পেশায় নাবিক নেশায় যাযাবর
স্যার হেনরি মর্গান এর জাহাজ
প্রাচীন জলদস্যুদের নাম নিতে গেলে প্রথমেই আসে ইংরেজ জলদস্যু স্যার হেনরি মর্গান এর নাম। তিনি মূলত ছিলেন একজন বুকিনিয়ার,প্রাইভেটিয়ার এবং ব্রিটিশ রয়াল নেভির একজন এডমিরাল।
এটা ভাবতে অবাক লাগে একজন জলদস্যু কিভাবে নাইট উপাধি পেলো এবং ব্রিটিশ নেভির এডমিরাল হল। অনেকেই হেনরিকে জলদস্যু বলতে চান না বিশেষ করে ব্রিটিশরা। তাদের ভাষায় তিনি একজন বীর যোদ্ধা।
মূলত হেনরি একজন বুকিনিয়ার জলদস্যু হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করে ১৬০০ সালের দিকে। ক্যারিবিয়ান সাগর ছিল তার অলিখিত রাজত্ব। ঠিক এই সময় ব্রিটিশদের সাথে স্পেনের যদ্ধ শুরু হয়। রাজা দ্বিতীয় চার্লস হেনরিকে প্রাইভেটিয়ার হিসাবে কাজ করার অনুরধ করেন এবং স্পেনের কলোনিকে আক্রমণের অনুমতি দেন। হেনরি সুযোগটি লুফে নেয় কারন ব্রিটিশ নেভি অনেক দিন ধরে তাকে ধরার চেষ্টা করছিল।
এখন সেই ব্রিটিশ নেভির হয়ে কাজ করলে তাকে আর দৌড়ের উপর থাকতে হবে না। হেনরি মরগ্যান কিউবা, পানামা, এবং ভেনেজুয়েলা উপনিবেশসমূহে ব্যাপক আক্রমন করে। তার হিংস্রতা চারদিকে ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধের পাশাপাশি তিনি লুট তরাজ চালাচ্ছিলেন। ব্রিটিশরা তাকে প্রাইভেটিয়ার হিসাবে নিয়োগ দিলেও কখন বিশ্বাস করেনি।
তার সহযোগী হিসাবে ছিল কয়েকজন গুপ্ত চর। যুদ্ধ শেষে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ইংল্যান্ডে । তাকে শাস্তি দেবার জন্য ব্রিটিশ নেভি ধরলেও রাজা দ্বিতীয় চার্লস মনে করেন যুদ্ধ জয়ে হেন্রির ভুমিকা খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। তিনি আর জলদস্যুতা করবেন না এই মর্মে স্বিকারক্তি নিয়ে তাকে ব্রিটিশ নেভির এডমিরাল করা হয় এবং যুদ্ধে বীরত্বের জন্য নাইট উপাধি দেয়া হয়। এবং জ্যামাইকার ডেপুটি গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
শিল্পীর আঁকা হেনরি মর্গান এর একটা বিখ্যত ছবি।
হেনরি মর্গান এর যুদ্ধের ছবি
হেনরি মর্গান
হেনরি মর্গান -- যখন জলদস্যু
হেনরি মর্গান-- যখন গভর্নর
ব্লাক বিয়ারড
জলদস্যুতায় ব্লাক বিয়ারড সব চেয়ে ভয়ঙ্কর নাম । তার আসল নাম এড ওয়ার্ড টেক। জলদস্যু হিসাবে আত্ন প্রকাশের আগে তিনি ইংল্যান্ডে বসবাস করলেও তার জন্ম স্থান নিয়ে সন্দেহ কখন নিরসন হয় নি। ব্লাক বিয়ারড কে জলদস্যুদের গুরু ধরা হয়।
কারন তার মত ভয়ঙ্কর এবং হিংস্র জলদস্যুতার কথা কখন জানা যায় নি। তার শাররিক গঠন সাধারন মানুষের চেয়ে বড় ছিল। কথিত আছে সে সব সময় দুটো তলোয়ার, একাধিক পিস্তল এবং কয়েকটি চাকু সাথে রাখত। তার সমস্ত মুখ কালো দাড়িতে ঢাকা পরে থাকত। এবং এই দাড়ি সে ফিতা দিয়ে বেধে রাখত।
একারনেই তার নাম ছড়িয়ে যায় “ব্লাক বিয়ারড” নামে। তার চেহারা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে নিজ দলের সদস্যরাও তার দিকে সহজে তাকাত না। অনেকেই বলেন তার ভয়ে লোকজন তার নাম উচ্চারন করত না। তাই ছদ্ম নাম “ব্লাক বিয়ারড” ব্যবহার করত।
“ব্লাক বিয়ারড” এমনই আতঙ্ক ছিল যে,অনেক সময় শত্রুরা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করত।
ধন-সম্পদ-অস্ত্র নিয়ে “ব্লাক বিয়ারড” সবাইকে ছেড়ে দিত। আর যারা প্রতিরোধের চেষ্টা করত তাদের সে ভয়ঙ্কর ভাবে হত্যা করত। অনেক সময় সে লোকজনকে আহত করে এমন ভাবে রেখে যেত অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু বরণ করত। “ব্লাক বিয়ারড” খুব অল্প সময় মারাত্মক কুখ্যাতি অর্জন করে। ১৭১৭ সালে ব্রিটিশ নির্মিত একটি ফ্রান্সের জাহাজ লা কনকর্ড ছিনতাই করে ।
জাহাজটি ২৬ কামান সজ্জিত ছিল। ঐ জাহজটাকে সে ৪০ কামান জাহাজে রূপান্তরিত করে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করে। জাহাজটির নাম দিয়ে ছিল “Queen Anne's Revenge”
জলদস্যুতার ইতিহাসে এই জাহাজ টিকে সবচেয়ে ভয়ংকর বলে মনে করা হয়। ব্লাক বিয়ারড এই জাহাজটির সাথে আর ছোট চারটি জাহাজ নিয়ে রীতিমত একটা জলদস্যু জাহাজের বহর তৈরি করে ফেলেছিল। এই বহরে ছিল প্রায় ৩০০ জলদস্যু।
শ্ত্রুকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য সেই প্রথম মানুষের খুলি সম্বলিত পতাকা ব্যবহার করে। তার জাহাজে মানুষের কংকাল, খুলি এবং অনেক সময় সদ্য খুন হওয়া মানুষের রক্তাক্ত হৃদপিণ্ড ঝুলিয়ে রাখত সবাইকে আতঙ্কিত করার জন্য।
১৭১৮ সালের ২২শে নভেম্বারে এই জলদস্যুর ইতি ঘটে । উত্তর কেরলিনা কোস্টে নোঙ্গর করা অবস্থায় লেফটেনেন্ট রবার্ট মেনার্ড আবিষ্কার করে এই জলদস্যুকে । ব্লাক বিয়ারড তখন তার সাথিদের নিয়ে পার্টিতে ব্যাস্ত ছিল।
লেফটেনেন্ট রবার্ট মেনার্ড অনেক দিন ধরে এই জলদস্যুকে খুজে ফিরছিলেন। আচমকা তাকে পেয়ে তিনি কোন ভুল না করার সিদ্ধান্ত নেন। খুব ভেবে চিনতে তিনি সকালের আলোর জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্লাক তার সাথিদের সাথে পার্টি করে টায়ার্ড হয়ে যখন গভীর ঘুমে আছন্ন থাকবে তখনই আক্রমণ করা হবে। এই ফাকে তিনি ব্লাকের পালিয়ে যাবার সব পথে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে পাহারা বসায়।
অন্য দিকে নিজের সাফল্যে আত্ন বিশ্বাসী ব্লাক জাহাজে কোন লুক আউটের ব্যাবস্থাই রাখে নি। সে সবাইকে নিয়ে মজা করতেই ব্যাস্ত ছিল।
কিন্তু হঠাত করেই লেফটেনেন্ট রবার্ট মেনার্ড শুনতে পান জলদস্যুদের জাহাজে পার্টির আওয়াজ কমে গিয়েছে । এবং দূরবীন দিয়ে দেখতে পান ব্লাক তার জাহাজে ভেজা কম্বলের উপর গোলাবারুদ মজুত করছে এবং সমস্ত জাহাজের ডেকে বালু ছিটাচ্চে। সাধারণত বালু ছিটান হয় আহত লোকের রক্ত শুষে নেবার জন্য ।
লেফটেনেন্ট রবার্ট মেনার্ড বুঝতে পারল সহজে ব্লাককে কাবু করা যাবে না। ধূর্ত ব্লাক যে কোন আক্রমণের গন্ধ শুকতে পারে।
সবচেয়ে অবাক হল লেফটেনেন্ট রবার্ট মেনার্ড যখন দেখল ব্লাক তার জাহাজে পাল তুলছে এবং নিজে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে। লেফটেনেন্ট রবার্ট মেনার্ড ব্লাকের চালাকি বুঝতে পারল । সে তার জাহাজের নাবিকদের জাহাজের খাবার ও আসবাবপত্র পানিতে ফেলে দিয়ে জাহাজটিকে হালকা করার নির্দেশ দিল।
রবার্ট বুঝতে পেরে ছিল ব্লাক তার জাহাজটি নিয়ে সরাসরি রবার্টের জাহাজের দিকে আসবে এবং দুটো জাহাজের সংঘর্ষ করাবে। রবার্ট এবং তার সাথিরা অস্ত্র নিয়ে ডেকের পিছন দিকে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। ব্লাক তার জাহাজ দিয়ে রবার্টের জাহাজটিকে ধাক্কা মেরে প্রায় গুড়িয়ে দেয়। কিন্তু রবার্ট এবং তার সাথিরা চুপচাপ লুকিয়ে থাকে । ব্লাকের সঙ্গীরা সবাই মারা গেছে ভেবে লাফিয়ে রবার্টের জাহাজে চলে যায়।
ঠিক এই সময় রবার্ট তার দলবল পিস্তল নিয়ে ঝাপ্যে পড়ে। হতচকিত ব্লাকের সাথিরা লড়াই চালিয়ে যায় এবং ব্লাক সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হ্য় রবার্টের সাথে।
ভাগ্য এবার ব্লাকের সাথে ছিল না। নিহত ব্লাকের শরীরে পাঁচটি গুলির এবং বিশটি তলোয়ারের জখম ছিল। রবার্ট মৃত ব্লাকের মাথা কেটে নিজ জাহাজের সামনে লাগিয়ে দেয় এবং ব্লাকের জাহাজটি ঐখানেই ডুবিয়ে দেয়।
অনেক অনেক বছর পর জাহাজটি উদ্ধার করা হয় । উল্লেখ্য এই বীরত্বের জন্য রবার্টকে ঐ সময় ১০০ পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
ব্লাক বিয়ারড
“Queen Anne's Revenge” জাহাজ
ব্লাকের পতাকা
শত্রুকে ভয় দেখানো
ব্লাকের ঐতিহাসিক ছবি
অন্য জাহাজকে আক্রমণ
queen-annes-revenge জাহাজের ছবি
রবার্টের জাহাজে ব্লাকের কাটা মস্তক। ভয়ংকর জলদস্যুর করুন পরিণতি।
উত্তাল সমুদ্রের ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের কাহীনি ১ম পর্ব
চলবে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।