কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমার সারাজীবনের আদর্শ ছিলেন আমার আব্বা। আমাকে মেরে ধরে সত্য কথা বলা ও আমৃত্যু নীতির সঙ্গে থাকা শিখিয়েছেন অতি যত্নে। আর সেই আব্বার এমন অধঃপতন! কিভাবে? কিভাবে হল এটা? কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারলাম না। শুধু সারাজীবনের তিল তিল গড়ে তোলা আদর্শের ভিত এক ফুঁৎকারে ধুলোয় মিশে গেল আমার।
ভেঙ্গে গেল মানুষের উপর সমস্ত রকম বিশ্বাস।
আমার মনে পড়তে লাগল আব্বার উক্তিগুলো, ...সেটা নিয়ে তোর চিন্তা করা লাগবে না। তুই তোর মত পড়, আল্লাহ তোর পরিশ্রমের ফলাফল দান করবেন। সবাই তো আর প্রশ্ন কিনবে না। কয়জন কিনবে? একশ? দুইশ? বাকিরা তো তোরই মত।
...
সেই মানুষটা, সেই ফেরেস্তার মত মানুষটা, আজ কেন, কেন সত্যের পথ হতে সরে গেল? কেন সে দুর্নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করল?
অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিলাম না। তখন আমার ভিতরের আমিটা বলে উঠল, সব তোর জন্য।
চমকে উঠলাম বাইরের আমি। কেন?
তুই যদি সেদিন ওনাকে টাকা নিয়ে খোঁটা না দিতি তাহলে উনি আর এটা করত না।
তাই?
হ্যাঁ, তাই।
পুরো ব্যাপারটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে আব্বার প্রতি ছুঁড়ে দেয়া আমার কথাগুলো...
এইসব ভুয়া কথা রাখেন! আসল কথা বলেন। প্রশ্ন কিনতে কি লাগে জানেন? টাকা! অনেক টাকা! এত টাকা আপনি জীবনে চোখেও দেখেন নাই। এত টাকা কই পাইবেন আপনি? ঘরবাড়ি বেইচা দিলেও তো এত টাকা হইবো না। সেইজন্যেই তো আপনি এইসব নীতি আর চুরির কথা বলতেসেন।
নিজের ফুটা পয়সাও নাই সেইটা আর বলতেসেন না! প্রশ্ন কেনার টাকা যে আপনার নাই সেইটা আর বলতেসেন না!
লজ্জায় আমি এতোটুকু হয়ে গেলাম। নিজেকে মনে হল নর্দমার কিট। নিজের বাবাকে যে অন্যায়ের পথে যেতে বাধ্য করে, সে নরকের কিট ছাড়া আর কিইবা হবে?
আমি যে ঘরে ছিলাম সেই ঘরের দরজা বন্ধ। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রাতে আমার তিন সাবজেক্ট রিভিশন দেয়ার কথা ছিল।
কিন্তু বই আনি নি। গত দু রাতে ভালো ঘুম হয় নি তাই আজ রাতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমানো উচিৎ ছিল। কিন্তু সেটাও মনে হয় সম্ভব হবে না। তাহলে আমি এখন কি করব?
সবার মত প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করব? নাকি এখনই বাইরে বের হয়ে এই চক্রকে সবার সামনে ধরিয়ে দেব? সেটা কি একটু বেশী নাটকীয় হয়ে যাবে না? আমার জীবন কি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না?
আমি কিছুই করলাম না। মাথা ঝিম ঝিম করছিল।
মাথায় হাত রেখে চেয়ারে বসে রইলাম আমি। দেখলাম, অন্য মানুষগুলো কেমন অধীর আগ্রহে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। ওখানেই যে রয়েছে তাদের জীবনের মোড় ঘুরাবার চাবিকাঠি।
একটা বাজল।
দুইটা।
তিনটা।
চারটা।
পাঁচটা।
ছয়টা।
সাতটা।
প্রশ্ন আর এল না।
পূর্ণেন্দু পত্রী থাকলে হয়তো কবিতা লিখে ফেলতেন,
...যে প্রশ্ন আসার কথা
আসে না...
সাড়ে সাতটার দিকে দরজা খুলে গেল। একটা লোক বলল, প্রশ্ন আর আসবে না।
প্রথমে কেউই কথাটা ধরতে পারল না। কি?
লোকটা আবার বলল, প্রশ্ন আর আসবে না।
সারারাত জাগা গরুগাধার দল হঠাৎ মারমুখী হয়ে ছুটে গেল লোকটার দিকে। তাদের মনে তখন উছলে পড়া রাগ। কেন আসবে না প্রশ্ন? আমরা বাপের টাকা তোদের পাছায় ঢুকিয়ে প্রশ্ন কিনেছি না? কেন আসবে না প্রশ্ন? মার শালাকে। খতম করে দে।
লোকটা উত্তরে বলল, আমি তো ভাই আপনাদেরই গার্জিয়ান।
আসল কালপ্রিট তো আগেই পালিয়েছে।
ওদিক থেকে আমাদের গার্জিয়ানরা দলে দলে এদিকে আসতে লাগলেন। প্রত্যেকের মুখ চুন, চেহারা শুকনো। আমাদের মত তাদেরও রাতে ঘুম হয় নি। তাই ছেলে হাসিমুখে লেজ নাড়িয়ে ঢাকা মেডিকেলের চত্বরে ঘাস খাচ্ছে এই স্বপ্ন দেখার কোন সুযোগও তাদের হয় নি।
আমি আব্বাকে খুঁজে বের করলাম। আব্বা আমার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলেন না। আমরা একসাথে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে বেশ কয়েকটা মাইক্রো রাখা ছিল। কয়েকজন করে একেকটা মাইক্রোতে ঢুকে উঠে বসলাম আমরা।
মাইক্রোগুলো চলতে শুরু করল।
নয়টার দিকে আমাদের মাইক্রোটা আমাদের পরীক্ষার সেন্টারে পৌঁছাল। আমি নামলাম। মাথাটা কেমন বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল।
আব্বা কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেছিলেন, কিন্তু আমি তার আগেই হলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
কেমন করে যে পরীক্ষা দিলাম মনে নেই। কেমন করে যে জেগে ছিলাম তাও মনে নেই। শুধু মনে আছে একের পর এক প্রশ্ন আমার চোখের সামনে ভাসছে আর আমি একের পর এক বৃত্ত ভরাট করে যাচ্ছি।
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে এলাম। আব্বাকে খোঁজার চেষ্টাও করলাম না।
সামনে একটা মাঠ দেখে ওখানেই বসে পড়লাম। জামার দু তিনটা বোতাম খুলে শুয়ে পড়লাম মাঠের মধ্যেই।
তারপর আমাকে কিভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে গাজীপুরের বাসে আমি আর আব্বা পাশাপাশি বসে আছি। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছি না, কথা বলছি না।
বাস চলছে।
আমি ভাবছি, আব্বাকে এই জিনিসটার দিকে পুশ করার জন্য আমিই দায়ী। আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই আব্বা বলে উঠলেন, বাপ আমাকে ক্ষমা করে দে।
আমি কিছু বললাম না।
আব্বা বলে চললেন, আমার জন্যই তোর পরীক্ষাটা খারাপ হল। আমি না আসলে তুই অনেক ভালো পরীক্ষা দিতে পারতি। আমি তোর জীবনটা নষ্ট করলাম।
আমি নিশ্চুপ রইলাম।
আব্বা হঠাৎ আমার হাত ধরে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবি না বাপ?
ঠিক তখনই আমার মনে চিন্তাটা এল।
আব্বা আমার কাছে ক্ষমা চাইছে কেন? আমার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেবার পাপের জন্য? নাকি দুর্নীতির আশ্রয় নেবার ব্যাপারে তার কোন অনুতাপ নেই, প্রশ্ন ঠিক সময়ে আসে নি এটার জন্যই তার ক্ষমাপ্রার্থনা?
আমার সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করে আব্বা বললেন, তোকে আমি প্রশ্ন দিতে পারলাম না...
সাথে সাথে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম আমি, আব্বা আপনি এইটা কি বললেন?
আমি...অনেক চেষ্টা করেছিলাম প্রশ্ন পাবার...সবাই বলল...
আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, আমি তো রাগের মাথায় আপনাকে প্রশ্ন কেনার কথা বলেছি। তাই বলে আপনি আমার কথায় নিজের আদর্শকে ফেলে দিবেন? আপনিই তো শিখিয়েছিলেন ন্যায়কে কোনকিছু দিয়েই প্রতিস্থাপন করা যায় না। কিন্তু সেই আপনিই এটা কি করলেন? সন্তানের বাৎসল্যে ন্যায়কে ভুলে গেলেন? টাকা দিয়ে প্রশ্ন কেনার ব্যবস্থা করলেন?
টাকাটাই বা কোথায় পেলেন আব্বা? নানা দিয়েছে? আপনি না ওনার কাছ থেকে টাকা নেন না? মনে আছে ক্লাস এইটে আমি উনার দেয়া পাঞ্জাবি পরে ঈদের দিনে ঘুরেছিলাম বলে আপনি আমাকে কি মারটাই না দিয়েছিলেন? আপনিই না বলেছিলেন ঐ লোকের সব টাকা প্রতারণার টাকা, সুদের টাকা?
তাহলে এখন আপনিই কেন উনার টাকা নিলেন? এখন কি উনার টাকা খুব হালাল হয়ে গিয়েছে? কোথাও কি এরকম লেখা আছে যে “বিশেষ প্রয়োজনে সুদের টাকাও হালাল হিসেবে গণ্য হইবে”?
কিন্তু আসলে আমি কিছুই বললাম না। কিছুই বললাম না। অ্যাকচুয়ালি, ঐ দিন থেকে আমি আব্বার সাথে আর কথা বলি না।
***
এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পল্টুর গল্প শুনছিলাম। গল্প হঠাৎ শেষ হতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। বললাম, তারপর?
তারপর কি?
আরও তো অনেক বাকি আছে।
কি জানতে চাস বল।
তুই সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েও মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলি, তাই না?
অবশ্যই।
নাহলে এখানে কি করে এলাম?
তুই তোর আব্বাকে কখনই ক্ষমা করিস নি, তাই না?
তোর কি মনে হয়?
আমার তো মনে হয়, করিস নি।
করা কি উচিৎ?
জানি না, বললাম আমি, সত্যিই জানি না দোস্ত।
সেদিন রাতে আমি পল্টুর আব্বার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে আনমনা হয়ে পড়লাম। আমি যদি উনার জায়গায় থাকতাম তাহলে কি করতাম? ছেলেকে প্রশ্ন কিনে দিতাম? নাকি দিতাম না? কি করতাম আমি?
ন্যায় আর সন্তানবাৎসল্যের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গভীর অনিশ্চয়তায় দুলতে লাগলাম আমি। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমের মধ্যে অবচেতন মন আমায় একটা স্বপ্ন দেখাল।
স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম আমি। অন্যরকম একটা উপলব্ধিতে ভরে গেল সারা অন্তর। আমি বুঝতে পারলাম,
পল্টুর আব্বা সারাজীবন সৎ থেকেছেন বলেই জীবনের এমন কঠিন পরীক্ষায় খোদা তার মনস্কামনাও পূর্ণ করেছেন, আবার সত্যের পথ থেকেও বিচ্যুত হতে দেন নি। পল্টু চান্স পেয়েছে ঠিকই, আবার তার বাবাকেও প্রশ্ন কেনার অনুতাপে ভুগতে হয় নি।
আমি বিছানা ছেড়ে বাইরে এলাম। আকাশের দিকে তাকালাম। বিশাল আকাশে কত রকম তারা ফুটে রয়েছে।
আর কোন বাবা যেন পল্টুর বাবার মত ন্যায়কে সন্তানবাৎসল্যের কাছে জলাঞ্জলি না দেন। আর কোন বাবা যেন অবৈধ উপায়ে ছেলেমেয়েকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকানোর চেষ্টা না করেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত ব্যাপারগুলো যেন বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। আর, ভাবি আমি, আমার ঢাকা মেডিকেল কলেজ যেন অন্তত অ্যাপ্রন পরা গরু ছাগলের হাত থেকে মুক্তি পায়। চিরদিনের মত মুক্তি পায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।