রহস্যময় গ্যালাক্সি ঘুরে, অসীম আকাশে উড়ে আর সাগরের অতল গভীরে ডুবে আমৃত্যু পান করতে চাই ভালোবাসার অমৃত সুধা...
রহীম একটা চানাচুরের প্যাকেট কেনার জন্য বাসার কাছের মফস্বলের দোকানে গেল। তমালদের বাসায় অনেকদিন ধরে কাজ করছে এই রহীম। এই বাসার সবার সাথে এমন সম্পর্ক হয়ে গেছে যে রহীম ভুলেই বসেছে- অজো পাড়াগাঁয়ে তাদের একটা কুঁড়ে ঘর সহ ভিটা মাটি যৎ সামান্য এখনো আছে। অনেক আগেই বাবা ঢাকায় রিক্সা চালাতে যেয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা পড়েছেন। মা, বাবার শোকে না খেয়ে না দেয়ে অসুখে মারা গেছেন।
ছোট্ট এই রহীমের ভরসা তখন তমালদের মফস্বলের বাসা। বাসায় কিছু অতিথি আসায় চানাচুরের প্রয়োজনে দোকানে তা কিনতে যাওয়া। এখানেই ঘটনার শুরু। দোকানী অনুরোধ করলো- বাবা, একটু থাকো না দোকানে। আমার একটু কাজ আছে।
আমি এক্ষুণি আসছি। রহীম- কাকা আমার জলদি যেতে হবে। বাসায় অতিথি এসেছে। ততক্ষণে বেশ দূরে চলে গেছে দোকানী। দূর থেকে ডাক দিয়ে বলল- থাকো না একটু, এক্ষুণি আসছি।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। না, আসলো না দোকানী। এদিকে তমালদের খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে রহীমকে। হায় হায় কখনো তো এতো দেরি করে না রহীম। সময়টা খুব খারাপ।
গ্রাম, মফস্বল, শহর কোন কিছুই আর নিরাপদ নয় এখন। এই তো সেদিন জব্বর কাকার এক কাজের ছেলে হঠাৎই লাপাত্তা। অনেক খোঁজ করা হলো। পুলিশ দিয়েও তল্লাশী করা হলো কোন হদিস মিলল না। না আর পাওয়াই গেল না ছেলেটাকে।
গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেল শহুরে আন্ডারগ্রাউন্ড চালান চক্রের মতো করে। শোনা যায় এখন নাকি এক বড্ড শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেশের বিভিন্ন চোরাই পথে ছোট ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন প্রলোভনে ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। হতে পারে এমনই কোন ফাঁদে ছেলেটি পাচার হয়ে গেছে হয়তো। তমাল প্রায়ই মোবাইলে তোলা সেই ছেলেটির ছবি দেখে আর আঁৎকে ওঠে। ভাবে, মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে।
রহীমের এই অবস্থা হলো না তো? ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়েছে।
আশে পাশের যত দোকান-পাট আছে সবস্থানে খোঁজা হলো। রহীমকে পাওয়া গেল এক দোকানীর ভূমিকায়। দিব্যি দোকানের পণ্য বিক্রি করছে। আর তা লিখে রাখছে কাগজে।
-কি ব্যাপার তুই? এখানে? এতোক্ষণ? আর এই দোকানেই বা কেন? দোকানদার কোথায়? কি করছিস? দোকানের পণ্যও বিক্রি করছিস? তোর সাহস তো কম না? কথাগুলো এক নি:শ্বাসে বলল তমালের এক বন্ধু। ঘটনা খুলে বলল রহীম। কি করা যায়? আপাতত রহীমইএই দোকানটি চালাতে শুরু করল আর অপেক্ষা করতে থাকলো কখন দোকানের মালিক আসেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে গেল। আঠারোতে পা দিল রহীম।
একটি দু’টি করে পনের বছর পেরিয়ে গেল। ইতোমধ্যে দোকানের পরিধি বেড়েছে। পণ্যের পসারও বেড়েছে। রহীমের দোকান নামে এখন সবাই একনামে চেনে। বেশ কয়েকজন সহকারীও কাজ করে দোকানে।
প্রচুর কেনাবেচা হয়, ক্রেতার সংখ্যাও বেড়েছে। সময়ের আবর্তনে রহীমের বয়স হলো তেত্রিশ আর এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন পঁয়তাল্লিশোর্ধ শশ্রুমন্ডিত এক লোক এসে সফট্ড্রিংক্স চাইলো রহীমের কাছে। দাম দিতে দিতে দোকানের কাছে পাতা বেঞ্চে বসে লোকটি একটি তথ্য জানতে চাইলো- বাবা, প্রায় পনের বছর আগে এখানে আনোয়ার ব্রাদার্স নামে একটা মনিহারী দোকান ছিল। দোকানটি সম্পর্কে কিছু জানো? আমার বাড়ি টাঙ্গাইলে, ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত মফস্বলেরএই জায়গাটি তখনও এতো উন্নত হয়নি। এক বন্ধুর হাত ধরে ব্যবসা শুরু করি।
বিভিন্ন কিছু করার পর একটা দোকান দেই কিন্তু আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী’র সন্ধান পেয়ে আমি কাল বিলম্ব না করে পা বাড়াই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসার কথা ছিল দোকানে কিন্তু আমার জন্য যে আরও ভয়ানক কিছু অপক্ষো করছিল তা আমি জানতাম না। তাই একজন ক্রেতাকে দোকানে বসিয়ে রেখে আমি যে অন্যের শিকার হয়ে পাচার হয়ে গেলাম, তা বুঝতে পারলাম যখন ততক্ষণে আমার এদেশে ফিরে আসা সম্ভাবনা শেষ হয়েছে। আমাকে একটি কারাগারে থাকতে হয়েছে প্রায় দশ বছর। কারাগার থেকে বেরিয়ে ঢাকায় এসে একটা ব্যবসা শুরু করি, কপাল ভালো, হু হু করে ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকলো।
দশ বছরে যা আমি পারতাম না তা পারলাম মাত্র পাঁচ বছরে। ব্যবসার কাজেই ফরিদপুরে আসলাম, ভাবলাম এখানে একটু খোঁজ নিয়ে যাই, যদি পনের বছর আগের আমার দোকানটার কোন খোঁজ পাওয়া যায়? কিন্তু এতো পরিবর্তন এই পনের বছরে যে আমি আর কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। তবে যতটুকু মনে পড়ছে এখানটাতেই সম্ভবত আমার মণিহারী দোকানটা ছিল।
রহীম সিনেমাতে এই রকম গল্পের গাঁথুনি দেখেছে। ছোটবেলায় এক পাঠ্যবইয়েও এমন গল্প পড়েছে কিন্তু বাস্তবে এমন হবে তা কখনো সে ভাবেনি।
রহীম ভালো করে লোকটিকে দেখলো। চেনা চেনা লাগছে। পনের বছর আগের কথা। দাড়ি গোঁফ মুখাকৃতিতে বয়সজনিত পরিবর্তন স্পষ্ট। ফটোশপের প্যালেট থেকে দাড়ি আর গোঁফগুলো মার্ক করার পর ড্রপার দিয়ে মুখের রঙ কপি করে বসালে, আর কার্ভ দিয়ে ব্রাইটনেসটা বাড়ালে এই সেই আনোয়ার কাকা যার কাছে পনের বছর আগে এক প্যাকেট চানাচুর কিনতে এসেছিল রহীম।
পনের বছর ধরে দোকনের পণ্য বিক্রি করা, দোকানের পরিধি বাড়ানো, কর্মচারি নিয়োগ, ব্যবসার প্রসার সবকিছুই করেছে স্বচ্ছতার সাথে। পনের বছর আগের সব হিসেব নিকেশ এখনো সাজানো আছে দোকানের ভেতরের তাকে। -আনোয়ার কাকা, আপনি সেই দোকানী? আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি রহীম, আমার কাছেই আপনি দোকানটা রেখে গিয়েছিলেন। আর এই তো আপনার দোকান। আপনি সবকিছু বুঝে নিতে পারেন আমার কাছ থেকে।
আপনার সবকিছুর হিসাব আমি যতœকরে রেখেছি এতগুলো বছর ধরে। রহীমের এই আচরণ আনোয়ারের মন কেড়ে নিল, বলল- বাবা তোমার আচরণে আর সততায় আমি মুগ্ধ। এমন একটি পবিত্র পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো তা কখনো ভাবিনি। এই ব্যবসা আজ থেকে তোমার। তুমি আরো বড় হও এই ব্যবসা করে।
আমি আজই সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো।
বিশ্বাস আর আমানত রক্ষা করা মানুষের অনেকগুলো গুণের মধ্যে একটা বড় গুণ। এই বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই হওয়া যায় অনেকের চেয়ে অনন্য। অনন্য এই মানুষটিই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অন্যের উপমা। ময়মনসিংহের গাঙ্গিনার পাড়, ব্যস্ত আর সংকোচিত এই জায়গাটুকুর গুরুত্ব যথেষ্ট।
স্থানটুকুর পরিসর খুবই নগণ্য। কিন্তু মানুষের পর্যাপ্ততা প্রচুর। এমনই এক স্থানে গড়ে উঠেছে এক ছোট্ট ব্যবসাকেন্দ্র। কোন বড় বা খান্দান পণ্যের ব্যবসা নয়। শুধু তথ্য বিক্রি আর ফটোকপি করাই যে ব্যবসার মূল চালিকা।
স্থানীয় ভাষায় অমন চিপা একটা জায়গায় তিল ধারণের যেন ঠাঁই নেই। কেউ কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, কারেন্ট ওয়ার্ল্ড কিনছেন, কেউ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি গাইডের অর্ডার দিচ্ছেন, কেউ স্ট্যাপল করা একগাদা চাকরীর বিজ্ঞাপনে চোখ রাখছেন। পছন্দসই চাকরীর বিজ্ঞাপনটি ফটোকপি করে নিচ্ছেন। এছাড়া কুরিয়ারও করছেন কেউ। সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা।
সংকীর্ণ ঐ দোকানটিতে ক্রেতাদেরকে বসার জায়গা দেয়া সম্ভব ছিল না কিন্তু কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে যেভাবে প্রয়োজনীয় পণ্যাদি ক্রয় করছেন তাতে করে সেই ব্যবসাটি কেমন চলছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মালিক সহ দোকানের তিনজন কর্মী সারাদিন সেবা আর পণ্য বিক্রয় করে যেতেন ধৈর্য ধরে। তমাল অনেকবার এই দোকনে গেছেন কুরিয়ার আর চাকরীর বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে। তারপর প্রায় প্রতি বিকেল বা সন্ধ্যায় যেন ঐ দোকানটায় না গেলে ভালই লাগতো না। কতজন যে চাকরীর বিজ্ঞাপন পড়ার জন্য ওখানে যেতেন আর নতুন নতুন চাকরী পেয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়েছেন তা কিভাবে বোঝাবো।
দোকানটির তিনজন কর্মীর সহযোগিতামূলক আচরণ সবাইকে মুগ্ধ করতো। এমনও হতো এক টাকার একটা ফটোকপির জন্য অনেকক্ষণ ধরে সময় নিয়েও বিগত সপ্তাহের চাকরীর বিজ্ঞাপন বের করে দিতেন দোকানের মালিক নিজে। দোকান মালিকের এমন আচরণ আর ধৈর্য ধরে ক্রেতার কথা শোনার কারণে তাৎক্ষণিক সময় খরচ হলেও এইটুকুই ছিল তার পরবর্তী সময়ের বিনিয়োগ। এর ফলে তার দোকানে ক্রেতার সংখ্যা এমন ভাবে বেড়ে গেল যে- এক কথায় যে কোন প্রয়োজনেই হোক না কেন চাকরীপ্রার্থী, ছাত্র-ছাত্রীরা তার দোকেনই ভীড় করতো আর সবার কাছে তার কথাই বলত। একদিন এমনও এক লোককে দেখা গেল যে, প্রাসঙ্গিক নয় এমন দরকারেও দোকানীর কাছে এসেছেন পরামর্শ নিতে।
বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী এই কথাটি বুঝতে চাইলে দরকার ক্রেতার মন বোঝার দক্ষতা আর ধৈর্য। অস্থির আর অধৈর্য হয়ে কখনোই ব্যবসার লক্ষ্মীকে ধরা যায় না।
প্রচন্ড ভীড়। বাসার কাছের এক স্টোর। অফিস সেরে মোটামুটি সাশ্রয়ে এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকেই প্রয়োজনীয় পণ্যাদি ক্রয় করে তমাল।
প্রায়ই এই স্টোরের সামনে ভীড় দেখে মেজাজটা গরমই হয়ে ওঠে, আবার হিংসেও হয়, কত জনপ্রিয় এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি। আবার শিখতেও ইচ্ছে করে ব্যবসা এখান থেকে। সৎ আর সঠিক পরিকল্পনায় একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কত দ্রুত মানুষের কাছে, ক্রেতার কাছে জনপ্রিয় হয় তা এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আসা ক্রেতাদের আনাগোনা আর ক্রয়ের পরিধি দেখলেই বোঝা যায় সহজে। দুইভাই মিলে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন। অত্র এলাকায় একনামে পরিচিত এই স্টোরটি।
অতিরিক্ত ভীড়ের কারণে তমাল প্রায়ই রাগ করে পাশের দোকান থেকে পণ্য কেনেন। কিন্তু যত পরিমান টাকারই পণ্য কেনা হোক না কেন এই পাশের দোকানের দোকানীরা একটি টাকাও ছাড় দেন না কখনো। পণ্যের গায়ে বা লেভেলে যে দাম লেখা থাকে তাই কড়ায় গন্ডায় হিসেব কষে বুঝে নেন দোকানী। একবার ভাবুন তো যে আশেপাশের প্রত্যেকটি একই রকম দোকানে যেয়ে যখন দেখা যায় যে, প্রত্যাশিত পণ্যটির দাম গায়ে লেখা লেভেল অনুযায়ীই রাখা হচ্ছে অথচ কোন একটি দোকানে ন্যূনতম এক টাকা কম পেলেন, তখন এক টাকা হয়তো খুব বেশি পরিমান ছাড় নয় তারপরও কি আমরা এই একটা টাকা কমে দেয়া দোকানে আবার পণ্য কেনার জন্য উৎসাহিত হবো না? কিচ্ছু না, কেবল মাত্র একটি ছোট্ট ছাড়ের জন্যই একজন দু’জন করে অনেক ক্রেতার সমাগম ঘটে সেই দোকানে। আর এক সময় উপচে পড়ে ক্রেতার উপস্থিতি।
জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি আর ঘটনায় তমাল সংগ্রহ করে অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা কোন বই থেকে কখনো অর্জন করা যায় না। বাস্তবতা থেকেই অর্জন করতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে আর চলতে চলতেই অর্জিত হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রকৃত শিখন। পাশাপাশি একই রকমের বেশ কয়েকটি দোকানে গিয়ে কোন ক্রেতা যদি বলেন- ভাই টাইগার এনার্জি ড্রিংক্স আছে? ধরা যাক, মোট পাঁচটি দোকান সেখানে আছে। সফট্ ড্রিংক্স, চানাচুর, বিস্কিট, কেক, বার্গার, স্যান্ডউইচ ইত্যাদি বিক্রি হয় সেখানে।
প্রথম দোকানে তমাল জিজ্ঞেস করলে জবাব এলো একবাক্যে- নাই। দ্বিতীয় দোকানে একই পণ্য চাওয়ার পর জবাব এলো- এটা এখন চলে না। তৃতীয় দোকানের দোকানী মোবাইলে কথা বলছিলেন, জবাবে ইশারা করে জানালেন- নাই। চতুর্থ দোকানের দোকানদার অন্য আরেকজন ক্রেতার পণ্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তমাল টাইগার ড্রিংক্স চাইলে সেদিকে খেয়ালই করলেন না এবং এমন ভাব করলেন যে, একটা পঁচিশ টাকা দামের টাইগার কিনতে এসেছো তোমাকে এতো গুরুত্ব দেবার কি আছে? এবার তমাল পঞ্চম দোকানে গেলে সেখানে দোকানীকে বেশ ব্যস্তই মনে হলো। কারণ বেশ কয়েকজন ক্রেতাকে পণ্য বুঝিয়ে দেবার কাজটি করছিল সে।
কিন্তু খুব ধৈর্যশীল আর বিনয়ী মনে হলো। মোটামুটি সব ক্রেতাকে গুরুত্ব দেবার একটা মানসিকতা দেখা গেল সেই দোকানীর। আর তাই একটু দেরি হলেও ক্রেতাগণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তার পণ্যটি কেনার জন্য। অথচ পাশেই আরও একই রকমের দোকান আছে। সেখানে যাচ্ছেন না কেউই।
এ এক আশ্চর্য মোহময়তা। ক্রেতা পাশের দোকানে একই পণ্য পাবে নিশ্চিত হয়েও এই দোকানেই ভীড় করে অপেক্ষায় থাকছেন। তমাল সামনে দাঁড়াতেই পজেটিভ অ্যাটিচিউডে মৃদু হেসে ঘর্মাক্ত আর সামান্য ক্লান্ত হয়েও বললেন- ভাই কিছু লাগবে আপনার? পণ্য চাওয়ার আগেই ক্রেতাকে গুরুত্ব দেবার প্রাথমিক পজিটিভ টোপ। -হ্যাঁ লাগবে, টাইগার এনার্জি ড্রিংক্স। -একটু দাঁড়ান প্লিজ! দিচ্ছি।
খুঁজলেন, পেলেন না। বললেন- ভাই টাইগার যে নেই! অন্য কিছু চলবে কি? স্ট্রিং, স্পীড, ব্ল্যাকহর্স আছে, এগুলোও একই মানের। মন্দ হবে না, ভালোই লাগবে। তমাল ভাবলো সামনে গেলে আরও কয়েকটা দোকান আছে যেখানে প্রত্যাশিত ড্রিংক্সটি হয়তো পাওয়া গেলে যেতেও পারে। কিন্তু এই দোকানীর ব্যবহার আর পণ্য বিক্রির বিকল্প কৌশল বেশ পছন্দ হলো।
-দ্যান, তাহলে ব্ল্যাকহর্সই দ্যান। একজন দোকানীকে এই কৌশলটি কোন প্রশিক্ষণেই হয়তো শেখানো হয়নি। অথচ কি দারুণ ভাবে বিক্রি করতে সক্ষম হলেন ক্রেতার পছন্দের বাইরের পণ্যটি। ড্রিংক্সটি খুলে মুখে দিতে দিতে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন তমাল। ভাবলেন এই দোকনের সামনে এতো ক্রেতার সমাগম তাহলে এরই জন্যই।
স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ডানে তাকালো তমাল, পাশের সিটে বসে থাকা অহনা বললো- ধ্যাত্ কোথায় যে নিয়ে এলে আমায়? মিনারেল ওয়াটার পাওয়া যায় না এখানে? তমাল হেসে বলল- মিনারেল ওয়াটার আছে ঠিকই কিন্তু সেই রকম সফল ব্যবসায়ীর নাগলে পড়নি নিশ্চয়ই। -আরে নাহ্, ফ্রেশ, মাম ওগুলো তো আমি নেই না। -কিন্তু এই ব্ল্যাকহর্স আমি ঠিকই নিয়েছি তমাল বলল। -তোমার সাথেই বুঝি এইসব ব্যবসায়ীর দেখা হয়? না হলে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ট্যুরে আসার সময় বামপাশে স্টিয়ারিং লাগানো গাড়ি তোমার জন্য জাহাজে করে পাঠায়?
স্টার্ট স্মল, ড্রিম লার্জ। এই কথাটি মনে রেখেই এগিয়ে যায় সব সফল ব্যবসায়ীগণ।
এমবিএ করার সময় বাংলাদেশের বিখ্যাত সব শিক্ষকের কথাগুলো খুব বেশি মনে পড়ে। কাঁধে হাত রেখে প্রায়ই বলতেন এ আর খান স্যার, মুজাহিদ স্যার, কোরবান আলী স্যার, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ স্যার; তমাল, ব্যবসা প্রশাসন শিখবে? ব্যবসা? তার আগে যাও ঐ কাসেম ড্রাইসেলস্ কোম্পানীর কাসেম, সঙ্গীতার সেলিম খান, বিশ্বখ্যাত টাটা কোম্পানীর রতন টাটা, ইউনিলিভার, সনি কর্পোরেশন, ন্যাশনাল কোম্পানী, ওয়ালটন বাংলাদেশ, প্রাণগ্রুপ কার কথাই বা আর বাদ রাখি, এদের আদি ইতিহাসে। ইউনিভার্সিটির ফুটপাতে চা আর টোস্ট বিস্কিট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানীর কাছে যাও, দেখো ব্যবসা কাকে বলে? শেখো। সকালে কত টাকার পণ্য কেনে আর দিন শেষে কত টাকা হাতে আসে, মাসে কত টাকা বেঁচে যায়? বড় প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশীপ করার আগে এই ছোট ছোট মোবাইল দোকানগুলোর উপর থিসিস্ করো। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের বিপরীতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে নাটকের রিহার্সেলের পর এই জায়গাটায় এসে সবাই মিলে চা পান করতো তমাল সহ অন্য বন্ধুরা।
এই চায়ের গুরুত্ব বেড়েছে শুধুমাত্র গরুর দুধের চা বানানো আর খুব যতœ করে চা তৈরীর জন্য। রসিক কারিগরও বেশ রসিকতা করে চা বানিয়ে খাওয়াতেন আর ক্রেতাকে কিভাবে স্থায়ী ক্রেতা করে নেয়া যায় সেই আচরণ আর কৌশল উপহার দিতেন। ক্রেতা আর যায় কোথায়, একদম প্রায় স্থায়ী ক্রেতা হয়ে উঠলো তমালের পুরো নাট্যদলটি।
সঠিক ও যথাযথ হিসাব সংরক্ষণের পদ্ধতির অভাবেও ব্যবসার প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না প্রায়ই। ব্যবসার প্রকারভেদ বুঝে এক ও অভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবসা না করলে এই ব্যবসার গতিপথ অচেনা হতে পারে।
স্থানীয় পদ্ধতিতে বা রীতি অনুসরণ করে যে সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যবসা প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়, তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দুষ্কর হয় এবং ব্যবসার পরিধি বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিতেও এর প্রকৃত চিত্রটি লুকানো থাকে, যেন স্বপ্নে দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবার মতো। যে দৌড়ে কখনো জিৎ আসে না। এগোনো যায় না কখনো। হাঁপাতে হাঁপাতে পরাজয় মেনে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠতে হয়। জালাল, রিক্সাওয়ালা।
গ্রামে অধিকাংশ সময়ে সে রিক্সাই চালায়। কখনো কখনো হয়তো নিজের প্রয়োজনে বদলা কামলা দেয় কিন্তু পেশা তার সারা বছর ধরে ঐ রিক্সা চালানোই। হঠাৎ একদিন কোন এক কাজে তমাল ঐ রিক্সায় করে কোথাও যাচ্ছিল। পথটা দূরের হওয়ায় কথায় কথায় রিক্সা চলতে থাকে। গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে সবুজ দেখা আর রিক্সাওয়ালার সাথেই জমিয়ে কথা লেনাদেনা করাটা মন্দ লাগছিল না।
চব্বিশ বছর ধরে রিক্সা চালাচ্ছেন জালাল। রিক্সা চালানোর অভিজ্ঞতা অনেক বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এতোগুলো বছর ধরে রিক্সা চালিয়ে তার কি অর্জন হয়েছে জানতে চাইলে বললেন- কিছ্ইু নেই বাজান, শুধু দিন চইল্যা যাইতাছে। মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে, ভবিষ্যতকে দেখে নিজের পরিকল্পনার সাথে সাযুজ্য করে। মানুষ ছোট থেকে বড় হয় ধনে, সম্পদে, মানে।
কিন্তু জালাল কি পেলেন? জবাবে কিছুক্ষণ নিরুত্তর জালাল, তারপর- কি আর করবো? চলছে যে এটাই তো বেশি। তাহলে অভিজ্ঞতা দিয়ে কি হলো? রিক্সার প্যাডেল কতবার ঘোরালে রাস্তার মোড় সহজে ঘোরা যায় বা দূর্ঘটনা কমানো যায় বা যাত্রীকে সাবধানে বহন করা যায়, শুধু কি এই অভিজ্ঞতাগুলোই হলো? লাভ কি হলো? মানুষ নিশ্চয়ই তার অবস্থানের উন্নয়ন মূলক পরিবর্তন চায়। সেই পরিবর্তনের জন্য খুব দরকার সঠিক এবং যথাযথ হিসাবের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া। নিশ্চয়ই এই জালালের উন্নয়ন হতে পারতো এমন ভাবে যে, সে দু’বছর পর ছনের ঘরটাকে টিনের চৌচালায় রূপান্তর করেছে আরও দু’বছর পর কিছু জমি কিনেছে, আরও কিছু বছর পর মফস্বলে একটা দোকান দিয়েছে; একটা থেকে কয়েকটা ব্যবসা শুরু করেছে অথবা রিক্সা থেকে টেম্পো, টেম্পো থেকে ট্যাক্সি, ট্যাক্সি থেকে গাড়ি, গাড়ি থেকে বড় বাসের ড্রাইভার হওয়া অথবা গাড়ি ভাড়া দেবার মহাজন এইভাবেই উন্নয়নের গতি এগোতে পারতো। না, তা হয়নি।
¯্রােতের প্রতিকূলে দাঁড় বাইতে গিয়ে যথাস্থানে সারাক্ষণ ধরে বসে থাকার মতো অবস্থা থেকেছে তার। বিজ্ঞানের ভাষায় এতে কোন কাজই সম্পন্ন হয়নি। পন্ডশ্রম হয়েছে। কাজ হতে হলে সময় আবর্তনের পাশাপাশি গতি ও স্থান পরিবর্তন জরুরী। তবেই কাজ হয়েছে বলে বোঝা যেত।
অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো এই রিক্সাওয়ালার মতো। সঠিক পরিকল্পনা, সময়ের চাহিদা, ক্রেতা ভাক্তার ভোগ পরিবর্তন আর যথাযথ সেবা নিশ্চিত করে উন্নত পণ্যটি না সরবরাহ করলে ব্যবসার অবস্থা গতিহীন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালি কণা, বিন্দু বিন্দু জল; গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল এই বোধের উপর যাদের বিশ্বাস নেই তারা হঠাৎ করেই কারিশম্যাটিক বিজনেস-এ বিশ্বাসী হয় আর তমালের এক গানের ছাত্রীর বাবার মতো বলে- ভাইরে সারা বছর ব্যবসা করে কি লাভ? বছরে তিনমাস সিলেটে যাই। সিস্টেম করি, টাকা বানাই আর বাকি নয় মাস বসে খাই, বোয়াল ধরে বিনিয়োগ করি।
তমালের অনেক বন্ধু বান্ধব যারা চাইলেই বড় বড় চাকরীতে যোগ দিতে পারতো।
কিন্তু তা করেনি। একটা কথাই তাদের ভেতরে গ্রথিত ছিল যে- আমি উদ্যোক্তা হবো। চাকরী করলে হয়তো নিজের জীবিকাটি নিশ্চিত হবে অথচ একটা কিছু নিজে উদ্যোগী হয়ে করলে তাতে নিজে সহ আরো কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে। একদিন তমাল বন্ধু সায়েমের অফিসে গেলো। মনে পড়ছে, সায়েম সবে মাস্টার্স শেষ করেছে।
চাকরী খোঁজার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তমাল, পড়াশোনার বিশাল সমুদ্র পার হয়ে আরেক সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে বইপত্র, গাইড পড়তে পড়তে কাতর; সায়েম তখন দিব্যি শহরে একটা দোকান ভাড়া করে কম্পিউটার কম্পোজ, প্রিন্টিং আর গ্রাফিক্সের কাজ দিয়ে শুরু করলো কর্মসংস্থানের যাত্রা। এতোদিন পরে এসে সেই সায়েমের অফিস দেখে চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড়। খুব ভালো লাগছিল, এই তো সেদিনের কথা, তমাল এখনো মাসোহারা চাকুরে আর সায়েমের অফিসে তমালের মতো পঞ্চাশ জন মেধাবী চাকরী করছে। এখন আর সেই সেদিনের ছোট্ট কম্পিউটারের দোকান নেই, এখন সেটা কম্পিউটার সায়েন্স ইনস্টিটিউট, কত রকমের সার্ভিস দেয়া আর সফট্ওয়্যার বানিয়ে তা বিক্রি করা হচ্ছে। অনার্স পড়াকালীন তমাল তার এক বন্ধুর সাথে টিউশনী করা ছাত্রীর বাসায় গিয়েছিল।
ছাত্রীটি অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করবে তাই তমাল গানের কিছু জায়গা ঠিক করে দিচ্ছিল কখনো গেয়ে, কখনো তবলা আর হারমোনিয়াম বাজিয়ে। সেই যে প্রচার হলো। বন্ধুর মাধ্যমে অনুরোধ আসা শুরু করলো যে তমাল গান শেখাবে কি না? তমাল পড়াশোনায় এমন ব্যস্ত সময় পার করতো যে মাঝে মাঝে স্টেইজ প্রোগ্রাম ছাড়া অন্যভাবে সময় দেয়া ছিল খুব দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু বন্ধুর অনুরোধ আর ঐ ছাত্রীর অভিভাবকের অনুনয়ে বাধ্য হলো গানের টিউশনি করতে। তারপর এই ছাত্রী থেকে ওই ছাত্রী, এই স্কুল থেকে ওই স্কুল, এই ইনস্টিটিউট থেকে ওই ইনস্টিটিউট কত জায়গা থেকে যে ডিমান্ড আর অনুরোধ আসতে শুরু করলো।
এতো এতো জায়গায় একজন তমালের পক্ষে সময় দেয়া নিশ্চয়ই অসম্ভব ছিল। তাই তাদেরই অনুরোধে তাদেরই দেয়া জায়গা, ফেøার, কার্পেট, সঙ্গীত যন্ত্রাদি, ব্যানার, ইউটিলিটি সবুকছু দিয়ে শুরু হলো সুরতান সঙ্গীত অ্যাকাডেমি। দুইমাসের মধ্যেই শত শত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে গেলো। এবার তমালের ওস্তাদের কাছে যারা গান শিখতো তারা পর্যন্ত ছুটে আসতে শুরু করলো। ব্যাপারটা দারুণ আকার ধারণ করলো।
বোঝা গেল মান, আন্তরিকতা আর সেবা ঠিক থাকলে যে কোন ব্যবসার ভবিষ্যৎ ভালই হয়, এতে কোন সন্দেহ নেই।
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, মহান আল্লাহ’র দোস্ত মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা ব্যবসা করতেন। এছাড়া পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারা’র ২৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- আহাল্লাল্লাহুল বাইয়া অ হাররামার রিবা অর্থাৎ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। সুতরাং ব্যবসা এমন একটা কর্মপন্থা যা যথাযথভাবে ন্যায়সঙ্গত উপায়ে চালনা করে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভূত উন্নয়নে অংশীদার হলে এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসবেই।
নহো নিমিত্তে নিজও/অবৈধ অস্তিত্ত্বে অবগাহন/মুক্ত হও, বদ্ধ রহো মানিতে নীতি/সরাও জরা, মুক্ত করো অর্থ/জাগাও পৃথ্বি, রাখো দূরে অবৈধ বৈভব।
-এস জে রতন
***
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।