দৌড়াতে ভালো লাগে না, তাই দাঁড়িয়ে আছি জাতি হিসাবে আমাদের গর্ব করার মত ঘটনার কোন কমতি নেই। কিন্তু আমরা সেই গর্বকে দম্ভ এর পর্যায়ে নিয়ে যাইনি, শুধু অহঙ্কারেই খুশি থেকেছি। আমার বক্তব্যের সমর্থনে অনেক ঘটনার কথাই বলতে পারি। যেমনঃ আমরা বলি আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মনে প্রানে বিশ্বাস ও করি। কিন্তু তাই বলে অন্য জাতিকে ছোট করি না।
কখনো কখনো অন্যান্য তথাকথিত শ্রেষ্ঠ জাতির সদস্যদের আচরনে রূষ্ট হয়ে কেউ কেউ তাদেরকে পালটা জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন (বলাই বাহুল্য, এই চেষ্টা শুধু মৌখিক এবং সুশীলতা বর্জিত বানী দেয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে)। তখন আমার দেশের লোকেরাই তাদেরকে বাঁধা দেন এই বলে যে, “অন্যকে ছোট করে কখনো নিজে বড় হওয়া যায় না। ” ভয়ানক শক্ত যুক্তি।
আমরা অন্য কাউকে ছোট করে কখনো বড় হতে চাই না । তাই অন্য কোন জাতিকে কখনো ছোট করি না।
আমরা নিজেদেরই ছোট করে চলি প্রতিনিয়ত। জীবনে চলার পথে ব্যস্ততার অজুহাতে নিজেদের অর্জিত সকল জাতীয় সাফল্যকে পদদলিত করে অমানুসিক আনন্দ লাভ করি। শুধু তাই না, জাতি হিসাবে আমাদের আরেকটা গুন আমরা ব্যাপক বাকপটু। খুবই দ্রুত আমরা আমাদের আশেপাশে যেসব মানুষ পদদলিত করতে রাজী না হন, তাদেরকে বুঝিয়ে দেই, “তোমরা ছাগলের বংশধর, মানুষ যদি হতে চাও আমার মত অমানুষ হও। ”
বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা ? না হবারই কথা।
এবার প্রমান দিচ্ছিঃ
আমি তখন বেশ ছোট, একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে মানুষের ঢল দেখেছিলাম বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে, খুলনাতে। মূল শহীদ মিনার দেখার সুযোগ হয়েছে অনেক পরে। ২০০৭ সাল থেকে ক্লাস না করে শহীদ মিনারে বসে থাকা আমাদের ৪ বন্ধুর একপ্রকার স্বভাবে পরিনত হয়েছিলো। যদি পরদিন আমাদের কোন ক্লাস টেস্ট বা ল্যাব রিপোর্টের ঝামেলা না থাকত, “চল, শহীদ মিনারে যাই”। কতবার যে সেখানে আমরা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি, সেই হিসাব করতে গেলে কম্পিঊটার লাগবে নিশ্চিত।
প্রথম দিন শহীদ মিনারের উপর আবর্জনা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, দেশে কি সচেতন মানুষের সংখ্যা এতোই কম !!!!! বারবার একটাই প্রশ্ন মনে আসছিলো ঃ ওরা কিভাবে পারে এইভাবে আমাদের প্রথম অর্জনকে পদদলিত করতে ? আমি নিজে যে কখনো ওদের মত করতে পারব তা ভাবার মত দুঃসাহস আমার সেদিন ছিলো না।
যখন বিকালে গিয়ে বসতাম ওখানে আড্ডা দেয়ার জন্য, আমি হিসাব করতাম কতজন খালি পায়ে উঠল আর কতজন স্যান্ডেলকে খালি রেখে অপমান করতে রাজী হল না। বেশিরভাগ সময়ই অনুপাত খালি পা ঃ স্যান্ডেল সহ = ২ঃ৯৯ এর মত হত। শহীদ মিনারে বিকাল বেলা অনেক মানুষের আনাগোনা থাকে। সবাই যে যার মত হাসি- ঠাট্টা- তামাশায় ব্যাস্ত থাকে।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততার মত মানুষ এখানে আনন্দ করার সময়ও ব্যস্ত থাকে। অদ্ভুত কোন ঘটনা না ঘটলে কেউ কোন দিকে তাকায় না। মজার ব্যাপার হলোঃ কেউ যদি বেদীতে ওঠার সময় স্যান্ডেল নিচে রাখে, প্রায় সবাই তাকে খেয়াল করে। খেয়াল করার পর তাদের দৃষ্টি যেরকম থাকে তা ব্যাখ্যা করা আমার জ্ঞান বহির্ভুত। তবে বন্ধু জাভিয়েসটার ভাষায় সেগুলোকে নাকি কৌতুক এবং কটাক্ষের সমষ্টি হিসাবে প্রকাশ করা যায়।
ব্যাস, আমরা জেনে গেলাম শহীদ মিনারের বেদীতে খালি পায়ে ওঠা ছাগলের কাজ, মানুষের নয়। আমি এরকম মানুষ হতে রাজী ছিলাম না , তাই বেদীতে উঠলে খালি পায়েই উঠতাম। একুশে ফেব্রুয়ারী চলে গেলেই শহীদ মিনারকে অপবিত্র করার জন্য শ্রেষ্ঠ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রানান্ত চেষ্টা ও আমাকে মানুষ বানাতে পারেনি ।
তাহলে আমি মানুষ হলাম কি করে ? সেটা বলার জন্যেই তো এতো আয়োজন। আর দেরী করব না, বলে দিচ্ছি।
যথারীতি ক্লাস বাদ দিয়ে ২ বন্ধু গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে (তারিখটা মনে নেই বলে এখন বেশ খুশি খুশি লাগছে) । সময় সকাল সোয়া এগারোটা, আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। এতোগুলো চা বিক্রেতা সবসময় বিরক্ত করে, তাদেরকে কোথাও দেখছিলাম না সেদিন। কি আর করা, ঝাল মুড়ি নিয়ে বসলাম । এই সময় একটা মাইক্রবাস এসে থামলো।
৪/ ৫ জন বিদেশী আর একজন স্বদেশী নামলো। তারা সকলেই গল্প করে হাটতে হাটতে বেদীর সামনে গেলেন। দেশী লোকটা সেখানে দাঁড়িয়ে শহীদ মিনারের দিকে ইঙ্গিত করে কথা বলছিল, বাকীরা সবাই তখন শুনছিলো । একসময় স্বদেশীর কথা শেষ হলো। এবার ছবি তোলার জন্যে তোড়জোড় শুরু হলো।
বিদেশীদের মধ্যে সবথেকে বয়স্ক যিনি ছিলেন তিনি ক্যামেরা নিয়ে দাড়ালেন, বাকীরা সামনে পোজ দিলো, সবার পায়েই পাদুকা (স্বাভাবিক, বিদেশীরা তো আর আমাদের সব “সেন্টিমেন্ট” বুঝবে না। কিন্তু বাংলাদেশীও যে পাদুকা নিয়েই উঠলেন। তাও আবার এতো গুলো বিদেশির সামনে !!!!! বাহ বাঙ্গালী বাহ, সত্যিই তোমরা বাঘ) । প্রথম পর্যায়ের ছবি তোলা শেষ হলো। এবার ক্যামেরা বাংলাদেশীর হাতে আসলো।
বয়স্ক বিদেশী এবার বাকী বিদেশীদের মাঝে দাড়াবেন।
কিন্তু একি!!! উনি যে নিজের জুতা খুলছেন!! কেনো? যেখানে বাঙ্গালীরাই খালি পায়ে ওঠাকে খারাপ চোখে দেখছে, সেখানে ওনার দায়বদ্ধতা কিসের ? আমার প্রথমে মনে হয়েছিলো ভুল দেখেছি তাই নিশ্চিত হবার জন্য বন্ধুর সরনাপন্ন হতে হলো। জানলাম, আমি ঠিকই দেখেছি।
এই ঘটনার পর থেকে আমি আর বেদীতে ওঠার সময় আর স্যান্ডেল খুলি না। কেনো? উত্তর আমার জানা নেই।
শুধু মনে হয়, সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলো, তাদেরকে সম্মান জানানোর মত যোগ্যতাও জাতি হিসাবে আমাদের নেই। যেদিন যোগ্যতা হবে, সেদিন আবার শহীদ মিনারের বেদীতে উঠব, খালি পায়ে। চায়ের কাপ নিয়ে না, ফুলের তোড়া নিয়ে। তার আগে পর্যন্ত স্যান্ডেল পরেই উঠব।
গালি দিবেন আমাকে?
দেন
আবার দেন
আবার আবার আবার আবার ........................
আমি নিজেই তো সারাদিন নিজেকে গালাগাল করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।