খন্দকার ফজলুল হক
প্রাক কথন
ইসলাম সর্বযুগের সকল মানুষের কাছে চিরন্তন শ্বাশত ধর্ম। পবিত্র কুরআনেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহর মনোনীত ধর্ম একমাত্র ইসলাম। আর ইসলাম ধর্মের সংবিধান হলো, কুরআন ও হাদীস। কুরআন সংরক্ষণের কাজ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেই সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলন এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মহান খেদমতের ধারা কিয়ামত পর্যন্ত চলতেই থাকবে।
ইসলামের ইতিহাসে যে ক’জন বিরল মনীষী প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ সমুন্নত রাখা ও তা মানব জাতির নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হলেন ইমাম বুখারী রহ.। তার লিখিত হাদীস গ্রন্থ সহীহ আল বুখারী আল কুরআনের পরেই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও বিশুদ্ধ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
নিম্নে ইমাম বুখারী রহ. এর বর্নাঢ্য জীবনীর কিছু অংশ ও তার সংকলিত হাদীসগ্রন্থ সহীহ বুখারী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করা হলো।
জন্ম
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী রহ. ১৯৪ হিজরী ১৩ ই শাওয়াল জুমার নামাযের পর উজবেকিস্তানের অন্তর্গত বুখারা নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। (তারীখে বাগদাদ : ১/৩৩১)
নাম :
মুহাম্মাদ, পরিচিত ছিলেন আবু আব্দুল্লাহ নামে।
পিতার নাম ছিলো ইসমাইল। পিতামহের নাম ইব্রাহীম এবং প্রপিতামহের নাম ছিলো মুগীরা। (তাহজীবুল কামাল : ২৪/৪৩০)
শিক্ষাজীবন
ইহ জগতে শুভাগমনের কয়েক বছর পর তিনি পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। তাই তার প্রাথমিক শিক্ষা ও লালন-পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তার মমতাময়ী মাতা। মমতাময়ী মাতার তত্ত্বাবধানে ইমাম বুখারী স্থানীয় শিক্ষাঙ্গনে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
মাত্র নয় বৎসর বয়সে পবিত্র কুরআনে কারীম হেফয করেন।
দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া
বাল্যকাল থেকেই ইমাম বুখারী রহ. এর উপর আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত-এর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো। বাল্যবস্থাই তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার মমতাময়ী মাতা সর্বদা অশ্র“সিক্ত নয়নে মহান আল্লাহপাকের দরবারে প্রার্থনা করতেন।
একদা তাঁর মাতা হযরত ইব্রাহীম আ. কে স্বপ্ন দেখেন, তিনি তাকে বলছেন যে, তোমার অধিক পরিমাণে কান্নাকাটির দরুন আল্লাহ তায়ালা তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরে দিয়েছেন।
নিদ্রাভঙ্গের পর নিজ তনয়ের নিকট গমন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া দেখে অত্যন্ত আনন্দিত ও আবেগাপ্লুত হয়ে মহান আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। (তারিখে বাগদাদ : ১/৩৪৪, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ১১/৩১)
বাল্যকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষার প্রতি অতি উৎসাহী ছিলেন এবং হাদীস অধ্যয়নে উদ্বেলিত হয়ে পড়তেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেন “আমি যখন মক্তবের ছাত্র তখন থেকেই আমার মধ্যে হাদীস মুখস্থ করার উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়। জনশ্র“তি রয়েছে যে, তিনি বাল্যকালেই সত্তর হাজার হাদীস মুখস্থ করেছিলেন। (তারিখে বাগদাদ : ১/৩৩১, বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন : ১৭১)
হাদীস সংগ্রহে সফর
মাত্র ১৬ বছর বয়সে পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির সাহায্যে আপন মাতা ও বড় ভাই আহমাদসহ হজ্বে যান।
হজ্ব পালন শেষে মা ও বড় ভাই আহমাদ স্বদেশে প্রত্যবর্তন করেন, কিন্তু ইমাম বুখারী রহ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেশেই রয়ে গেলেন। সেখানে অবস্থানরত প্রায় সকল মুহাদ্দিসগণের শরণাপন্ন হয়ে তিনি ইলম চর্চা ও হাদীস শিক্ষায় নিমগ্ন থাকেন। এ সময় তিনি গ্রন্থ প্রণয়ন ও হাদীস সংকলনের প্রতিও মনোনিবেশ করেন। বয়স যখন ১৮ বছর তখন তিনি মক্কায় থাকা কালীন ‘কাযায়াস সাহাবা ওয়াত তাবেঈন’ নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। অতঃপর সেখানকার খ্যাতনামা মুহাদ্দিগসগণের নিকট থেকে হাদীস চর্চা অব্যাহত রাখেন।
পাশাপাশি তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওজা মোবারকের পার্শ্বে চন্দ্রালোকে তার বিশ্ববিশ্র“ত গ্রন্থ আততারীখুল কাবীর এর প্রণয়নের কাজে হাত দেন। (বেদায়া নেহায়া : ১১/৩০, মুকাদ্দামায়ে তুহফাতুল আহওয়াজী : ৯৪)
এরপর হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইমাম বুখারী রহ. সিরিয়া, মিশর, বসরা, কুফা, বাগদাদ, হেযাযসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশ সফর করেন। (তারীখে বাগদাদ : ১/৩৩০)
অসাধারণ স্মৃতিশক্তি
এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী রহ. নিজেই বলেন, “আমি যা একবার শ্রবণ করতাম আল্লাহর ফযলে তা কখনো ভুলতাম না।
ঐতিহাসকিগণ তাঁর স্মরণশক্তি সম্পর্কে বেশকিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
তাঁর অপরিসীম ও অতুলনীয় স্মৃতিশক্তির পরিচায়ক হিসেবে দুটি ঘটনা নিম্নে তুলা ধরা হলো।
এক. রাসেদ ইবনে ইসমাইল রহ. বলেন, ইমাম বুখারী রহ. আমাদের সাথে বসরার মাশায়েখদের দরবারে উপস্থিত হতেন। তিনি ব্যতীত আমরা সকলেই হাদীস লিখে সংরক্ষণ করতাম। ষোল দিন পর ব্যাপারটি আমাদের নজরে ধরা পড়লে আমরা তাকে ভর্ৎসনা করে বললাম, হাদিস লিপিবদ্ধ না করে এতগুলো দিন কেন নষ্ট করে দিলে? উত্তরে ইমাম বুখারী রহ. বললো, দিনগুলো নষ্ট হয়নি। তোমাদের লিখিত কপিগুলো হাতে নাও এবং শোন। একথা বলে তিনি ধারাবাহিক ভাবে পনের হাজারেরও বেশি হাদীস মুখস্থ বর্ণনা করলেন আর আমরা উপস্থিত সকলেই নিজ নিজ কপিগুলো সংশোধন করে নিলাম।
তখন তার বয়স ছিল মাত্র ষোল বছর।
দুই.
তৎকালীন খিলাফতে বনী উমাইয়ার রাজধানী বাগদাদে ইমাম বুখারী রহ. কে পরীক্ষা করার জন্য এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং এর জন্য বাগদাদের দশজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিসকে নির্বাচন করা হয়। তাঁরা প্রত্যেকে দশটি করে হাদীস সনদ ও মতন এলোমেলো করে মোট একশত হাদীস ইমাম বুখারীর সামনে উপস্থাপন করলে ইমাম বুখারী রহ. প্রথমেই প্রত্যেকের প্রতিটি হাদীসের ভুলগুলো বর্ণনা করত: তার সঠিক সনদ ও বিশুদ্ধ মতন এক এক করে ধারাবাহিকভাবে বিস্ময়কর পারদর্শিতার সাথে বর্ণনা করে দিলেন।
(তারিখে বাগদাদ ১/৩৪১, তাহজীবুত তাহজীব ৫/৩২, তাহজীবুল কামাল : ২৪/৪৫৩)
বুখারী শরীফ সংকলনের পটভূমি
এ প্রসঙ্গে বুখারী রহ. নিজেই বলেন যে, একদা আমি ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই রহ.-এর দরসে বসা ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি এমন একটি কিতাব প্রণয়ন করত যাতে শুধু সহীহ হাদীসগুলি থাকবে, তবে খুবই ভাল হতো।
উল্লেখিত কথাটি যদিও অনেকেই শুনেছে, কিন্তু এরূপ গ্রন্থ প্রণয়নের অদম্য আগ্রহ আমার মনেই জাগ্রত হয় এবং সেদিন থেকেই আমি এই কিতাব প্রণয়ন শুরু করি। (তারিখে বাগদাদ : ১/৩৩১, তাহজীবুত তাহজীব ৫/৩১)
২. ইমাম বুখারী রহ. বর্ণনা করেন, একদা আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি একটি হাতপাখা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেহে মোবারকে বাতাস করছি এবং তাঁর দেহ মোবারক থেকে মাছি তাড়াচ্ছি। একজন অভিজ্ঞ স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তদুত্তরে বললেন, তুমি এমন কোন কাজ করবে যার দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যা ও জাল কথা সম্পৃক্ত করার ঘৃণ্য প্রয়াস মূলোৎপাটিত হবে। ” বস্তুত উক্ত স্বপ্নই সহীহ বুখারী লিখতে আমাকে অনুপ্রাণিত করে। (হাদিউস সারী ৯:৬৫)
রচনা কাল
ইমাম বুখারী রহ. মাত্র ২৩ বছর বয়সে ২১৭ হি. হারাম শরীফের অভ্যন্তরে বসে এ কালজয়ী গ্রন্থ সংকলন শুরু করেন।
তারপর মসজিদে নববীর মিম্বর ও রওজা পাকের মধ্যবর্তী ‘বাইজা’ নামক স্থানে বসে সহীহ বুখারীর শিরোনাম সংযোজন করেন। সুদীর্ঘ ১৬ বছর অক্লান্ত ও নিরলস প্রচেষ্টায় ২৩৩ হিজরী সনে সংকলনের কার্যক্রম সমাপ্ত করেন।
সংকলনের বিস্ময়কর পন্থা
ইমাম বুখারী রহ. তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ সহীহ বুখারী রচনা করতে গিয়ে যে বিরল ও বিস্ময়কর পন্থা অবলম্বন করেন তা নিম্নরুপ-
ক. দীর্ঘ ১৬ বছর রোযা অবস্থায় তিনি সহীহ বোখারী সংকলন করেন। (ফজলুল বারী : ১/৬১)
খ. প্রত্যেকটি হাদীস লেখার পূর্বে গোসল করে দু’রাকাত নফল নামায আদায় করে রওজা মোবারকের দিকে মুখ করে মোরাকাবার মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। (তারীখে বাগদাদ : ১/৩৩৩, তাহজীবুত তাহজীব : ৫/৩১)
গ. প্রতিটি অধ্যায় ও শিরোনাম নির্ধারণ করার পূর্বে দু রাকাত এস্তেখারার নামায আদায় করতেন।
(হাদিউস সারী : ৫১৩, তারীখে বাগদাদ : ১/৩৩৩)
ইন্তেকাল
জীবনের শেষ ভাগে বুখারার শাসনকর্তা খালিদ ইবনে আহমাদ যুহলী ইমাম বুখারী রহ.-এর কাছে এ মর্মে সংবাদ পাঠালেন যে, কোন এক সময় রাজ দরবারে এসে তিনি যেন আমার ছেলেকে সহীহ বুখারী ও তারীখে কাবীর পড়ে শুনিয়ে যান।
ইমাম বুখারী রহ. এই নির্দেশ সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করে বললেন, আমি হাদীসকে অপমান করতে বাদশাহের দরবারে নিয়ে যেতে পারবো না। তিনি আরো জানিয়ে দিলেন যে, প্রয়োজনে তিনিই যেন আমার নিকট মসজিদে কিংবা আমার ঘরে উপস্থিত হন। (তাহজীবুল কামাল : ২৪/৪৬৪)
এতে শাসকের সাথে ইমাম বুখারীর মনোমালিন্য ঘটে রাজরোষের শিকার হন ইমাম বুখারী। অতঃপর শাসনকর্তা নানা প্রকার কলা-কৌশল অবলম্বন করে ইমাম বুখারীকে দেশান্তর হতে বাধ্য করেন।
ফলে তিনি সমরকন্দের নিকটে অবস্থিত ‘খরতঙ্গ’ নামক শহরে চলে যান, কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তিনি একবার তাহাজ্জুদ নামায আদায়ান্তে আল্লাহ পাকের কাছে এই দোয়া করলেন “হে আল্লাহ! এ বিশাল পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তা আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। অতএব তুমি আমাকে উঠিয়ে নাও। ” (তাহজীবুল কামাল : ২৪/৪৬৬)
আল্লাহ তায়ালা ইমাম বুখারীর দোয়া কবুল করে নিলেন। এর কিছুদিন পরেই ২৫৬ হিজরী ১ শাওয়াল মোতাবেক ৩১শে আগষ্ট ৮৭০ খৃষ্টাব্দে শুক্রবার ‘খরতঙ্গ’ নামক স্থানে হাদীস শাস্ত্রের এই মহান সাধক মাত্র ১৩ দিন কম ৬২ বছর বয়সে গোটা মুসলিম জাতিকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আপন প্রতিপালকের সান্নিধ্যে চলে যান। (হাদিউস সারী : ৫১৭, বেদায়া নেহায়া : ১১/৩৩, তারীখে বাগদাদ : ১/৩৩, তাহজীবুল কামাল : ২৪/৪৩৮)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।