আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার প্রথম বর্ষপূর্তি এবং মুভি রিভিউ: Spellbound (1945), একটি হিচককীয় মাস্টারপিস

© এই ব্লগের কোন লেখা আংশিক বা সম্পূর্ণ আকারে লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, আলফ্রেড হিচকক আমার সবচেয়ে পছন্দের মুভিমেকার। তার যতোগুলো মুভি দেখেছি সিম্পলি গ্রোগ্রাসে গিলেছি। যেহেতু হিচকক আমার মোস্ট ফেভারিট তাই ফিল্ম-নয়ের, মিস্ট্রি ড্রামা মুভি আমার সবচেয়ে পছন্দের জেনার। হিচককের মুভিগুলোর যে জিনিসটি সবচেয়ে পছন্দ করি তা হলো কোথায় কতোটুকু দেখালে সাসপেন্স কিংবা মিস্ট্রি একেবারে পারফেক্ট ভাবে ফুটে উঠে তা হিচককের চেয়ে আর কেউ ভালো জানেন না।

তার প্রত্যেকটি মুভি টানটান উত্তেজনায় ঠাসা, প্রচন্ড এনগেজিং আর ইনটেনস ড্রামা হয়, আর তার মাঝে তিনি রোমান্স জিনিসটা এতোটাই অনবদ্যভাবে দেখান, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। যাই হোক, সামুতে আজ আমার প্রথম বর্ষপূর্তি, তাই চেয়েছিলাম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমার খুব পছন্দের একটি মুভির রিভিউ দেই। তাই গুরু হিচককের কাছেই নিজেকে সমর্পন করলাম। হিচককের সাইকো,দ্যা বার্ডস, নর্থ বাই নর্থওয়েষ্ট কিংবা রিয়ার উইন্ডোর মতোন কালজয়ী মুভিগুলো হয়তো অনেকেই দেখেছেন,তাই ওদিকে যাবো না। আজকে বরং হিচককের আরেকটি অসাধারন মুভি, Spellbound এর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো,এটিকে শুধু অসাধারনের না বলে বরং অনন্যসাধারন বলা উচিৎ।

মুভিটা দেখেছিলাম প্রায় দুই বছর আগে। আজকে এই পোস্ট উপলক্ষে আবার দেখলাম। সেই পুরোনো মুগ্ধতাটুকু যেনো শতগুণ হয়ে আবার ফেরত আসলো। মুভিটির নামের মতোই একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ অবস্থা। প্রথমে মুভিটির কিছু জেনারেল ইনফো দেই।

মুভির নাম আগেই বলেছি। এটি ১৯৪৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর হলিউডে রিলিজ পায়। মুভিটির লেংথ প্রায় দুই ঘন্টার কাছাকাছি, ১১১ মিনিট। জেনার এজ ইউজ্যুয়াল মিস্ট্রি ড্রামা, সাথে হিচককীয় রোমান্সতো আছেই। তবে একে সাইকোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার বলা যায়।

The House of Dr. Edwardes নামক একটি উপন্যাসকে কেন্দ্র করে এই মুভিটি বানানো হয়েছে। মুভিটির কাহিনী গড়ে উঠেছে সাইকোএনালাইসিস কে ঘিরে। সাইকোএনালাইসিস হচ্ছে সাইকোথেরাপীর একপ্রকার মেথড যেখানে সাইকোএনালিস্টরা তাদের পেশেন্টদের সাথে তার সমস্যাগুলো নিয়ে গল্পোচ্ছলে বিস্তারিত আলাপ করে এবং এর মাধ্যমে রোগীদের মনের ভিতরের সমস্যাগুলোকে বের করে তোলে যা তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এই মানসিক কমপ্লেক্সসিটিগুলোকে তুলনা করা যায় মনের বন্ধ দরজার সাথে, আর সেই সাইকোএনালাইসিসের মাধ্যমে ডাক্তাররা রোগীর সেই বন্ধ দরজাগুলো খুলবার চেষ্টা করে যাতে করে রোগীর মানসিক সমস্যা এবং সকল রকমের কনফিউশান কিংবা গিল্টি ফিলিংসগুলোর প্রকৃত সমাধান হয়। সাইকোএনালাইসিস প্র্যাকটিশ হয় এমন একটি হাসপাতাল "Green Manors"।

সেই হাসপাতালের প্রধান ডাঃ মারচিসান অবসরে যাচ্ছেন,আর তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন আরেক বিখ্যাত ডাঃ এডওয়ার্ডস, যিনি সাইকোএনালাইসিসের উপর অনেক বই লিখেছেন। গ্রীন মানোরের সবাই অপেক্ষা করে আছেন তার জন্য। সময়মতো তিনি আসেন, সবাই ভেবেছিলেন বয়সে বেশ পৌঢ় হবেন তিনি, কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখেন এই ডা: এডওয়ার্ডস বয়সে রীতিমতো তরুন। যাই হোক, ঐ হাসপাতালের তরুনী সাইকোএনালিস্ট কনস্টান্স পিটারসন ও ডাঃ এডওয়ার্ডস প্রথম দেখাতেই একে অন্যের প্রেমে পড়ে যান । এভাবে কিছুদিন কেটে যায়, কিন্তু এর মাঝে একজন রোগীর অপারেশানের সময় তিনি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তখন ঘটনাচক্রে কনস্টান্স আবিষ্কার করেন, এই এডওয়ার্ডসের স্বাক্ষরের সাথে তার লেখা বইগুলোর স্বাক্ষর মিলছে না।

তাহলে কে এই এডওয়ার্ডস? এ যদি ইম্পোস্টার এডপওয়ার্ডস হন তাহলে আসল জন কোথায়? কি হয়েছে তার? ঘটনা যেনো সম্পূর্ণ বিপরী্তদিকে মোড় নেয়। আর বিভিন্ন বাঁক আর সাসপেন্সের মাঝে দিয়ে কাহিনী এগুতে থাকে সম্পূর্ন অন্যগতিতে,যার শেষটা রীতিমতো দারুন। মুভিটির প্রথম যেদিকটির কথা বলতে চাই তা হলো, মুভিটির অপূর্ব স্টোরিলাইন আর অসাধারন ডিরেকশানের কথা। মুভিটিতে হিচকক অনেক ডিটেইল কাজ দেখিয়েছেন একেবারে তার মতো করে। আরেকটা জিনিসের কথা আলাদা করে বলতে চাই,আর তাহলো মুভিটির ব্রিলিয়ান্ট মিউজিক স্কোর।

এতোটা মানানসই সাউন্ড মুভিটার সাসপেন্স কিংবা ফ্লোটাকে যেনো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মুভিটির দৃশ্যগুলোর প্রেজেন্টেশান খুবই দুর্দান্ত মানের, কিছু কিছু দৃশ্য আছে যেগুলো মনে প্রচন্ড রকমের দাগ কেটে যায়। সবার আগে বলতে হয়, অনবদ্য সেই ড্রিম সিকোয়েন্সের কথা। আমার দেখা ওয়ান অফ দ্যা মোস্ট আউটস্ট্যান্ডিং সিকোয়েন্স অফ অল টাইম, আর সেই সিকোয়েন্স ডিজাইনের জন্য সালভাডর ডালিকে স্যালুট না জানানোটা রীতিমতো মার্ডার করার মতো ক্রাইম। এইবার আসি মুভিটির কাস্টিং প্রসংগে।

কনস্টান্স চরিত্রে আমার সবচেয়ে পছন্দের নায়িকা ইনগ্রিড বার্গম্যান আর ডাঃ এডয়ার্ডসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দ্যা গ্রেট লিজেন্ড গ্রেগরি পেক। তাদের নামটাই যথেষ্ট আমার অনুভূতিকে বোঝানোর জন্য। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে সবাই বেশ ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, বিশেষ করে ডাঃ আলেক্সান্ডার ব্রুলভের চরিত্রে মাইকেল চেকভের অভিনয় দুর্দান্ত লেভেলের ছিলো। মুভিটিকে শুধুমাত্র একটি মিস্ট্রি থ্রিলার না বলে একে একটা অসাধারন রোমান্টিক মুভিও বলা যায়। সাইকোএনালাইসিসের মাধ্যমে গোটা পাজলটার সমাধান দেখানো হয়েছে,আর সেই সমাধানটি মাস্টার অফ সাসপেন্স খুবই চমৎকার এবং বেশ এন্টারটেইনিংভাবে দেখিয়েছেন।

মুভিতে বোর হবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। হিচককের পরিচালনা নিয়ে কিছু বলবো না, কারন উনি আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক, এই মুভিতে কিছু কিছু দৃশ্যের কথা আমি আলাদা করে বলতে চাই যেগুলো আমাকে শুধু মুগ্ধই করে নি বরং ঐ মানুষটার ভিতরে কি পরিমাণ মেধা আর চিন্তাশক্তি ছিলো তার সিকিভাগ আন্দাজ করতে সাহায্য করেছে, যেমন শেষেরদিকে কনস্টান্স যখন কথা বলতে বলতে হেঁটে ডাঃ মারচিনসানের রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো যেই অ্যাঙ্গেলে সেই দৃশ্যটি দেখানো হয়েছে, ব্লাডি ব্রিলিয়ান্ট!!! এছাড়া গ্রেগরি পেক যখন কনস্টান্সের জন্য নোট লিখছিলো জে.বি লিখতে গিয়ে সেই ছোট্ট পজ দেয়া কিংবা ডাঃ ব্রুলভের সাথে গ্রেগরি পেকের রাতের বেলার সেই কথোপকথনের দৃশ্য এরকম ভুরি ভুরি সিকোয়েন্স রয়েছে, হিচককের তুলনা হিচকক নিজেই। অনবদ্য ক্যামেরা ওয়ার্ক আর সাদাকালো হওয়ায় মুভিটা যেনো একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। মুভিটি সেরা পরিচালক সহ মোট ৫টি ক্যাটাগরিতে অস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং Best Music, Scoring of a Dramatic or Comedy Picture ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে। সেবছরই এই মুভিতে দুর্ডান্ত পারফরম্যান্সের জন্য New York Film Critics Circle Awards এর পুরষ্কার জিতেন ইনগ্রিড বার্গম্যান।

মুভিটির একটা মজার দিক বলি, দুই-তিন সেকেন্ডের জন্য মুভিটিতে হিচককের একটি ক্যামিও দৃশ্য রয়েছে, এইটা হিচককের একটা সিগনেচার স্টাইল যা তিনি নিজের বেশ কিছু মুভিতেই করেছেন। আপনারা দেখুন তো সেই দৃশ্যটা খুঁজে পান কিনা !!! মুভিটির আইএমডিবি রেটিং ৭.৭, আমার মতে এটি অবশ্যই অবশ্যই টপ ২৫০ তালিকায় থাকা উচিৎ ছিলো, আমার পার্সোনাল রেটিং ৮.৫/১০। মুভিটির ডাউনলোড লিংক: Click This Link ***** এবারে পোস্টের বাইরে কিছু ব্যাক্তিগত অনুভূতির কথা বলি। সামুতে আজ আমার এক বছর হতে চলেছে। বিশ্বাস হতে চায় না।

কারন নিতান্তই ঝোঁকের বশে এইখানে একাউন্ট খুলেছিলাম। কখনোই ভাবিনি এতোদূর অবধি আপনাদের এমন ভালোবাসা পাবো। কিন্তু নামের পাশে যখন দেখি সামুতে প্রায় ৯০ টি পোস্ট দিয়েছি,প্রায় আড়াই হাজারের মতোন কমেন্ট পেয়েছি, প্রায় ৩৫ হাজারেরও বেশিবার আমার ব্লগটি দেখা হয়েছে, খুবই অবিশ্বাস্য লাগে নিজের কাছে। এইখানে এসে সবার কাছে এইরকম বন্ধুত্বপূর্ণ রেসপন্স পাবো কখনোই ভাবিনি, আমি কারো নাম আলাদাভাবে বলতে চাইনা,আমি জানি আমাকে আপনারা যারা পছন্দ করেন- আমি যাদের পছন্দ করি তাদের নাম প্রাণেই থাকুক। আমার ব্লগ যাদের ভালো লাগে, যারা নিয়মিত এসে পোস্টে কমেন্ট করেন কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ঢুঁ মেরে যান তাদের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে চাই।

আপনারা আমার জন্য অনেক দোয়া করবেন যেনো আমি আপনাদের সান্নিধ্য সবসময়ের জন্য পাই। আর সবশেষে আরেকজনের কথা বলতে চাই, যে আমার সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে থাকে, আমাকে উৎসাহ দেয়,মন খারাপ হলে যার কাছে ছুটে যাই, আমার ভালোবাসার সেই প্রিয় মানুষটিকে এই পোস্টটি উৎসর্গ করছি। আমার সব ভালো তার জন্য। পোস্ট শেষ করার আগে স্পেলবাউন্ড মুভিটির সেই বিখ্যাত ড্রিম সিকোয়েন্সটা শেয়ার করে গেলাম, ভয় পাবেন না, ঐটাতে কোনো প্রকার স্পয়লার নেই। সবাই ভালো থাকুন, শুভকামনা।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।