হরবোলা
হরি বাবুর আনন্দ আর ধরেনা। ছেলে নিতেশ আজ আবু দুবাই যাবে। তিনিও ছেলের সাথে ঢাকা পর্যন্ত যাবেন। এই প্রথম ঢাকা যাচ্ছেন হরি বাবু। লঞ্চে প্রথম সদরঘাট, অতঃপর রায়সা বাজার।
তার পর বাসে সোজা বিমানবন্দর। বুড়ো বয়সে কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভব করছেন। নিতেশ, মাসি পিসিকে কাঁদিয়ে বাবার সাথে লঞ্চঘাটে। লঞ্চে করে সদরঘাটে। সদরঘাটে বাস, সিএনজি কিছুই নাই।
আছে কেবল রিক্সা। আজ ২০শে ফেব্রুয়ারী। বিরোধী দল কি যেন দাবীতে অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে। রোড়-ঘাট ফাঁকা। সদরঘাট থেকে রায়সা বাজার হেঁটে আসল নিতেশ ও হরি বাবু।
রায়সা বাজার হতে সিএনজিতে বিমানবন্দর। দুপুর ১২ টা বাজে। নিতেশের উড়াল দুপুর ২ টায়। তাকে এখনি অভিবাসনে যেতে হবে। বাবকে কদমবুচি করে নিতেশ ঢুকে পড়ল অভিবাসনে।
হরি বাবু ছেলেকে বিদায় দিলেন। কাঁধের থলে নিচে রেখে বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে ধাবনভূমিতে বিমানের উঠা-নামা দেখছেন। ঘোষণা হচ্ছে বিভিন্ন উঠা-নামার সময় সূচী। মহিলা কন্ঠের বাংলায় ঘোষণা হরি বাবু স্পষ্ট বুঝতে পারছেনা। তার মনে হচ্ছে মহিলা বাংলা জানেনা।
বাংলা না পারলে বরিশাইল্লা কইবার পারে। কেমন যেন ঢং করে কথা কয়। । ভাল্লাগেনা। হঠাৎ ঘোষণা, বিজি ০০৭ বিকাল ২ টা ৩০ মিনিটে আবুধাবীর উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ত্যাগ করিবে।
। ওমনি বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠল। একটা কষ্ট। নীল কষ্ট। এমন কষ্ট জীবনে আরেকবার পেয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে যখন তার বন্ধু নরেনরা ভারত চলে গেল। হঠাৎ বিমান উড়িল। হরি বাবু হাত নাড়িল। চোখের কোণে জল জমিল।
হাতে মুখ মুছে দেখেন থলেটি নাই।
ঢাকা শহরে বড় লোকেরা থাকেন। তারা চুরি করেন না। তাহলে থলেটি গেল কই। মনের নীল কষ্টটা আরও বাড়ল। যাওয়ার সময়ে নিতেশ বলেছিল বিমানবন্দর থেকে সদরঘাটের বাস ধরতে।
বাস বিরতিতে এসে দেখেন বিশাল ভীড়। সকালে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা ছিল। বিকালে এত লোক এল কোথা থেকে। বাসের হাতল ধরতেই বাসের প্রদর্শক ধাক্কা দিয়ে বাসে তুলে দিল। হরি বাবু একেবারে পিছনের সারীতে বসলেন।
সারাদিন কিছু খান নি। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। সদরঘাটে নেমে ইউছুফের বিরানী খাবেন। বউয়ের জন্য বাকরখনি নিবেন। নিতেশ যাবার সময়ে সব বাংলা টাকা দিয়ে গেছে।
সারাদিনের ক্লান্তি। অতঃপর বাসে ঘুম। বাস প্রদর্শকের ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গল। বাস প্রদর্শক, কই যাবেন চাচা মিয়া? সদরঘাট। ভাড়া দেন।
হরি বাবু জেবে হাত দিতে দেখেন জেব কাটা। এক কানাকড়িও নেই। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন হরি বাবু। বাস প্রদর্শক শাহবাগে নামিয়ে দিল। বেলা ৫ টা।
ক্ষিধায় পেট জ্বলে। শাহবাগের মোড় পেরিয়ে ফুলের দোকান গুলোর সামনে এলেন। এক সাথে এত ফুল দেখে মন ভাল হয়ে গেল। অনেকে ফুল কিনছে। এরা এত ফুল দিয়ে কি করবে।
ফুল কি আর খাওন যায়। এ গুলোতো ফুলকপি আর পাতাকপি না। দোকানীকে জিজ্ঞেস করে, “এত ফুল দিয়ে এরা কি করবে”। দোকানী, আগামীকাল ২১শে ফেব্রুয়ারী। অনেক অনুষ্ঠান অনেক ফুল লাগবে।
হরি বাবু কিছুই বুঝলনা। দেখলেন, গাড়ীতে ওঠানোর সময়ে একটা লাল গোলাপ পড়ে গেল। হরি বাবু এদিক ওদিক চেয়ে গোলাপটি কুড়িয়ে নিয়ে সামনে রওনা হলেন।
এক চা বিক্রেতাকে জিজ্ঞেসিলেন, “দাদা সদরঘাট কোন দিকে”? তাতো অনেক দূর। তয় আপনি ঢাকা শহরে নতুন মনে হয়।
জ্বী। বাড়ী কই। হরি বাবু, “বরিশাল”। ইয়েনতুন সদরঘাটের বাসে উঠলে হবে। দাদা মোর ধারে টাহা নাই।
টাহা নাই ঢাহা আইছ কেন? চা ওয়ালা কাদের কে হরি বাবুর আপন মনে হচ্ছে। আপনজনকে অসুবিধার কথা বলতে দোষ কি। হরি বাবু বলেন, “সারাদিন কিছু খাইনি, কথা বলতে পারছিনা দাদা”। আই চা বেঁচি, খালি পেটে চা ঠিক না; চল ভাপা পিঠা খাই। ওই ছকিনা চারটা ভাপা পিঠা দে।
ছকিনা, “টাকা কেড়া দিব”? আই কাদিরা দিমু। এরে ছকিনা নোয়াখাইল্লারা ভিক্ষা করে না।
কাদের ও হরি ভাপা পিঠা খেল। চা খেল। কাদের, শুন মিয়া টাকা ছাড়া বইশাল কেমনে যাবা? আমার সাথে একদিন থাক।
আগামীকাল ২১শে ফেব্রুয়ারী। সারাদিন দু’জনে চা কফি বেঁচুম। তোমাকে ২০০ টাকা দিমু। তয় কাইল্লা বিয়াইল্লা বইশাল যাবা। হরি মহা খুশি।
দুই জনে মিলে রাত ১১টা পর্যন্ত চা বিক্রি করল। রাত ১২টায় ঢাকা মেডিক্যালের পিছনে রাস্তার ফুটপাতে কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনে।
হরি নাক ডাকিয়া ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ মচমচানী। ঘুম ভেঙ্গে দেখেন পুলিশ।
ভয়ে আড়ষ্ঠ হরি। কাদেরকে পুলিশ গাড়ীতে তুলে নিল। হরিকে দু’বেত মেরে বলল, এই এলাকায় থাকা যাবেনা। আগামী কাল মহান ২১শে ফেব্রুয়ারী। মহামান্য রাস্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমণ্ত্রী শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসবেন।
পুলিশের তাড়া খেয়ে একটু সামনে গিয়ে দেখেন লোকে লোকারণ্য। । প্রভাতফেরী। সবার হাতে ফুল। গতকাল লাল গোলাপটা ফতুয়ার জেবে রেখেছিল হরি।
বাসি গোলাপটা হাতে নিয়ে জনতার কাতারে মিশে গেল। চপ্পল খুলে সবার সাথে শহীদ মিনারের মূলবেদীতে উঠে এত ফুল দেখে হতবিহব্বল। তাহার ছোট্ট গোলাপটি কোথায় রাখবে বুঝতেছেনা। ফুলের সাগরে চুপিসারে তার গোলাপটি রেখে মূলবেদী থেকে নেমে গেল হরি।
প্রভাতের আলো ফুটছে।
হরি, “দাদা সদরঘাট কোন দিকে?” কেন? আমি সদরঘাট যাব। ভদ্রলোক, আমিও যাব চলেন এক সাথে যাই। দাদা, আমার টাহা নাই। আমার সাথে চলেন, আমি রায়সাহেব বাজার নেমে যাব। রিক্সা আপনাকে সদরঘাটে পৌঁছে দিবে।
ভদ্রলোক রায়সা বাজার নেমে গেল। রিক্সা ডার্কমেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে-
যে সবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্নয় ন জানি।
হরি এই সবের কিছুই বুঝেনা।
লঞ্চ ঘাটে এসে ঘুরোঘুরী করছে। জেবে টাকা নাই টিকেট কিনবে কেমনে। ২১-২২ বছরের এক যুবক বলল, চাচা মিয়া কি খুঁজেন। বা-জান রহিম হাওলাদারকে। বাড়ী গৌরনদী।
সদরঘাটে চাকুরী করে। চাচা আমার বাড়ীও গৌরনদী। কি চাকুরী করে? তাতো জানিনা। তাহলে খুঁজে পাবেন না। কোথায় যাবেন চাচা? গৌরনদী।
তাই নাকি! আমিও। বা-জান আমার টিকেট কিনার টাকা নাই। টিকেটের টাকা আমি দেব। হরি বাবু কিছুটা বিস্মৃত হল। ভাবছে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে সবাই বোধ হয় খাতির করে।
আহা! গতকালটাও যদি ২১শে ফেব্রুয়ারী থাকত। লঞ্চে দু’জনে পাশা-পাশি বসল।
যুবক বেতারে গান শুনছে। হরি বাবু, বা-জান শব্দ বাড়িয় দাও। আমরাও শুনি।
যুবক তাই করল। হ্যাঁ। আমি রেশমা, রেডিও ফূর্তি থেকে। আপনাদেরকে ২১শে ফেব্রুয়ারীর শুভেচ্ছা। ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিশেষ অনুষ্ঠানে আপনাদের শুনাব হিন্দি হিট সং।
লেটস গো। লেকিন গানা ভি আচ্ছা হুনা। রেডিও ফূ্র্তিতে বাজছে, এক লাড়কি কো দেখা তো এসা লাগা.........।
যুবকের অপর পাশে বসা ভদ্রলোক জিজ্ঞেসিল, এই ছেলে কি নাম তোমার। হাসান।
কি কর তুমি? পড়ি। ইউনিভার্সিটিতে। কোন ইউনিভার্সিটিতে? ডার্কমেটারে। আপনি কে? কি করেন? মুবারক আলী। পড়াই।
ডার্কমেটারে পদার্থবিজ্ঞান পড়াই। শুন, তোমাদের এই প্রজন্মের ফিউশন শুনে আমাদের রুচির ১২টা বেজেছে। হিন্দি, বাংলা ও ইংলিশ মিশিয়ে তোমরা হিংলিশ নামের কি যেন ক্লোন বানাইছ, যাতে বাংলার শুধু অনুস্বারটা রেখেছ। আতশী কাঁচ দিয়ে বাংলা খুঁজে পাইনা। আরে মিয়া বিদেশী চুরুট ফুঁকে স্বদেশী আন্দোলন।
ভন্ডামী ছাড়। ঘরে বউ আর মেয়ে সারাদিন হিন্দি সিরিয়াল দেখে, বাহিরে উনি গলা ফাঁটিয়ে ভারতের গোষ্ঠী উদ্ধার করে। সু্স্থ সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটলে আবর্জনা জায়গা ভরাট করবে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, “প্রকৃতি শুণ্যতা পরিহার করে”। রেডিও ফূর্তি না করে রেডিও নোয়াখালী বা রেডিও বরিশাল কর।
তাহলে অন্ততঃ বাংলা ভাষার ডায়লেক্ট গুলো বেঁচে থাকবে। আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলরে সবার মাথা খাইল রে, গানটা শুন। লালন, আউল, বাউল, জারী, সারি, মারফতি, মনিপূরী, গম্ভীরা, বাওয়াইয়া ইত্যাদিতে তোমাদের মন ভরেনা। পপ, রক্, জ্যাজ্, হেভিমেটালে তোমাদের মনবসে। নিজকে ভেঙ্গে চুরে পরের ছাঁচে গড়ে মেকি সাজার মধ্যে কি আনন্দ তা তোমরা জান।
মুবারক আলী উত্তেজিত। উঠে দাঁড়ালেন আবার বসলেন। ছাত্রের সাথে রাগ দেখানো শোভন নয়। তাই কথা বন্ধ করে বুড়ি গঙ্গার পানির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কাক চক্ষুর মত স্বচ্ছ পানিতে তাকালে নিজের মুখবয়ব দেখার সাথে সাথে রাগ পানি হয়ে যায়।
কিন্তু বুড়ি গঙ্গার পানির কি আর সে হাল আছে। মুবারাক আলী বুড়ি গঙ্গার ঢেউ গুনছে আর গুণগুণ করে গাইছে-
কহিল গুণ গুণে একুশ এল আট ফাল্গুনে।
একুশেরই মর্ম জ্বালা উথলে ওঠে হৃদয় কোণে।
তপ্ত প্রাণ সিক্ত হয় একুশের জয় গানে।
কহিল গুণ গুণে একুশ এল আট ফাল্গুনে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।