাড লে-আউট কি রকম হবে সেটা নির্ধারণ করা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। আমার ধারনা মোবাইল ফোন সেটেও একক বাংলা কি-প্যাড লে-আউট থাকা আবশ্যক। এ বিষয়টি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারেন।

[লেখকঃ প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা। ই-মেইলঃ ] তারিখঃ ১৬/০২/২০১২খ্রিঃ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।