রহস্যময় গ্যালাক্সি ঘুরে, অসীম আকাশে উড়ে আর সাগরের অতল গভীরে ডুবে আমৃত্যু পান করতে চাই ভালোবাসার অমৃত সুধা... সারাদিন টেনশন/ ঘরেতে টেলিভিশন/ হাজার চ্যানেল করে হা/ বাজারেতে দামাগুন/ গিন্নি তেলে বেগুন/ জ্যামে জটে ঘামে ভেজা গা/ জীবনের নানা বায়না... কেয়ার অব ফুটপাত নচিকেতার এই গানের মতো করেই জীবন চলছে আমাদের। ফুটপাত যদিও ফুটের তলায় মাটি নেই অবস্থায় থাকা মানুষগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা তারপরও কারো কারো ক্ষেত্রে এই ফুটপাতেই হয়েছে জীবনের বড় উত্থান। ফুটপাতে পত্রিকা আর বাদাম বিক্রি করেও কেউ কেউ সুপরিচিত দেশের বা ভূখন্ডের শাসনকর্তা হয়েছেন। যে কোন আন্দোলনের সময় গণজাগরণের যথাযোগ্য স্থান হিসেবে এই ফুটপাতকেই মনে করা হয়। পথনাটক, নানান পণ্যের পসরা, ছিনতাই, গ্যানজাম-জনজ্যাম, অনেক কিছুই হয় ফুটপাতকে ঘিরে।
ফুটপাতের পাশে দেয়াল ঘেঁষে থাকে, যেন ফুটপাত থাকলে দেয়াল থাকবেই। একটি না থাকলে আরেকটি যেন শূন্য। তমাল প্রায়ই ফুটপাতের সাথে কথা বলে। নীরব ফুটপাতের সঙ্গী তো ফুটপাতের দেয়ালে সাঁটানো হরেক করমের বিজ্ঞাপনের ভাষাই। পড়া শিখে মনে হয় ভুলই হয়েছে বড়।
না হলে ঠোঁট নড়ছে না, উচ্চারণও হচ্ছে না অথচ কতকিছু পড়া হয়ে যাচ্ছে। মগজটাকে তো আর নিবৃত্ত বা সুইচঅফ করে রাখার কোন উপায় নেই। বাংলা শব্দগুলোর বানান আর তাদের ব্যবহার রীতি দেখে মাঝে মাঝেই প্রুফ দেখার মতো করে সম্পাদনা করতে থাকে সয়ংক্রীয় মস্তিষ্ক। এ এক ভয়ংকর ব্যাপার! কেউ কি বলেছে- তমাল বাংলা বা ইংরেজি এই লাইনগুলোর বানান বা শব্দচয়ন ভুল তুমি শুধরে দাও? অথচ বিনা পয়সায় শ্রম দিতে হয় প্রতিদিনই তমালকে। অস্থির এই সময়ে গবেষণার সুযোগ খুবই কম।
শর্টকাটে কিভাবে সবকিছুর সমাধান পাওয়া যায় সেই চেষ্টায় মানুষ এখন মরিয়া। এতে কাজ হয় না তা না। তবে ভিতটা নড়বড়ে হয়।
ফার্মগেট। ব্যস্ত মোড়।
বেশকয়েকটি ফুটপাত জেলিফিসের মতো ছড়িয়ে। সোজা কাওরান বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে তমাল। ঘিঞ্জি মানুষ, সবাই গতিশীল, ¯্রােতের মতো। সাবধানেই হাঁটছে তমাল। হঠাৎ কে যেন পায়ে পাড়া দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
বামে ফিরে তাকাতেই তমাল অভিযোগ করার আগেই লোকটি অভিযোগ করে বসল। -কি ব্যাপার? পাড়া দিলেন আপনি আর উল্টো আপনি আমাকে...? -বেশি কথা কইছ্ না। প্যান্টের ডান পকেটের ভেতর হাত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের মতো কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। -দে, মানিব্যাগটা। তমাল হাসি চেপে রাখতে পারল না।
-এই নেন, কিচ্ছু নাই। ভুল মানুষকে টার্গেট করেছেন। এ কাজে আরও চৌকস হতে হবে। মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে তমালের মুখের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল - ছালা ফকির কোয়ানকার! আবার হাসতে থাকলো তমাল। ফকিরই তো।
সকাল বেলার বাদশা রে তুই, ফকির সন্ধ্যা বেলা। জীবনের শেষপ্রান্তে থাকা অধিকাংশ মানুষের কাছ থেকেই তমাল শুনেছে এই কথা। প্রায় সবার শেষসময়ের অনুভূতিগুলো ঠিক এই রকমই। কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন -খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাটও শিশু আনমনে...। জীবনের শেষবেলাতে পাওয়া এই অনুভূতির আগেই তার প্রস্তুতি সবসময়ই থাকা উচিৎ।
জীবন সায়াহ্নে মনে হবে সবকিছুই শুধুই খেলা ছিল। পুতুল খেলা।
তমাল তার স্ত্রীকে নিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ কালো রঙের চেকশার্টে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ফুটপাতে বসা মোবাইল হকারের পোশাকের পসারে। এ্যাই তোমার আড়ং-এর শার্টটার মতোই ঐ শার্টটা! হাতে নিয়ে পরখ করতে থাকলো তমাল।
গায়ে ঐ শার্টই পরা ছিল তাই পরখ করতে সুবিধাই হলো। হুবুহু একই। তমালের আগ্রহ বেড়ে গেল। এখান থেকেই কিছু কেনাকাটা করে ফেলা যায়। দু’শো টাকা খরচ করেই যদি আড়ং-এর ফ্লেভার পাওয়া যায় তবে আর শখ করে মাঝে মধ্যে বড়লোকেদের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেবার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম হয়েছে সেগুলোতে না হয় কালে ভদ্রে কেন আর কখনোই না যাওয়া।
ব্র্যান্ড বলতে আমরা এতটাই অজ্ঞান যে সেসমস্ত দোকানগুলোতে পোশাক বা যে কোন পণ্যের দাম যা-ই লেখা থাক না কেন হুমড়ি খেয়ে যেন পড়ি। দামটাই যেন ঐ পণ্যের আভিজাত্য আর মাহাত্য প্রকাশ করে! তমালের খুব শখ হলো বাবার জন্য একটা মানিব্যাগ কিনবে। বাবা বলে কথা, সবাই তো একদরের দোকানেই কেনাকাটা করতে পছন্দ করে তাই বাবার ক্ষেত্রে আর বাছ-বিচার নয়। ব্র্যান্ডের হলেই তো জাস্টিফিকেশন হয়ে গেলো। পনের’শ টাকার একটা ক্যাটস্ আইয়ের বেল্ট কিনে নিয়ে গেলো বাবার জন্য।
দু’মাস পরার পর যা হবার তাই হলো। বাবা তার আগের ব্যবহার করা ফুটপাত থেকে কেনা বেল্টটি দেখিয়ে বলল- দেখেছিস কিনে তো দিলি ব্র্যান্ডের টিকলো তো না। আর আমার আগেরটা এই দেখ কত টেকসই। মনে পড়ছে জনপ্রিয় একটি কথা - যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন। এই রতন খুঁজতেও মানুষের এখন বোরিং অনুভত হয়।
তাই ডিজিটাল এ্যাকশান। বোতাম চাপো আর রতœ মাণিক্য নাও। অনেকটা আলী বাবা চল্লিশ চোর গল্পের কাসেমের মতো অবস্থা। অনেক অনেক ধন-রতœ দেখে বেসামাল হয়ে অজ্ঞান হবার মতো ব্যাপার। হঠাৎ করেই স্টার আবার ফুড়–ৎ করেই হাওয়া!
ফুটপাতের জমায়েত।
দখল করে রেখেছে বিশ গজ জায়গার পুরোটা। এই টুকুতেই মানুষের ভোগান্তি কম হচ্ছে না। নেমে যেয়ে প্রধান রাস্তা ধরে হেঁটে তারপর আবার ফুটপাতে উঠতে হচ্ছে। কিছু মানুষ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুটপাত অধ্যাপকের (হকার) লেকচার শুনছে। ব্যস্ত সমস্ত এই যুগে কিছু মানুষদের অনর্থক জমায়েত দেখলে মনে হয় এদের বোধহয় কোন কাজ বা চাকরি বাকরি নেই।
কেউ একজন মনে হলো তমালের মনের কথাটি পড়ে ফেলতে পারলো। তাই বলে ফেলল- না ভাই, অনেক ছুরেছি, কত ডাক্তার কবিরাজ আর বৈদ্য দেখিয়েছি কোন লাভ হয়নি, এই লোকটার কাছ থেকে এক ফাইল ওষুধ কিনে খেয়েছিলাম। এখন অনেক ভালো। বাহ্ এই হকারের তো প্রতিনিধিও তৈরী করা আছে। মনে মনে কোন প্রশ্ন উঁকি দেবার আগেই উত্তর প্রস্তুত।
আর হবেই বা না কেন? এক দু’দিনের চর্চা তো আর নয়। চর্চা করলে একটা মিথ্যে বিষয়ও সত্যের মতো করে উপস্থাপন করা সম্ভব সাময়িক ভাবে। তারপর স্থান কাল পাত্র বুঝে নতুন কোন ব্যবসা শুরু করা। ভালই এদের কাছ থেকেও শিক্ষা নেবার আছে তবে তা নিজেকে সাবধান করার শিক্ষা। হকার এমন ভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপন করছিলেন যে মনে হয় কত আত্মবিশ্বাসী সে।
প্রত্যেকটা ওষুধের জন্য তার কাছে রুগীর ছবি সহ বিভিন্ন দলিলাদি তৈরী। মানুষের মানসিক জায়গাটাকে কত সহজেই ব্ল্যাক মেইল করে দিব্যি অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। তমাল কখনো এই রকম জমায়েতে দাঁড়ায় না। কিন্তু সেদিন দাঁড়িয়েছিল ক্ষণমাত্র। হঠাৎ এক ব্যক্তি মাটিতে ধপাস করে পড়ে গেল।
কি হয়েছে? দৃষ্টি সবার পড়ে যাওয়া লোকটির দিকে। নাক ও মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। হঠাৎই যেন পথ নাটক মঞ্চস্থ হবার মতো অবস্থা। হকার বলছিলেন- এই দেখলেন তো বিশ্বাস করলেন না, বললাম ভাই কেউ আমার ওষুধ নিয়ে টাকা না দিয়ে চলে গেলে বিপদ হবে। নাক থেকে মুখ থেকে রক্ত ঝরবে।
শুনলেন না। এবার বুঝলেন তো? আমার ওষুধের অটো প্রটেকশন আছে। বাহ্ কত চমৎকার ভাবে মানুষের ভেতরের বিশ্বাসটাকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের করে নিলেন এই চতুর হকার লেকচারার!
ভীষণ গতিময় এই শহরের রাস্তাগুলোতে গাড়ি গুলোর গতি আরও বেশি হয় যখন ফাঁকা থাকে রাস্তা অথবা জ্যামটা থাকে নিয়ন্ত্রণে। সেক্ষেত্রে জ্যাম আর স্বাভাবিক যা-ই থাকুক রাস্তার অবস্থা ফুটপাতই হয় হেঁটে চলা মানুষদের পথচলার একমাত্র অবলম্বন। সেই ফুটপাতও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারনে বলি হয় প্রায় প্রতিনিয়ত।
দেখাগেল কিছুদিন পূর্বেই সুন্দর করে অনেক টাকা কড়ি খরচ করে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হলো ফুটপাতগুলোকে অথচ কিছুদিন পরেই নির্মমভাবে তা খোঁড়াখুঁড়ির মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়। দ্রুত হাঁটতে যেয়ে এক অফিসগামি তরুণী হঠাৎ ভেঙ্গে গর্ত করে ফেলা ফুটপাতে চিৎপটাং হলেন। ভীষণ ব্যথায় কোঁকাতে শুরু করলেন। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না তমাল। একদম চোখের সামনেই মেয়েটি পড়ে গেল।
অপরিচিতা। তাকে ধরে টেনে তোলা ঠিক হবে কি না! ঠিক ওই মুহূর্তে পাশে আর কোন পথচারি না থাকায় তমালের বিবেক জেগে উঠলো। এখনই মেয়েটিকে টেনে তোলা উচিৎ। কোন একটা সিএনজি বা ক্যাব ম্যানেজ করে দেয়াটা বোধ হয় খুব জরুরী। হাত ধরে টেনে তুলল তমাল।
তারপর বিনয়ের সাথে বলল- স্যরি, ব্যথাটা অনেক বেশি পেয়েছেন? একটা সিএনজি ডাকবো? আপনার পরিচিত কোন ব্যক্তির নাম্বার দেয়া যাবে? ব্যথা জড়িত কন্ঠে মেয়েটি বলল- না, লাগবে না, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি নিজেই যেতে পারবো। আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড...। সস্তায় বানানো সাটামাটা স্টাইলের ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট প্রিন্টের একটি ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিয়ে তমাল তার পথে হাঁটতে থাকলো। বাস চলছে এলোমেলো।
হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে তমাল। কন্ডাক্টর কর্কশ কন্ঠে বলল- ভারা দ্যান। -ভাইরে দেখতেই তো পাচ্ছো ঝুলে যাচ্ছি। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাত কোনমতে নাগাল পাওয়া মাথার উপরের জং ধরা হ্যান্ডেলে। দুইটা হাতই তো বন্ধ।
বসতে পারলেই তোমার ভাড়া দিয়ে দেব। বাসটা জ্যামে নিস্তার নিচ্ছে। এই সুযোগে পেছনের পকেটে হাত দিতেই তমাল বুঝতে পারলো মানিব্যাগটা নেই। যদিও মানিব্যাগে বরাবরের মতোই টাকার পরিমান থাকে খুবই সামাণ্য। পাবলিক বাসের প্যাসেঞ্জার বলে কথা।
বাসের ভাঙ্গা ময়লা একটা দেবে যাওয়া সীটে বসার সুযোগ হলো। মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠল। অপিচিত নাম্বার। -হ্যালো, কে বলছেন? অপূর্ব মিষ্টি একটি কন্ঠ ভেসে এলো ও প্রান্ত থেকে। -আপনার সাহায্যের ব্যাপারে মনে হলো আপনার মনটা উদার, ভাবনাগুলো পরিপক্ক, প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন কিন্তু পকেটের অবস্থা এতো শোচনীয় কেন? নিতান্তই সংকুচিত, অপরিপক্ক।
আপনার মানিব্যাগটাকে টার্গেট করা একদম বেকুবের মতো কাজ হয়েছে আমার। আমি হেরে গেলাম। মানিব্যাগটা ফুটপাতের পাশের ঝোঁপে ফেলে এসেছি ফিরবার পথে খুঁজলে টাকাসহ অক্ষত অবস্থায় পাবেন আশা করি। তমাল স্তব্ধ হয়ে গেল ছিনতাইয়ের এমন অভিনব কায়দা দেখে!
তমাল কতকিছু যে ভাবে হাঁটতে হাঁটতে। জ্ঞানীরা বলেন, যে কোন সমস্যায় নাকি সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় এই পথ হাঁটার মধ্য দিয়ে।
হাঁটতে হাঁটতেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয় অনেক জটিল বিষয়ের। সমাধানের পথ বেরোয় বিভিন্ন বিকল্প হয়ে। হঠাৎ মোটর বাইকের হর্ণ। মনে হলো কাঁধের কাছে শরীরের উপর দিয়েই মাড়িয়ে চলে যাবে। পেছন ফিরে তাকাতেই প্রতিদিনের মতো ফুটপাতে মোটর বাইক।
অন্তত ফুটপাত ধরে তমালের মতো নিরীহ মানুষগুলো যে শান্তি মতো নিরাপদে পথ চলবে তার উপায় নেই। যান্ত্রিক মৃত্যুদূত যেন ফুটপাতেও মানুষকে নিরাপদে থাকতে দেবে না। যান্ত্রিক? ন্যূনতম বোধও যদি মানুষের থাকে তবে যারা মোটরবাইক ফুটপাতে চালান তাদের ভাবা উচিৎ হেঁটে চলা মানুষগুলো তাহলে কোথায় যাবে? মান্যবর হাইকোর্ট থেকেও অর্ডার হয়েছে যেন ফুটপাতে কেউ মোটরবাইক না চালায়। কে শোনে কার কথা? কথায় আছে না- মানলে তাল গাছ, না মানলে আগাছ।
একটা গানের কথা এখন খুব মনে পড়ছে- মাঝে মাঝে পৃথিবীটা ছোট মনে হয়/ কোথায় রাখবো পা/ পথচলা দূরে থাক/ নুব্জ এ পিঠ আমার/ একটু বিরতি পাক/ এতো স্বপ্নের বোঝা নিয়ে দাঁড়াবো কোথায়? স্বপ্ন অনেক কিন্তু তার ভার বইবার সাধ্য আমাদের সীমিত।
সাধ দিলা তুমি সাধ্য আমায় দিলা না/ কি রঙের খেলা খেল আমি তার ভাব বুঝি না। ফেরিওয়ালা তমাল স্বপ্নগুলো ফেরি করে যেখানেই নিতে চায় না কেন প্রতি মুহূর্তে বাধার সম্মুখীন হয়। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সামনে এগোনোর বিকল্প নেই। কিন্তু সামনে যাওয়া তো দূরে থাক পথই তো অবমুক্ত নয়। সামাণ্য ফুটপাতেই এই অবস্থা বড় পথগুলো তো বড় বড় মানুষের জন্য।
এই তো সেদিন তমাল খুব তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিল ফুটপাত ধরে। ফুটপাতেই বেশ কয়েকজন গ্রামীণফোনের ইউনিফর্ম তরুণী প্রায় পথ আটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল- স্যার আপনি কি গ্রামীণফোন ইউজ করেন? নিশ্চয়ই জব করছেন। একটা স্মার্ট অফার আছে আপনার জন্য। কয়েকটা স্পীকার যেন একসাথে কথা বলে উঠল। অনুরণন হলো কানে।
নারী কণ্ঠ বলে কথা। একবার মনে হলো উত্তর দেই আবার মনে হলো না উত্তর না করে সামনে এগোই। গ্রামীণফোনের কথাটি বলতেই ডান পকেটে হাত পড়ল তমালের। যাই হোক মোবাইলটা এখনো পকেটে আছে। প্রিয় সিমটাই লাগানো।
কিন্তু ক্ষণমাত্র দেরি করতে ইচ্ছে করল না কারন দ্রুতপদক্ষেপটাই কখন জরুরী ছিল। চোখ ধাঁধাঁনো বিজ্ঞাপনের কারনে যখন চোখ রাখাই দায় তখন প্রায় ফুটপাত বন্ধ করেও লাইভ বিজ্ঞাপন প্রচার খুব বেশি আশ্চর্য্যের কিছু মনে হলো না। তবে কে কোন অবস্থায় সময় পার করছে তা বোধ হয় ভেবে দেখা উচিৎ। না হলে বিড়ম্বনা হতে পারে। বিব্রত হবার সম্ভাবনা আছে উভয়েরই।
ফুটপাতের সাথে ফুটওভার ব্রীজের একটা মজার সম্পর্ক আছে অন্তত: ফুটে ফুটে অর্থাৎ পায়ে পায়ে। পা পা করেই প্রায় সবসময়ই ফুটপাত থেকে ফুটওভার ব্রীজে পার হতে হয় তমালকে। ফুট দিয়ে মাপা এই ফুট দৈর্ঘ্যের পথগুলোতে ফুট (পা) রাখা বড় দায়। নানা রকমের পসরার পাশাপাশি এই ভূখন্ড কত গরীব তা বোঝানোর জন্য যেন সমিতি বা সিন্ডিকেট বা ব্যবসার মতো করেই ভিক্ষুকদের প্রাত্যহিক পেশায় নিয়োজিত রাখা। এই শহরে যখন প্রথম ফুটপাতে পা পড়ে তমালের তখন সামর্থহীন দূর্বল প্রতিবাদ করেছিল সে।
তাতেই হাত কাটা, পা ভাঙ্গা, ব্যান্ডেজ বাঁধা ভিক্ষুক মহোদয়গণ মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে যেভাবে তেড়ে এসেছিল ওর দিকে তাতে করে মনে মনে কানে ধরে তওবা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। পরে তাদের কাছ থেকেই সংবাদ সংগ্রহের সময় জানা গেল তাদের পেছনের শক্ত শক্তির কথা। অবাক হবার ব্যাপারই বটে। তবে অবাক হবারও কিছু নেই কারন ওপেন সিক্রেট বলে একটা কথা তো আছেই। সবাই জানি, সবাই মৌন সম্মতি দিয়ে যাচ্ছি অথবা ক্ষমতা নেই বলে বাধ্যগত চুপ থাকছি।
এই যখন অবস্থা কখন তমালের আর কি-ই বা করার থাকছে মানুষের চৈতন্যকে জাগিয়ে তোলা ছাড়া? অন্তত: চেতনা জাগ্রত হোক, বার বার এই কথাগুলো পঠিত হোক, আড়মোড় ভাঙ্গুক ঘুমন্ত অসাড় দেহের দৃশ্যত চলামান আত্মাগুলোর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটপাত। ফুটপাতেও জ্ঞান-বিজ্ঞান ছড়িয়ে। নানান স্বাদের বই, ম্যাগাজিন, নতুন পুরাতন সংস্করণ, বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ-অজ্ঞ বিভিন্ন লেখকের শ্রেণী-মান নির্বিশেষে পর্যাপ্ত। সব জানা-অজানার ¯্রােত যেন এখানে মিশেছে।
অসহনীয় মূল্যের বইয়ের সহনীয় মাত্রার মূল্য ক্রেতা-দর্শকদের আগ্রহকেও বাড়িয়ে দেয় যেন। ফুটপাতেই এটা সম্ভব। অনেকটা বনেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’র বিপরীত। বিখ্যাত হবার সুলেখাগুলোও কত সহজেই পাওয়া যায়। হরেক রকমের সওদাও হাতছানি দেয়, মন ভুলিয়ে দেয় বিভিন্ন সাইজ আর সুরওস্কেলের বাঁশের বাঁশিগুলোও।
এছাড়াও মেলে সহজেই সহজাত পাগলের দেখা। এঁরা জাগতিক পাগল, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়ে, কবিতা, সাহিত্য, প্রেম, নগ্নতা আর ভিন্নতায় মত্ত থাকে সারাবেলা। আদর্শ এঁদের জাগতিক সমতান্ত্রিকতা। চুলগুলো এলোমেলো দীর্ঘকায়, জট থাকলে আরও মানায়, কাঁধে কব্যিক ঝোলা, পরনে রণ-বিদ্রোহী লেখা কবিতা প্রিন্ট করা গেঞ্জি অথবা লম্বা আলখেল্লা অথবা পাঞ্জাবী। মলিন পুরোনো সাজে সজ্জিত এই সৃজনশীল মানুষগুলোকে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের পাশের ফুটপাতেই মানায়।
এঁরা হয় উদার অনেক, তাই নর-নারীতে অসম সম অধিকারে বিশ্বাসী। পরিচ্ছদে কাছাকাছি হয় খুব। পশ্চাদপদ হবার সুযোগ যেমন রাখে না তেমনি পশ্চাদভাগ দেখেও বোঝা মুশকিল জনাব না জনাবা।
তমাল তার নিজের অস্তিত্বই কখনো কখনো যেন খুঁজে পায় না। মনুষ্য এ জাতির কি হলো যে স্বাভাবিক সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে না? যৌক্তিক বিভিন্ন অনুষঙ্গ উপসঙ্গ গুলো যেন ফ্যাল্না।
অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্রতীকি মনুষ্যের প্রয়োজনও অনুধাবন করে না। একেক জন যেন নিজেরাই নিজেদের অনুসরণকারী। এটাই আমাদেরকে ভুলের মধ্যে রাখছে। ভুলগুলোকে ভিন্নমত সৃজনশীলতা মনে করে মূলত আমরা আমাদেরই বিপদের ফাঁদে পড়ছি। যুগে যুগে মনুষ্যজাতি আলোর পথে চলেছে, সমাধান খুঁজেছে সমস্যার, গড়েছে সভ্যতা অথচ এই বলিষ্ঠ নীরবিচ্ছিন্ন সচেতনতা আর অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগেও আমরা হয়ে পড়ছি কূপমন্ডুক, স্বব্যস্ত।
মম নিত্য তব সাধনা সিদ্ধ হোক বাসনা মানবেরে উচ্চে ধরি। মানুষে মানুষে ধরিবে হস্ত করিবে শপথ চলিতে সমবেত। লক্ষ্য হবে সিদ্ধি নিশ্চিত ধরা হবে মর্ত্যস্বর্গ।
লেখক: এস জে রতন -সঙ্গীত শিল্পী, ক্ল্যাসিক ব্লগার, প্রশিক্ষক ও উন্নয়নকর্মী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।