আজকাল আমি প্রায়ই ভাবি আমি প্রাচীন কালের মনন নিয়ে আছি। দেশের অস্থিরতা, রাজনৈতিক বিষয়, সভা সমাবেশ-এইগুলো নিয়ে লিখতে পারিনা। আমার কাছে মনে হয় যারা দেশের প্রতিনিধি, সাংগঠনিক কাজের সাথে জড়িত তারা দৃষ্টি প্রতবন্ধি। আর তাঁদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতাটা এতটাই মারাত্মক যে আমার কাছে এটা ছোঁয়াচে রোগের মত মনে হয়। তাই লিখিনা এইসব নিয়ে, পাছে ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়ে আমিও আমার দৃষ্টিটা হারাই!! আর বাবা মা শিখিয়েছে যে কোন physically challenged ব্যক্তিকে ধিক্কার না দিতে।
এই শিক্ষা মনে রেখে আজকাল ধিক্কারও দিতে মন চায়না। তাই জীবন বাক্সের বাইরে গিয়ে কিছু কথা লিখতে চাই। চাই বাক্সের বাইরে জীবনটাকে দেখতে
আপনারা যখন “কাজের লোক”, “কাজের মেয়ে”, “চাকর”-এই শব্দগুলো ব্যবহার করেন বাসার কর্মসহযোগী মেয়ে কিংবা ছেলেটির জন্য, তখন কি একবার ও মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে-“ চাকর না হয়ে কি চাকরি করা যায় না??”। কারন সেই অর্থে বলতে গেলে আমরা সবাই যারা কোন না কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করি তারা সবাই তো চাকর। আমাদের কারো নামের সাথে আসে “অফিসার”, “ম্যানেজার” এই শব্দগুলো।
তাহলে আমাদের বাসায় যারা আমাদের সেবা করে, সাহায্য করে, তাঁদের কেন আমরা “চাকর” বা “কাজের লোক” বলে হেয় করি। আর যদি বলি, চাকর বা কাজের লোক শব্দটা সর্বজনগ্রাজ্য, তবে আমি বলব প্রতিটা অফিস আদালতে যারা চাকুরি করে তাঁদের নামের সাথে “চাকর” কথাটা যোগ করে দেয়া উচিৎ।
আমার একান্ত কিছু অনুভূতি প্রকাশ করেই বলি। আমাদের বাসায় কাজে সাহায্য করেন যিনি তিনি প্রাই ৩০ বছর ধরে আছেন। আমরা তাঁকে তার সেবা কর্মের জন্য বেতন দিচ্ছি, তাঁর পরিবারকে ক্ষেত্রবিশেষে সাহায্য করছি, কিন্তু তাঁর ঋণ কি শোধ করতে পারছি।
সেবার কি মূল্য হয়? পাঠক, আমার জীবন থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা বলে- সব সেবার মূল্য দেয়া অসম্ভব।
আমার এই আপার জীবনটি খুবই কঠিন। খুব দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ার দরুন খুব ছোটো বয়সেই বাসায় কাজ করা শুরু তাঁর। আমার নানাবাড়িতে ছিলেন তিনি। এরপর তাঁর বিয়ে হয়, কিন্তু যৌতূকলোভী স্বামীর অত্যাচারে দুই বছরের মাথায় স্বামীর ঘর ছেড়ে আবারো জীবনযুদ্ধে নেমে পরা।
আমাদের বাসায় এসে আবার তিনি জীবিকা উপার্জন শুরু করেন। আমাকে একদম ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছেন তিনি। মায়ের আদরের পাশাপাশি তাঁর আদরের কমতি ছিলনা আমার জীবনে। অন্য ছোট্ট বাচ্চাদের মত আমিও তাঁকে ছোটোবেলায় অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। আমার সাথে খেলতে না চাইলে কেঁদেছি, মাঝে মাঝে আঁচর, কামড় মারা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল।
কিন্তু যখন থেকে সচেতনভাবে ভাবতে শিখেছি তখন থেকে ভাবছিলাম তাঁর বা তাঁদের মত মানুষ যারা সেবা দিয়ে জীবিকা উপার্জন করে তাঁদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করা উচিৎ। ভেবে দেখলাম, তাদেরকে এমন একটা অনুভব দেয়া উচিত যে তাঁরাও আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাতারে পরে আর তাঁদেরও নিজস্ব সত্ত্বা আছে যার উপর তাঁদের একান্ত অধিকার।
আমি নিজে থেকে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি আমার বাসায়। যেমন আমি বড় হয়ে আমার আপাটিকে নাম ধরে ডাকা বা বুয়া ডাকার বদলে আপু বা আপা বলে ডাকি। প্রতি ঈদে আপাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি।
কারন ঈদে গুরুজনদের সালাম করা যদি রেওয়াজ হয়ে থাকে, তাহলে তাঁকে কেন গুরুজনের কাতার থেকে বাদ দেয়া হবে! আমার আপা খুব লজ্জিতভাবে ১০ টাকার একটা নোট আমার হাতে দেয় সালামি হিসেবে। পাঠক, আমি কখনই না করিনা ওই ১০টি টাকা নিতে। আমি তাকে অনুভব করাতে চাই এটাই স্বাভাবিক। এই ছোট্ট ও নগণ্য কিছু উদ্যোগ আমি আমার জীবনে নিয়েছি আমার আপাকে সম্মান করার জন্য। আপাকে পড়ালেখা শেখানোর চেষ্টা করে পারিনি, কিন্তু নাম লেখানো শিখিয়েছি।
সঞ্চয় করার জন্য ব্যাংকে DPS খুলে দিয়েছি।
এমন কিছু সাধারণ উদ্যোগ কিন্তু আমরা সবাই নিতে পারি। পাঠক, একবার ভাবুনতো আমাদের চাইতে আরও কত শত গুণ বেশি সংগ্রামী জীবন তাঁদের। আমার আপার কোন সন্তান নেই, আর তা নিয়ে তিনি প্রায়ই মনঃকষ্টে থাকেন। কিন্তু একদিন বল্লেন-“ভাল হইল কোন সন্তান নাই।
থাকলেও আমি চাইতাম না সে আমার মত হউক, মানুষের বাসায় কাম করুক। অরে তখন সবাই কাজের লোক কইত, লজ্জা পাইত। আমার পোলা বা মাইয়া আমার মত হইতে চাইবনা, লজ্জা পাইব। তাঁর চে আল্লা যা করছে ভালো হইছে”।
পাঠক, ওরা প্রতিদিন লড়াই করে।
হ্যাঁ, আমি মানছি বাসার সহযোগী নিয়ে অনেকের তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু তাই বলে তাঁদের হেয় করে ডাকা কি অন্যায় নয়?আমরা তাঁদের কর্মসহযোগী ডাকতে পারি বা helping hand. খুব একটা কঠিন তো না এতটুকু করা। আমরা প্রায়ই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে দুষি তাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতি, উদ্ধত সংস্কৃতি, পোশাক বা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করার জন্য। কিন্তু ওদের আরও একটা কাল অধ্যায় আছে যা থেকে ওড়া সফলতার সাথে মুক্তি লাভ করেছে এবং যা শিক্ষণীয়। একসময়য় এই দেশগুলোতে বর্ণবিভেদ ছিল চরমভাবে।
সাদা চামড়ার মানুষেরা কালো চামড়ার মানুষদের খুব ঘৃণা করতো। একই স্রষ্টাকে তারা ডাকতো ভিন্ন ছাদের নীচে দাঁড়ীয়ে, ওদের উপাসনালয়ও আলাদা ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের এই বর্ণভেদের মনোভাবকে ত্যাগ করেছে। আজ তাই একজন কালো চামড়ার মানুষ রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে পুরো দেশ পরিচালনা করছে আর প্রতিটি মানুষ তাদের এই কালো চামড়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে গ্রহণ করেছে সাদরে। হা, এখনো যে কিছুটা বর্ণবিভেদ নেই তা নয়।
এখনো আছে, কিন্তু তা পূর্বের তুলনায় নগণ্য। আমরা সমালোচক জাতী, সমালোচনা করা আমাদের খুবই পছন্দ। সমালোচনা করা ভালো, কিন্তু অন্ধ সমালোচনা করা নয়। যাদের আমরা সমালোচনা করি তাদের প্রশংসনীয় গুনগুলো আমরা রপ্ত করাতো দূর, অনুভবেও রাখতে চাইনা।
পাঠক, এমন অনেক দেশ আছে, যাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বা খনিজসম্পদ না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মানবসম্পদ দ্বারা আজ তারা উন্নত, সুশৃঙ্খল একটি জাতী।
জাপান দেশটি তার মধ্যে অন্যতম। আমরা জাপান থেকে সাহায্য নিচ্ছি ঠিকই কিন্তু ওদের উন্নতির চাবিকাঠি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিনা একদমই। আমরা মানুষকে সম্মান জানাই ততটুকুই যতটুকু তাঁর পদমর্যাদা আমাদের অনুমতি দেয়। তাঁর বাইরে কাউকে সম্মান জানাতে আমরা খুব কার্পণ্যবোধ করি। অথচ আমাদের স্বাধীনতা আর অস্তিত্ব খোঁজার ইতিহাসটি খুবই উজ্জ্বল ও গর্বের।
কিন্তু তাও কেন আমরা দৃষ্টিভঙ্গিটা আরেকটু প্রসারিত করতে পারছিনা। কেন আমরা চিন্তাগুলোকে ছকে ফেলে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি, কেন ভুলে যাচ্ছি জীবনটা স্বল্প সময়ের, তাই আমাদের এই স্বল্প সময়ের মধ্যে করনীয় কাজ যতটুকু করা সম্ভব তাই আমাদের অর্জন। আমি জানিনা আর কত দেরি হলে এই অর্জনের প্রতি আমরা সচেতন হব। সময়ের মূল্য আমরা দিতে ভুলে গেছি, কিন্তু জীবনের মূল্যও দিতে এতটা কার্পণ্য কেন আমাদের!!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।