শুভেচ্ছা
(ছবিতে সুলতান মোহাম্মদ বিজয়ীর বেশে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছেন)
কিংবদন্তী ইস্তাম্বুল:
তুরষ্কের একটি শহর ইস্তাম্বুল। শুধু শহরই নয়, বরং বলা চলে একটি কিংবদন্তী। একসময় এই ইস্তাম্বুল শহরই ছিল তুরষ্কের রাজধানী। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে শত্রু কর্তৃক অবরূদ্ধ হয়ে পড়ায় রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে যায় আংকারায়। তাই বলে প্রাচীন রাজধানী ইস্তাম্বুলের গুরুত্ব কোন অংশেই উপেক্ষা করা যায় না।
একদা গৌরবিনী এই ইস্তাম্বুলই ছিল পৃথিবী শাসনকারী বাইজ্যানটাইন ও পরবর্তীতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী। ইস্তাম্বুলে রয়েছে প্রভাবশালী সাহাবা আবু আইয়ুব আনসারী ও আরো অনেক সাহাবার পবিত্র সমাধি এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রীষ্টানদের মূল উপাসনালয় হাজিয়া সোফিয়া। সৌন্দর্যে অনন্য হাজিয়া সোফিয়া শুধু উপাসনালয়ই নয়, বরং তা বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নিদর্শন হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে ইস্তাম্বুলের বুকে। আজকেও স্থাপত্য শৈলীর ইতিহাসে প্রথম সারির স্থান দখল করে থাকে ইস্তাম্বুলের পুরাকীর্তী হাজিয়া সোফিয়া।
বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্য:
৬৪ খ্রীষ্টাব্দের কথা।
পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করছে বিশাল বিস্তৃত সীমানার রোম সাম্রাজ্য যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তার দাপটশালী সম্রাট নিরো। নীরোর শাসনামল খ্রীষ্টান প্রজাদের কাছে যেন নরকসম। বলা হয়ে থাকে নিরো নাকি রাজকার্যে উদাসীন ছিলেন। কথিত আছে রোমে যখন আগুন লেগে কয়েকদিন ব্যপী জ্বলছিলো, তখন তিনি নির্লিপ্ত মনে বাশী বাজাচ্ছিলেন। এতটা সরলীকরন ঠিক নয়।
কারন নিরো আগুনের এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন খ্রীষ্টানদের এবং ফলাফল হিসেবে তাদের উপর চলে আসা নিগ্রহ আরো বাড়তে থাকে।
কিন্তু দিন বদলায়। যে রোম সাম্রাজ্য ছিল খ্রীষ্টানদের উপর নির্যাতনের কেন্দ্রভূমি, সেই রোম সাম্রাজ্যের বুকেই খ্রীষ্টান ধর্ম পায় রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা। সম্রাট কনসট্যানটাইন গ্রহন করেন খ্রীষ্ট ধর্ম এবং তার পর থেকেই রোম সাম্রাজ্যে পৌত্তলিকতার প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। শুধু পৃষ্ঠপোষকতা নয় বরং আইন করা হয় খ্রীষ্ট ধর্মের অনূকূলে যার ফলে ইহুদী এবং পৌত্তলিক - এ দুই ধর্মের মানুষই হয়ে পড়ে কোনঠাসা।
বিশেষত সম্রাট হিরাক্লিয়াস ছিলেন কঠোর ইহুদী বিরোধী। সম্রাট জাস্টিনিয়ান এবং তার স্ত্রী থিওডোরার সময়ে খ্রীষ্টীয় ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ চরমে পৌছে। রোম সাম্রাজ্য এতটা বিশাল হয়ে যায় যে তাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়: পূর্ব ও পশ্চিম। কিন্তু পশ্চিমের পতন ঘটায় পূর্ব রোম সাম্রাজ্য হয়ে পড়ে মূল উত্তরসূরী যা পরিচিত হয় বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্য হিসেবে। রাজধানী হয় কনসট্যানটিনোপল, যা হল আজকের ইস্তাম্বুল।
ধর্মের রীতিনীতিতে কিছুটা পার্থক্য চলে আসে পশ্চিমের ক্যাথলিকদের থেকে। যার ফলে পূর্বের অংশের ধর্ম পরিচিতি পায় ইস্টার্ন অর্থোডক্স হিসেবে। হাজিয়া সোফিয়া ছিল ইস্টার্ন অর্থোডক্সদের মূল চার্চ।
প্রবল প্রতিরোধ মোকাবেলা করে ইস্তাম্বুল বিজয়:
কনসট্যানটিনোপল সবসময়েই ছিল শত্রুদের টার্গেট। মুসলিমরা বার বার আক্রমন করছিল এই শহরকে।
আল্লাহর রাসুলের ভবিষ্যৎবানী, "মুসলিমরা একদা কনস্টানটিনোপল বিজয় করবে। তাদের সেই বিজয়ী কমান্ডার কতই না সৌভাগ্যবান। সেই বিজয়ী সেনাদল কতই বরকতময়। " এই ভবিষ্যৎবানী বার বার উজ্জীবিত করছিল মুসলিমদের। এ ভবিষ্যতবানী কার জন্যে? মুসলিম সেনাদল তা জানত না।
৬৭০ সালে ইয়াজীদের শাসনামলে মুসলিমরা কনস্টানটিনোপল আক্রমন করে কিন্ত ব্যর্থ হয়। কনস্টানটিনোপল ঘিরে রয়েছিল মোটা পুরু দেয়াল যা ভাংগা ছিল অসম্ভব। সেই সেনা দলের একজন ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবা আবু আইয়ুব আনসারী (রা)। তিনি হতে চান রাসুল (সা) কর্তৃক ভবিষ্যৎবানীকৃত সৌভাগ্যবান সেনাদলের অংশ। কিন্ত ভাগ্য অপ্রসন্ন।
বৃদ্ধ আবু আইয়ুব আনসারী মৃত্যুশয্যায় পড়ে যান। সহযোদ্ধাদের তিনি অনুরোধ করেন তাকে সেখানেই দাফন করতে। ব্যর্থ মুসলিমরা সেবার কনস্টানটিনোপলে ফেলে আসে তাদের প্রিয় সহযোদ্ধাকে। সেখানেই পরবর্তীতে তার সমাধি সংরক্ষন করা হয়।
সময় গড়িয়ে যায়।
ইস্তাম্বুলের ভারী পুরু দেয়াল তাকে সুরক্ষিত করে রাখে বাইরের শত্রুদের কাছ থেকে। শত্রুরা পরাভূত হয় এই মজবুত দেয়ালের কাছে। কিন্তু কতদিন এভাবে শত্রূদের দাবিয়ে রাখা যাবে? ১৪৫৩ সালে তুর্কী বীর সুলতান মোহাম্মদ এক বিশাল সেনাদল নিয়ে হাজির হন কনস্টানটিনোপলের কাছে। তিনি এ দেয়াল ভাংগবেনই। দেয়াল না ভেংগে তিনি ফিরবেন না।
এ যেন ধনুর্ভাংগা পন। কিন্তু কি করে তিনি দেয়াল ভাংগবেন? হ্যা, তিনি সে কৌশল জানেন। বের করলেন অস্ত্র। মুহুর্মুহু গর্জনে যেন আগুন ছুটে এল দেয়ালের গায়ে। নগরীর বাসিন্দারা অবাক হয়ে দেখল পুরু দেয়াল ভেংগে গেছে।
হ্যা, অটোম্যান সাম্রাজ্য ততদিনে কামাণের সন্ধান পেয়েছে যা কনসটানটিনোপলবাসীরা জানত না। এই কামানই ছিল সে অস্ত্র যা কনসটানটিনোপলের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেংগে দেয়। কনস্টানটিনোপলের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেংগে যায়। নগরীর পরাভূত হয় শত্রূদের কাছে।
৫ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় কনস্টানটিনোপল অবরোধ।
২১ শে মে সুলতান মোহাম্মদ মুসলিম রীতি অনুযায়ী তৎকালীন কনসটানটিনোপলের সম্রাট কনসট্যানটাইনকে আত্মসমর্পন করতে বলেন। জানান বিনিময়ে তাকে একটি প্রদেশের ক্ষমতায় রাখা হবে। তার প্রজাদের সম্পদ, সম্মান, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেয়া হবে। কিন্ত কনসট্যানটাইন একজন স্বাধীনচেতা সম্রাট। বাইজ্যানটাইনকে পরাধীন দেখতে তিনি নারাজ।
সুলতানের ১০০০০০ সৈন্যের বিশাল বহরে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও তিনি আত্মসমর্পন করতে রাজী হন নি। যদিও তার ছিল মাত্র ৭০০০ সৈন্য। তিনি আশা করেছিলেন পাশ্ববর্তী খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে সহায়তা পাবেন। কিন্তু শেষ মুহুর্তে তাও তিনি সেরকম ভাবে পান নি। তা সত্ত্বেও তিনি গড়ে তোলেন প্রবল প্রতিরোধ।
শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করেন। জনগনের উদ্দেশ্যে তার শেষ জমায়েতে তিনি বলেন,
"আপনারা জানেন অধার্মিক এবং অবিশ্বাসী শত্রূরা অন্যায়ভাবে আমাদের শান্তি নষ্ট করছে। সে আমাদের সাথে কৃত চুক্তি ভংগ করেছে। আমাদের কৃষকদের হত্যা করেছে। এখন সে আমাদের এই শহর, আপনাদের পিতৃভূমি, সমস্ত খ্রীষ্টানদের আশ্রয়স্থল কনসটানটিনোপল দখল করতে চায়।
পবিত্র গীর্জাকে ঘোড়ার আস্তাবল বানাতে চায়। হায় প্রভু, আমার ভাইসব এবং সন্তানেরা শুনুন, খ্রীষ্টানদের শেষ সম্মান আপনাদের হাতে। "
(সেইন্ট কনস্ট্যানটাইন)
তার এই বক্তব্যে উজ্জীবিত হয়ে সম্রাটের অনুগতরা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করতে থাকে। একমাস যুদ্ধের পরেও কোন আশা না দেখে সুলতানের সৈন্যদের মনোবল ভাংগতে শুরু করে। কিন্তু সুলতান অটল।
কনস্টানটিনপল বিজয়ী না হয়ে তিনি ফেরত যাবেন না। এদিকে সুলতানের কয়েকজন তুর্কী যোদ্ধা ধরা পড়ে বাইজ্যানটাইনদের হাতে এবং নির্যাতনের মুখে মৃত্যুর আগে আগে অটোম্যানদের খননকৃত টানেলের অবস্থান বলে দিতে বাধ্য হয়। এই সব টানেল নগরবাসীরা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।
(ছবির চেইন দিয়ে প্রতিরোধ করা হয় সুলতানের সৈন্যদের, যা এখন তুরষ্কের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত)
সুলতান তার লক্ষ্যে অবিচল। তিনি ২৯ শে মে ভোর সকালে আজান দিতে বললেন।
ফজরের নামাজে সবাই দাড়ায়। সৈন্যদের রুকুরত অবস্থায় দেখে কনস্টানটিনোপলবাসী হতোদ্যম হয়ে যায়। এতটা একতা আর শৃংখলা এদের মাঝে!!!! ২৯ শে মে তারিখেই সুলতান আক্রমনের আদেশ দেন। প্রথম ঝটকায় যেসব সৈন্য প্রবেশ করে তারা প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় এবং মৃত্যুবরন করে। সুলতান এ দেখে তার আরো সৈন্যদের আদেশ দেন এগিয়ে যেতে।
প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি উপেক্ষা করে অটোম্যান সৈন্যরা এগোতে থাকে। এক পর্যায়ে অটোম্যানদের হাতে নগরীর পতন সুনিশ্চিত হতে থাকে। নগরীর পতন দেখে সম্রাট কনসট্যানটাইন স্বগতোক্তি করেন, "নগরীর পতন হয়েছে আর আমি এখনও জীবিত!" এই বলে তিনি রাজকীয় চিহ্ন খুলে ফেলে তার যোদ্ধাদের সাথে বীরপনে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরন করেন। তাকে সাধারন যোদ্ধাদের থেকে পার্থক্য করা যায় নি। বাইজ্যানটাইনের শেষ সম্রাট কনস্ত্যানটাইন তার বিশ্বাসে অটল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন, যার জন্য ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ এবং ক্যাথলিক চার্চ তাকে "সেইন্ট" উপাধিতে ভূষিত করে।
তিনি সেইন্ট কনস্টানটাইন হিসেবে মৃত্যু পরবর্তীতে স্বীকৃতি পান।
সৈন্যদের চাপের মুখে সুলতান তিনদিন নগরীতে লুটপটের শিথিলতা দেন। তিনদিন পরে পরিস্থিতি আয়ত্বে এনে তিনি প্রজ্ঞাপন জারী করেন, "নগরীর সব বয়েসের নারী পুরুষ এবার লুকানো থেকে বেরিয়ে আস, তোমরা মুক্তই থাকবে, তোমাদের কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হবে না। পুরোনো গৃহ এবং সম্পদ তোমাদের প্রত্যার্পন করা হবে। ধরে নাও কোন পরিবর্তন হয় নি।
"
সুলতান গ্রীক অর্থডক্স চার্চকে ছাড় দেন এবং চার্চ হিসেবে রেখে দেন। কিন্তু হাজিয়া সোফিয়াকে ছাড় দেন নি। হাজিয়া সোফিয়া পরিনত হয় মসজিদে। সাথে সাথে কাটতে থাকে হাজিয়া সোফিয়াকে ঘিরে থাকা কুসংস্কারগুলো। পরবর্তীতে মোস্তফা কামাল পাশা একে মিউজিয়ামে রূপান্তর করেন।
বর্তমানে হাজিয়া সোফিয়া হল মিউজিয়াম এবং এতে কোন প্রার্থনা নিষিদ্ধ।
১১০০ বছরের প্রাচীন কনস্টানটিনোপল ও বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে অটোম্যান সাম্রাজ্যের হাতে। আর অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন? তা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন মুস্তফা কামাল পাশা আনুষ্ঠানিক ভাবে তুরষ্ককে রিপাবলিক অব টার্কি ঘোষনা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ে তুরষ্ককে বিরাট মাশুল গুনতে হয়। আরবরা ব্রিটিশদের সাথে মিলে তুরষ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে।
অটোম্যান সাম্রাজ্যে আগেই ঘুন ধরে যায়, পরাজয় তাকে নিশ্চিহ্ন করে।
১৪৫৩ সালে অটোম্যানদের হাতে বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের এই পরাজয় তাদের জন্য একটি বড় আঘাত হলেও তা ইতিহাসে তাৎপর্যবহ। এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপে রেনেসার পথ খুলে যায়। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং পরবর্তীতে কয়েক শতক পৃথিবীতে ইউরোপীয় শাসন পোক্ত হয়।
সেদিনের এই জয় পরাজয় এখন শুধুই ইতিহাস।
আর তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোরানের কথা, মহান ঐশীবানীর কথা: "হে আল্লাহ! সাম্রাজ্যের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য প্রদান করো, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা কর রাজত্ব ছিনিয়ে নাও; আর যাকে খুশী সম্মানিত করো, আবার যাকে খুশী অপমানিত করো - তোমার হাতেই রয়েছে কল্যান। নিঃসন্দেহে তুমি সবকিছুর উপরে সর্বশক্তিমান। " (ইমরান :২৬) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।