একদিন তুমি ডাক দেবে, আমি প্রতীক্ষায় আছি কথোপকথন
: আপনার নাম শফিকুল ইসলাম?
: জি।
: রানা প্লাজার ঘটনায় নিহত আঁখি আপনার কে হয়?
: আঁখি আমার বোন।
: লাশ পেয়েছিলেন?
: না, বোনের লাশ তো পাই নাই।
: সরকারের পক্ষ থেকে বা অন্য কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য পেয়েছেন?
: না, কোনো সাহায্য পাই নাই।
: আপনার নাম ইবরাহিম শাহ?
: জি।
: আপনার মেয়ের নাম সাগরিকা? রানা প্লাজায় নিহত হয়েছিলো?
: জি।
: মেয়ের লাশ পেয়েছিলেন?
: না, মাইয়ার লাশ তো পাই নাই।
: সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন?
: কয়েকজন হুজুর ৬ হাজার টাকা দিছে। এছাড়া আর কোনো সাহায্যই পাই নাই।
: আবদুল হামিদ বলছেন?
: জি।
: রানা প্লাজার ঘটনায় আপনার কে নিহত হয়েছে?
: আমার এক মেয়ে আর এক ছেলে নিহত হইছে।
: দুজন?
: জি, দুই ভাইবোন।
: লাশ পেয়েছিলেন দুজনের?
: জি, মেয়ের লাশ পাই ১৫ দিন পর আর ছেলের লাশ পাই ১০ দিন পর।
: সরকারের পক্ষ থেকে কী সাহায্য পেয়েছেন?
: লাশের সঙ্গে ২০ হাজার কইরা ট্যাকা পাইছিলাম, আর কওমী নামের একটা সংগঠন থিকা ১০ হাজার ট্যাকা পাইছিলাম। আর কোনো সাহায্য পাই নাই।
: আপনার নাম রিক্তা?
: জি।
: রানা প্লাজার ঘটনায় নিহত হওয়া নার্গিস আক্তার আপনার কে হয়?
: আমার বোন।
: লাশ পেয়েছিলেন?
: লাশ পাইছিলাম ১৪ দিন পর। পইচা গইলা গেছিলো।
: সাহায্য-সহযোগিতা...।
: লাশের লগে ২০ হাজার আর একটা সংগঠন থিকা ৪ হাজার, ক্যান্টনমেন্ট থিকা ১ হাজার ট্যাকা পাইছি। আর কিছু পাই নাই।
চাপ চাপ কষ্ট, জীবনযুদ্ধের যাতনা
‘আমি ট্যাহা-পয়সা কিছু চাই না রে বাপ! আমার পোলার লিগা খালি এড্ডু দোয়া কইরো রে। আমার নাতি দুইডারে আমি ভিক্ষা কইরা মানুষ করুম... আমার মানিক তো কোনোদিন ফিরবো না রে...। ’ বলতে বলতে এই প্রতিবেদকের পা জড়িয়ে ধরেন রাজিয়া আক্তার।
সাভারের অধরচন্দ্র স্কুলমাঠে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার। সেখানেই দেখা হয় রাজিয়া আক্তারের সঙ্গে। একাকী বসে ছিলেন। কৌতূহল নিয়েই এগিয়ে গেলাম তার কাছে। পঞ্চাশোর্ধ বয়েসী এক মহিলা।
অবিন্যস্ত চুল, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। হাতে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ নিয়ে বসে ছিলেন মাঠের একপাশে। কারও প্রতীক্ষায়? কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী চাচি, সন্ধ্যার সময় এখানে এভাবে বসে আছেন যে?
: কী করুম বাবা? পোলার লিগা বইয়া রইছি!
: ছেলে কই থেকে আসবে?
: পোলা তো নাই, পোলার লাশ আইবো।
: লাশ আসবে? এখন আর কই থেকে লাশ আসবে? আপনি কি রানা প্লাজার কথা বলছেন?
: হ বাবা, আমার পোলা রানা প্লাজায় কাম করতো। লাশ তো এহনো পাই নাই।
লাশ আইবো।
: প্লাস্টিকের ব্যাগে কী?
রাজিয়া আক্তার ব্যাগ থেকে যতেœ বের করেন একটা ছবি, একটা আইডিকার্ডের ফটোকপি, ডিএনএ টেস্টের সনদ, ভোটার আইডিকার্ডের ফটোকপিসহ আরও কিছু অদরকারি কাগজপত্র। যদি ছেলের লাশ আসে তখন এগুলো দেখাবেন কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু রাজিয়া আক্তারকে কে বুঝাবে, অধরচন্দ্র মাঠে রানা প্লাজা থেকে আর কোনোদিন কোনো লাশ আসবে না।
রাজিয়া আক্তারের ছেলের নাম হাসান।
কাজ করতো রানা প্লাজায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি তার। বেসরকারি তদন্তকারীদের তালিকায় হয়তো হাসানের নাম পাওয়া যাবে একজন নিখোঁজ হিসেবে, কিন্তু সরকারি কোনো দলিল দস্তাবেজে হাসান নামের কেউ নেই। কারণ সরকারের কাছে রানা প্লাজার ঘটনায় নিখোঁজ বলে কেউ নেই। তাই একমাত্র সন্তানের খোঁজ মেলেনি বলে কোনো আর্থিক সাহায্যও জোটেনি রাজিয়া আক্তারের ভাগ্যে।
‘একটাই পোলা আছিলো আমার। ’ বললেন রাজিয়া, ‘সাত মাসের গর্ভে রাইখা ওর বাবা মারা যায়। আমি মাইনষের বাড়িতে ভিক্ষা কইরা আমার পোলারে মানুষ করছি। পোলা গার্মেন্টসে কাম পাইয়া আমারে কইছিলো, তোমার আর মাইনষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়া ভিক্ষা করতে হইবো না। আমিই এহন তোমারে খাওয়ামু।
পোলায় বিয়া করছিলো, দুইডা নাতিও আছে। বউডা ঘটনার পর খালি ফিট হইয়া যাইতো দেইখা হের বাপে হেরে লইয়া গেছে। এহন পর্যন্ত আসে নাই। নাতি দুইডা লইয়া আমি এহন অকূল পাথারে। ’
কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজিয়া আক্তার বলেন, ‘সত্য কথা কই বাবা, আইজ পর্যন্ত এলাকার একজনের কাছ থিকা খালি এক হাজার ট্যাকা পাইছিলাম।
আর কারও কাছ থিকা কিচ্ছু পাই নাই। একটা ট্যাকাও না। কতোজনের কাছে কতো জায়গায় গেছি, কেউ কিচ্ছু দেয় নাই। ঘুরতে ঘুরতে এই দ্যাহেন আমার পরনের কাপড়ডার কী অবস্থা...। ’ বলেই তিনি বোরকার নিচে পরা শতচ্ছিন্ন কাপড়টা দেখান।
‘পোলা তো আর আইবো না, কিন্তু নাতি দুইডারে লইয়া আমি এহন কী করুম? মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা কইরা জীবন চালাইতাছি। বড় নাতিডার বয়স আট। ফুলবাড়ীয়া মাদরাসার হুজুররা হ্যার পড়ালেখার দায়িত্ব নিছে। আরেকটা নাতি লইয়া আমি ভিক্ষা কইরা বাইচা রইছি...। ’
টঙ দোকানের দাম ৫০ হাজার, মানুষের দাম ২০
৫ মে মতিঝিলে হেফাজতের অবরোধের দিন পল্টন এবং বায়তুল মোকাররমের সামনে থাকা পুরনো বই, খেলনা, ফল, চুড়ি-ক্লিপের টঙ দোকান চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীদের আগুনে পুড়ে গেলে দুদিন পরই প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি টঙ দোকানের জন্য দোকানমালিকদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন।
সেই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৬০০ দোকানকে তালিকাভুক্ত করা হয়।
বায়তুল মোকাররম এবং এর আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত টঙ দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানে যে পরিমাণ পণ্যসামগ্রী রয়েছে তার মূল্যমান কোনোভাবেই ৫০ হাজার টাকা হবে না। রাস্তার পাশে কাঠের চৌকিতে বসানো এ দোকানগুলোতে বিক্রি হতো পুরনো বই, বাচ্চাদের ১০-২০ টাকার খেলনা, মেয়েদের চুড়ি, ক্লিপ, ফিতা, মানিব্যাগ ইত্যাদি সস্তাদরের জিনিস। যাদের পণ্য তাদের ক্ষতিপূরণের অর্থের বেশি হবে না।
এ ব্যাপারে আমরা কথা বলি বায়তুল মোকাররমের সামনের পত্রিকা বিক্রেতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের মালিক মো. মিলনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৬০০ দোকানের তালিকা হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৩২০ জনের মতো টঙ দোকান মালিক তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ পেয়ে গেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, হকারদের খেলনা, চুড়ি-ক্লিপ, লেইসফিতার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেখানে তারা ৫০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে সেখানে একজন মানুষের দাম কীভাবে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়? রানা প্লাজার ঘটনার পর প্রতিটি নিহত পরিবারকে লাশের সঙ্গে এই পরিমাণ অর্থই এ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে এবং অধিকাংশ নিহত পরিবার এই ২০ হাজার ছাড়া আর কোনো অর্থসাহায্য পাননি। যেখানে একটি লেইসফিতার হকার তার ১০ হাজার টাকার দোকানের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে ৫০ হাজার টাকা, সেখানে একটি পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন ভয়াবহ ভবনধসে নিহত হলে সরকারের কাছে তার দাম ওঠে ২০ হাজার টাকা। একজন মানুষের দাম কি রাজনীতির বিশ্রী খেলায় এভাবেই অবমূল্যায়ন হবে?
রানা প্লাজার লাশ নিয়ে ত্রাণ ত্রাণ খেলা
সাভার রানা প্লাজার ভবনধসের পর সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিভিন্ন অঙ্কের আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেছে। কিন্তু সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারই সরকারি বা বেসরকারি পর্যায় থেকে ন্যূনতম কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি।
ঘটনার পর আহতব্যক্তি ফ্রি চিকিৎসা পেলেও যাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার বহন করছে না। যারা নিহত হয়েছেন তারা লাশের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে পেলেও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল বা অন্যকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সাহায্য পাননি। সবচে সমস্যায় আছেন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবার। সরকারি হিসাবে নিখোঁজদের কোনো সংখ্যা না থাকলেও এখন পর্যন্ত অনেক স্বজন দাবি করছেন, তারা ভবনধসের পর রানা প্লাজায় কর্মরত তাদের স্বজনদের কোনো খোঁজ পাননি। এমন নিখোঁজ কতোজন রয়েছে সে ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে এর সংখ্যা ১৫০ থেকে ১৭০-এর মতো।
এই ১৫০ থেকে ১৭০ জনের পরিবার কোনো ধরনের কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাননি।
সাভার রানা প্লাজার ভবনধসের ঘটনায় মোট দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ১৫ জন হাসপাতালে মারা যান। আর ধ্বংসস্তূপ থেকে এক হাজার ১২৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ হিসাবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ১৪২।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, বিজিএমইএ একটা ব্যবসায়ী সংগঠন। বিজিএমইর পক্ষে আলাদা কিছু করার নেই। তবে আমরা বিভিন্নভাবে আমাদের ক্রেতা ও মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তিনি জানান, ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা করে রিলিফ ফান্ডে জমা দেয়ার জন্য প্রত্যেক মালিককে বলা হয়েছে। এ ফান্ডে বেশ কিছু টাকা জমা দেয়া হয়েছে।
বিজিএমএ সূত্রে জানা গেছে, এখনও বেশির ভাগ মালিক এ ফান্ডে টাকা দেননি। দুই হাজার ৬০০ জন মালিকের মধ্যে মাত্র এক হাজার ২২৮ জন মালিক টাকা দিয়েছেন। বিভিন্ন ক্রেতা ও মালিকদের কাছ থেকে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৩ কোটি টাকা ফান্ডে জমা পড়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৭৫৬ জনকে বেতন বাবদ ৬ কোটি ৮০ লাখ এবং চিকিৎসা বাবদ দুই কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ৮০ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং ইউনাইটেড গ্রুপ থেকে আড়াই কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
ত্রাণের টাকা পত্রিকায় আছে, নিহতের স্বজনদের হাতে নেই
সাভার রানা প্লাজার ভবন ধসের পর সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নানা অঙ্কের আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেছে। কিন্তু এই আশ্বাস আর সাহায্যের ঘোষণার বাস্তবতা আসলে কতোটুকু?
এ পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ পাওয়া গেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল (১০ জুনের হিসাব)
ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ : ৮০ কোটি টাকা
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক : ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা
ইউনাইটেড গ্রুপ : ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা
বিজিএমইএ : ১৩ কোটি টাকা
এই হিসাবে দেখা যায়, কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল এবং বিজিএমইএর তহবিল মিলিয়ে রানা প্লাজার জন্য সংগৃহীত মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সরকারের হিসাবমতে রানা প্লাজা থেকে আহত-নিহত মিলিয়ে মোট উদ্ধার হওয়া মানুষের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৫৩ জন।
এই ৩ হাজর ৫৫৩ জনকে যদি ১০৬ কোটি টাকা সমান হারে ভাগ করে দেয়া হয়, তবে মাথাপিছু প্রত্যেকের ভাগে পড়ে ৩ লাখ ৫০৬ টাকা করে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে সেই অর্থ আদৌ কি পৌঁছেছে?
আমাদের এই প্রতিবেদনে আমরা একটি তুলনামূলক তালিকা প্রদান করেছি। যেখানে আমরা রানা প্লাজায় নিহতব্যক্তিদের পরিবারের কাছে সরেজমিন কিংবা ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম তারা সরকারি বা বেসরকারি পর্যায় থেকে কতো টাকা অর্থসাহায্য পেয়েছেন। অধিকাংশ পরিবার থেকেই বলা হয়েছে, তারা লাশের সঙ্গে ২০ টাকা ছাড়া আর কোনো অর্থসাহায্য পাননি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ১৭টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খোঁজ নিয়ে মাত্র একটি পরিবার পাওয়া গেছে যারা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২ লাখ টাকার অর্থসাহায্য পেয়েছেন।
বাকি ১৬টি পরিবার যাদের স্বজন নিহত হয়েছেন তারা সরকারি পর্যায় থেকে কেবল লাশের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা, ৪টি পরিবার কওমী গ্রুপ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী ফেসবুক সংগঠন থেকে ৩০ হাজার টাকা, ৩টি পরিবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩ হাজার টাকা পেয়েছে।
আহত ব্যক্তিদের ব্যাপারে দৈনিক প্রথম আলো গত ৯ জুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, এক হাজার ৪৮৬ জন আহত শ্রমিকের মধ্যে এক হাজার ৪১ জন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেয়েছেন। ৭৭৮ জন শ্রমিক পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা অর্থসহায়তা পেয়েছেন। ১৮৮ জন শুধু খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন।
ওষুধ পেয়েছেন ২৩ জন এবং কাপড় পেয়েছেন ১১১ জন।
গত ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী সংসদে জানান, এ পর্যন্ত আহত-নিহত ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে সরকার মোট ৯ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে।
এভাবে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পর্যায়ে নিহত কিংবা আহতব্যক্তিদের আর্থিকভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু সেই সাহায্য আমাদের মাথাপিছু ৩ লাখ ৫০৬ টাকার ধারে কাছেও নেই। তাহলে এই টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায় কিংবা সেগুলো আছে কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের এই টাকাগুলো ডিপোজিট রেখে তার সুদ দিয়ে আহত-নিহতব্যক্তির পরিবারের ভরণ-পোষণের চিন্তাভাবনা কি করছে কর্তৃপক্ষ? সেটাও ভাববার বিষয়।
সরেজমিন ঘুরে সাভারে বসবাসরত কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে রিকশা চালিয়ে, দিনমজুরি দিয়ে, ইট ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। ভিক্ষার থালা হাতে নিয়েছেন, এমন পরিবারের সন্ধানও পাওয়া গেছে। সুতরাং সরকার মহোদয় এই সম্বলহীন পরিবারগুলোকে কেনো এখনও এমন দুর্বিষহ অবস্থায় রেখেছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নাকি এই টাকার ওপরও চড়াও হয়েছে রেলের কালো বিড়াল আর পদ্মা সেতুর প্রেতাত্মারা?
আমাদের এই জরিপ হয়তো সারাদেশের ৩৫৫৩টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পূর্ণ চিত্র প্রকাশ করবে না, তবে সারাদেশের চিত্র এর চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়।
উল্লেখ্য যে, উপরোল্লিখিত হিসাবটিতে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদেত্ত কয়েকটি বড় অর্থসাহায্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়াও ত্রাণ তহবিলে আরও কয়েক কোটি টাকার তহবিল যুক্ত হয়েছে। সেই হিসাব এখানে তুলে ধরা হয়নি। সে হিসাব ধরলে মাথাপিছু ৪ লাখ টাকা করে অর্থসাহায্য প্রতিটি পরিবার পেতে পারে।
ধর্মান্তরের হাত বাড়িয়েছে খ্রিস্টান মিশনারিরা
মানুষের অসহায়ত্বের এই করুণ সময়ে বসে নেই খ্রিস্টান মিশনারিরাও।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ছোট শিশু-সন্তানদের ধর্মান্তরিত করার জন্য তারা নানামুখী কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১২ জুন সাভারের তালবাগে কয়েকটি পরিবারের কাছে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
নার্গিস আক্তার নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিক রানা প্লাজার ঘটনায় নিহত হন। নার্গিসের স্বামী না থাকায় তার ৪ এবং ৭ বছরের দুটি ছেলে তার বোন রিক্তা আক্তারের কাছে থাকে। কয়েকদিন আগে রিক্তার কাছে অজ্ঞাত নাম্বার থেকে একটি ফোন আসে।
ফোনে কেউ একজন বলে, আমরা আপনার বোনের দুটি ছেলের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে চাই। তাদের পড়ালেখা এবং পোষণের সমস্ত খরচ আমরা বহন করবো। তবে একটি ছেলেকে আমাদের দায়িত্বে দিয়ে দিতে হবে। ... এরপর রিক্তা আক্তার তাদের আর কোনো কথা শুনতে চাননি। তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
তারা কে- এটা জিজ্ঞেস করেননি আপনি? এমন প্রশ্ন করলে রিক্তা আক্তার বলেন, তাগো কথা শুইনাই আমি বুঝছি তারা কারা। আমাগো এই এলাকার আরও অনেকের সঙ্গেই তারা যোগাযোগ করছে। অভাবের কথা বইলা তারা নিহত মাইনষের ছোট পোলা-মাইয়া নিয়া যাইতে চায়। তাগো খিরিস্টান বানাইবো। আমরা ওই লোকগো চিনি।
দরকার হয় না খাইয়া থাকুম, তবুও বইনের পোলাগো কারো কাছে তুইলা দিমু না।
আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এই ধরনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। সাভার তালবাগ থেকে নিহত বা আহত কোনো ব্যক্তির সন্তানকে মিশনারিদের হাতে তুলে দেয়ার সংবাদ না পেলেও সারাদেশের চিত্র তুলে আনা সম্ভব হয়নি। তবে খ্রিস্টান মিশনারিরা মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সেবা আর ভরণ-পোষণের কথা বলে যে তাদের ধর্মান্তরের কালোহাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেটা সাভারের এই ঘটনা দিয়েই বুঝা যায়। এই সুযোগে সারাদেশ থেকে এ পর্যন্ত তারা কতো শিশুকে ধর্মান্তরের থাবায় গ্রাস করে নিয়েছে সেই পরিসংখ্যান কেউ জানে না।
তাই তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন বলে মনে করছেন ধর্মবিশেষজ্ঞরা।
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
সৌজন্যে : সাপ্তাহিক লিখনী, সংখ্যা ১৪ জুন ২০১৩
https://www.facebook.com/weeklyLikhoni
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।