মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত। প্রখ্যাত কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ জন্মেছিলেন ১৯০১ সালে। মুন্সিগঞ্জ জেলার কুমারভোগ গ্রামে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিক্রমপুরের স্থান ছিল অনন্য। ব্রিটিশসাম্রাজ্যের পূর্বে মোগল সম্রাটদের বিরুদ্ধ বার ভূঞাদের সংগ্রামের একটা প্রধান কেন্দ্র ছিল এই বিক্রমপুর।
প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যগত কারণে বিক্রমপুরের যুবকদের একটা অংশ সংগ্রামী হয়ে উঠতেন। এখানে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী, যারা দেশে-বিদেশে তাদের ত্যাগ ও বীরত্বে অপূর্ব নিদর্শন রেখেছেন।
মা, বাবা, ভাই-বোনের সাধারণ পরিবারে জিতেন ঘোষ ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। বাল্যকাল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-“রাজনীতিতে তখনও নাম লিখাইনি। কিন্তু মনে মনে এদেশে ইংরেজ রাজত্ব পছন্দ করতাম না।
একটু অপমান ও লজ্জা বোধ করতাম ইংরেজদের অধীনে আছি বলে” (জেল থেকে জেলে-পৃষ্ঠা:-১)। কৈশোরের প্রথম থেকেই তিনি গীতা, চন্ডী পাঠ করে আত্মিকশক্তি ও সংগ্রামী মনোভাবকে উদ্দীপ্ত করে সাধারণ মানুষকে সেবা করার জন্য সেবাশ্রম ও লাইব্রেরী গড়ে তোলেন। এখান থেকে তিনি দেশপ্রেমের ভাবধারাকে সহপাঠী তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাকে বিপ্লবীদের একজন মনে করে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন আটক রেখে মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়।
আগুনে ঘৃতাহুতির মতো, একারণে জিতেন ঘোষের মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বলে উঠে।
প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করার পর তাকে কাজিরপাগলা অভয়কুমার তালুকদার হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। স্কুলে পড়াশুনাকালীন সময়ে তিনি বিপ্লববাদী দল যুগান্তরের সাথে যুক্ত হন। বিক্রমপুরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদেরকে নিয়ে বিপ্লবী গ্রুপ গঠন করেন। ১৯১৭ সালে এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তারপর আই.এ. ভর্তি হন। এসময়েও তিনি বিপ্লবী দলে কলেজ ছাত্রদের টেনে আনার কাজে যুক্ত থাকেন। ১৯১৯ সালে আইএ পাশ করার পর ১৯২০ সালে বিএ ভর্তি হন। ১৯২১ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে কলেজ ত্যাগ করে ওই আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হন এবং স্কুল-কলেজের শত শত ছাত্রকে এই অসহযোগ আন্দোলনে শামিল করেন। এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ব্রিটিশ তাকে গ্রেফতার করে দেড় বছর সশ্রম কারাদন্ড দিয়ে ঢাকা জেলহাজতে পাঠায়।
তখন জেলখানাগুলোতে দেশপ্রেমিক কয়েদীদের উপর ব্রিটিশ সীমাহী নির্যাতন চালাত। কয়েদীদের ঘানি টানানো হতো। দুর্গন্ধযুক্ত, পাথর মিশানো ভাত, জঙ্গলের তরিতরকারী ও ছোবলাসহ ডাল ছিল কয়েদীদের খাবার। আর কথায় কথায় দৈহিক নির্যাতন তো রয়েছেই। কিন্তু এর কোনোকিছুই জিতেন ঘোষকে দুর্বল করতে পারেনি।
তিনি ইংরেজ জেলের নিয়ম-কানুন পরোয়া করতেন না। এজন্য তাঁকে বহুবার বেদমভাবে মারধর করা হয়েছে। তবু তাঁর একই কথা তিনি ইংরেজ জেলের নিয়ম-কানুন মানেন না। একদিন তাঁকে ঘানি টানার জন্য নেয়া হল। তিনি প্রথম থেকেই একাজ করতে অস্বীকৃতি জানান।
জেলের কর্মকর্তা তাকে প্রচন্ডভাবে মারধর শুরু করেন। জিতেন ঘোষও হাতের কাছে যা পান তা দিয়ে মার প্রতিরোধ শুরু করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ পাগলাঘন্টি বাজালো। ততক্ষণাৎ লাঠী, বন্দুকধারী সিপাহীরা এসে প্রচন্ডভাবে মরতে শুরু করে। তাঁর নিজের বিবরণ থেকে বুঝা যাবে মারের রূপ কি ছিল।
“—চলল মার। উঃ কি দারুণ সে মার’। “আমার গা দিয়ে রক্ত বেরুল। নাক দিয়ে রক্ত ছুটল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম।
অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে নিয়ে ডিক্রীতে বন্ধ করে দেওয়া হল। আমি মেঝেতেই পড়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে জেগে দেখি পানির কলসিটাও নেই। সরানো হয়ে গেছে। একটু পানিও খেতে পেলাম না।
ডাক্তার আসাতো দুরের কথা, একফোটা ঔষধও পেলাম না। পানির অভাবে নাক-মুখের রক্তও ধোয়া গেল না। কম্বলটা বেশ করে বিছিয়ে শুয়ে পরলাম” (জেল থেকে জেলে-পৃষ্ঠা:-১৩)।
এত অত্যাচারের পরও তিনি জেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানলেন না। এর ফলে সদাসন্ত্রস্ত কয়েদীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেন এক অসাধারণ মানুষ এবং দুর্ধর্ষ কয়েদীরা এসে তাকে সেলাম দিতে শুরু করে।
কারাঘারা একজন কয়েদীর এ ধরণের প্রতিবাদ, দ্রোহ দেখে সবাই একটু একটু প্রতিবাদী হয়ে উঠতে শুরু করেন। এই বৈশিষ্ট না থাকলে বন্দীদের জেল জীবনের সম্মান রক্ষার লড়াই করা সম্ভব হতো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।