মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! ‘রিবেয়েতা ( কারো দৃস্টি আকর্ষন করার জন্য শব্দটা ব্যাবহার করা হয় ) আতক্রিইচে দ্বিভির ’( দরজা খুলুন) জলদগম্ভীর কন্ঠের উচ্চকন্ঠের ডাক সেই সাথে দরজা পেটানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
…ঘুমটা এসছিল জম্পেস! এই শীতে ট্রেনের ঝাঁকুনি যেন অন্দোলিত দোলনা আর কু ঝিক ঝিক ছন্দায়িত শব্দ যেন ঘুম পাড়ানিয়া গান। কম্বল মুড়ি দিয়ে একবার ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলে সহজে ভাঙ্গে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ কচলে অতি কস্টে শরিরটাকে কম্বলের মধ্যি থেকে টেনে বের করে দরজাটা খুলে দিলাম। বন্ধু আমার তখনও ঘুমে অচেতন!
‘শুভ সন্ধ্যা’ ওদের দেখে আমি চমকে উঠলাম ? আবছা আলোয় রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটে বাজে ।
‘আমরা ইমিগ্রেশন পুলিশ। তোমার পাসপোর্টটা বের কর দেখি চেক করব?’
অ এই কথা! আমি তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম এতরাতে পুলিশ দেখে। বন্ধুকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে তুলে ভারী বিছানা উচুতে তুলে অন্ধকার বাংকার থেকে বিশাল ভারী ব্যাগটার চেন খুলে কোমরে বাধার ব্যাগটা বের করলাম।
-এর মধ্যেই আমি আমার যাবতীয় অতি প্রয়োজনীয় কাগজ -পত্তর ছবি পাসপোর্ট খুচরো টাকা পয়সা রাখি । ঘুম চোখেই সেই ব্যাগটা হাতরে পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজটা বের করে আফিসারের হাতে দিলাম।
এরা নিতান্তই অতি ভদ্র পুলিশ। আদব কায়দা যথেষ্ঠ যদিও, বেশ আন্তরিকতার সাথে কথা বলছে তবুও চেহারার দিকে তাকালে ঠাহর হয় মুহূর্তে ওরা ভয়ঙ্কর নিঃশ্বংস হতে পারে।
ওরা হাতে রাখা ছোট্ট টর্চটা জালিয়ে পাসপোর্টের সবগুলো পাতা উল্টেপাল্টে আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। যাক বাবা ঝামেলা হয়নি বাঁচা গেছে!ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন দেশেই তখন ভিসা প্রথা চালু হয়নি। শুধুমাত্র অবৈধ কেউ এই দেশগুলোতে ঢুকে পড়ছে কিনা সেজন্যই রুটিন চেক।
আমি তখনও যেন ঘুমে ঢলে পড়ছি। এমন সর্বনাশা ঘুম এর আগে আমার কখনও আসেনি। বিছানাটা আবার তুলে ধরে ওয়েস্ট ব্যাগটা কোনমতে যথাস্থানে রেখে গা এলাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম !
যথারীতি পরদিন ঘুম থেকে একটু দেরি করেই উঠলাম উঠলাম। পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি চারিদিকে অতিমাত্রায় বরফের ছড়াছড়ি। শুভ্র তুষারে ঢাকা মাঠ ঘাট পাহাড় বনভুমি ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটে চলছে মস্কো অভিমুখে।
আবার চলল গতানুগতিক খাওয়া গল্প আর প্রকৃতি দেখা, খুব বেশী বোর হয়ে পড়লে পুরো ট্রেনে চক্কর দেয়া।
ট্রেন মস্কো গিয়ে পৌছুল রাত আটটা নাগাদ । শীতের দিনে অনেক রাত সন্দেহ নেই।
কিয়েভেস্কাইয়া বোখজালে (ট্রেন স্টেশন) ট্রেন ভিড়লে দুজনে আড়মোড় ভেঙ্গে ধীরে সুস্থে পোষাক আশাক পাল্টে বাংকার ভারী ব্যাগখানা টেনে বের করে কাধে ঝুলিয়ে নেমে পড়লাম । গন্তব্য আমাদের অতিপ্রিয় সেই পুরাতন হোস্টেল (আদপে এটা একটা আবাসিক হোটেল , রুশ ভাষায় বলে ‘ গস্তিনেত্সা’)।
ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের দরজার সামনে ভিড়তেই মনের ভিতর খুশীর হিল্লোল বয়ে গেল!
ইস কতদিন পরে সেই পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। যেন এতদিন পরে মনে পড়ল ওদের কথা। ‘আবার জমবে মেলা’!!!
ট্যাক্সি চালকের উদ্দেশ্যে ন্যায্য ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত কয়েক’শো রুবল বকশিশ ছুড়ে দিয়ে হোটেলে ঢোকার মুখের বরফে মুড়ে থাকা পিচ্ছিল সরু প্যাসেজ পিছলে পার হয়ে বিশাল ভারী পর পর দুখানা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে রিসেপসন কাউন্টারের পাশে কাধের বোঝানামিয়ে রেখে হালকা করে হাঁপ ছাড়লাম ।
রিসেপসন কাউন্টারের ওপাশে দাড়ানো ম্যানেজার মহিলা অমায়িক হেসে আমাদের স্বাগত জানাল ’
‘শুভ সন্ধ্যা । অনেক দুর থেকে আসলে মনে হচ্ছে? ’
‘ শুভ সন্ধ্যা ।
হা .. অনেক দুর থেকে বৈকি সেই সুদুর মালদোভিয়া থেকে আসছি ’।
ভদ্র মহিলা দুচোখ কপালে তুলে বললেন ‘আ ঈশ্বর আমার!’ সেতো অনেক দুরে-নিশ্চই তোমরা খুব ক্লান্ত? নতুন রুম নিবে নাকি তোমাদের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবে?’
‘নতুন রুম । আটতলায় কোন রুম খালি আছে । ’
‘হু, একখানা, সিঙ্গেল। চলবে।
’
‘চলবে। চাবি দিন?’
তিনি স্মিত হেসে রেজিস্টার বই বের করে বললেন ‘ কদিন থাকবে? পাসপোর্ট দাও?’
আমি পকেট হাতরাতে হাতরাতে বললাম ‘ঠিক নেই মাস পেরিয়ে বছরও হতে পারে। ’ ততক্ষনে আমার বন্ধু তার পাসপোর্ট খানা বের করে টেবিলের উপর রেখেছে । মহিলা সেটা মেলে ধরে রেজিস্টার খাতার উপর ঝুকে তার নাম এন্ট্রি
করছেন ।
আমার কুঞ্চিত কপালে ততক্ষনে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।
কোন পকেটেই পাসপোর্ট নেই। কোথায় গেল?
কিছু একটা মনে পরায় পরক্ষনেই ঠোটের কোনে- মৃদু হাসি খেলে গেল। মনে মনে নিজেকে গাধা বলে গালি দিলাম।
দু-পা এগিয়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে ট্রাভেল ব্যাগের চেন খুলে ভিতরে উঁকি দিতেই বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে উঠল! আমার ওয়েস্ট ব্যাগখানা নেই - ভাবলাম হয়তো কাপড়ের নিচে চাপা পড়ে আছে। পুরো ব্যাগ আঁতিপাতি করে খুজলাম... নাহ নেই নেই কোথাও নেই! মনকে প্রবোধ দিয়ে নতুন করে ভাবতে বসলাম?
ম্যানেজার ভদ্রমহিলা খোলা কলম হাতে নিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে দেখছে আমার কান্ড! সঙ্গী বন্ধু আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই কিছু একটা মালুম করে দ্রুত হাতে আমার ব্যাগখানা গোড়া থেকে খুজতে শুরু করল।
সেখানে কিছু না পেয়ে অগত্যা নিজের ব্যাগের ভিতরেই হাতরাতে থাকল ‘যদি ভুলে ওখানে রেখে থাকি-এই ভেবে। '
মিনিট পাঁচেক বাদে খোজাখুজি ক্ষান্ত দিযে আমার দিকে হতাশ দৃস্টিতে তাকাল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভালভাবে উপলদ্ধি করলাম আমার সর্বনাশ!
দ্বীতিয় খন্ড দ্বীতিয় পর্ব শেষ।
আগের পর্বের জন্য;
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।