মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! মিনিট দুয়েক বাদেই তারা ফিরে এসে তাড়াহুড়ো করে আমাদের টয়লেটে ঢুকতে বলল। আমাদের ফের আতংকিত হবার পালা! এবার তাহলে কি হবে। এতক্ষন তবুও হাত মুখ বাধা থাকলেও দেখতে পাচ্ছিলাম- পুলিশরুপী দুই তস্করের কান্ড! এবার সেটার দ্বারও রুদ্ধ হল।
টয়লেটে গিয়ে ঢুকতেই তারা সতর্ক করে দিল, ‘কোন রকম শব্দ করা চলবে না। ’
দরজাটা টেনে বাইরে থেকে কি দিয়ে যেন শক্ত করে আটকে দিল।
জীবনের প্রথম এবং শেষবারও সম্ভবত একসাথে দু’জন কমোডে বসেছিলাম!
অসহায় আমরা দু’জন সেখানে বসে অনুভব করলাম লুন্ঠন প্রক্রিয়া। বন্ধু আমার আতঙ্কিত দৃস্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমারও অবস্থা তথৈবচ!
এমুহূর্তে ও যেটা নিয়ে শংকিত আমিও আতংকিত সেই একই ব্যাপারটা নিয়ে। দু’জনের মনে একই ভয় পাসপোর্ট নিয়ে। ওটা নস্ট করলে বা বাইরে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলে সব শেষ।
আমার রুমমেট খসখসে পেপার লাগানো দেয়ালে মুখ ঘসে সে কান রকমে স্কচ টেপ খানিকটা সরিয়ে অসাড় ঠোট দিয়ে বিকৃত উচ্চারনে জোড়ে চেঁচিয়ে বলল ‘দয়া করে পাসপোটটা রেখে যেও। ’
অল্প কয়েক মিনিট মাত্র…মনে হচ্ছিল কয়েক সহস্র দিন ধরে বসে আছি এখানটায়। প্রতি সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের অস্তিত্বও টের পাচ্ছিলাম। একজন মানুষের জীবনে কত শত মিনিট ঘন্টা দিন কেটে যায় এমনিতেই। কোন ঘটনা-দূর্ঘটনার অনুসঙ্গ নয় বলেই সময়টুকু আমাদের কাছে অতি মুল্যহীন।
সেখানে বসে ভাবছিলাম আচমকা কয়েকটা মূহুর্তমাত্র একটা মানুষের জীবন কতটা পাল্টে দিতে পারে।
টুকটাক আর খুট খাট আওয়াজ আর দু’জন মানুষের ভারী পায়ে এদিক ওদিক চলাফেরা থেমে যেতেই বুঝতে পারলাম ওরা চলে গেছে!
প্রায় অন্ধকার টয়লেটে শব্দহীন প্রকৃতিতে নিঃসঙ্গ আতংকিত কিংকর্তব্য বিমুঢ় অসহায় দু’জন মানুষ বসে আছে। তারা জানেনা ক্ষনকাল আগে এই ভীষন রকমের বস্তুগত জীবনের গচ্ছিত কি অমুল্য সম্পদ হারিয়েছে?
তবুও ওই দু’জন মানুষের কাছে এ মূহুর্তে পৃথিবীর অন্য যে কোন কিছু থেকে পাসপোর্টটা অনেক বেশি মুল্যবান।
ওরা চলে গেছেএই ভেবে সস্তি পেতই ফের আতংকিত হবার পালা। এখন এখান থেকে বের হই কেমনে? কি সর্বনাস! ওরা কি করে গেল তা চোখে না দেখলে যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না।
হাতটা বেঁকিয়ে এদিক ওদিক মোচড়াতেই টেপের আঠালো নরম বাধন খুলে গেল। মুখের টেপ ওঠাতে গিয়ে মনে হল চামড়া ছিড়ে যাচ্ছে। প্রথমেই দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। অনেক্ষন শক্তি ক্ষয় করে মনে হল, বাইরে থেকে সাহায্য না পেলে আমাদের সাধ্য নেই এ দরজা খেলা।
তাহলে উপায়? সদ্য বাধন থেকে মুক্ত দু’বন্ধু এখন পরামর্শে বসলাম কি উপায়ে বেরুনো যায়।
ওখানকার বেশীর ভাগই টয়লেট ও বথরুমকে বিভক্ত করে মাঝে একটা দেয়াল তোলা থাকে- তবে আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে এই দেয়ালের মাথার কাছে অনেকটা জায়গা কাঁচ দিয়ে ঘেরা।
কমোডের উপর দাড়ালে ওটা নাগালে আসে।
নাগালে না হয় আসল কিন্তু এখন এটা ভাংগি কি করে?
দু'জনে আলোচনা করে সামান্য ঝুঁকি নিব বলেই স্থির করলাম। আঠালো টেপগুলো মেঝে থেকে কুড়িয়ে একসাথে করে ডান হাতে ভালমত পেঁচিয়ে কমোডের উপর দাড়িয়ে আলতো করে ঘুষি মারলাম। সেই সময়ের জন্য ভাগ্য আমাদের প্রতি সদয় হল, কোন রকম চোট ছাড়াই সামান্য আঘাতেই সেটা ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ল।
ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো গুলো ওখান থেকে সরিয়ে বন্ধুর কাঁধে চড়ে অনেক কস্টে হাঁচড়ে -পিচড়ে সেই অপরিসর ফাঁক গলে বাথরুমে ঢুকলাম। কয়েক জায়গায় খানিকটা কেটে-ছিড়ে গেলও মুক্তির আনন্দে সব ভুলে গেলাম।
বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে বন্ধুর কথা ভুলে প্রথমেই দৌড়ে গেলাম ছোট রুমটার দিকে। টেবিলের উপর তাকাতেই আত্মায় পানি এল। আঃ !পাসপোর্ট দুটো অতি অবহেলায় পড়ে আছে এখানে।
যাক বাবা বড় বাঁচা বেঁচে গেছি !
বন্ধু আমার বন্ধ টয়লেটের ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে জানতে চাইছে পাসপোর্ট ঠিক আছে কিনা!আছে; বলে আমিও চেচিয়ে তাকে শান্ত করলাম। সে যেন শোনা কথায় বিশ্বাস করছিল না।
টয়লেটের দরজা বাইরে থেকে শক্ত দুটো চেয়ার দিয়ে দেয়ালের সাথে এমনভাবে আটকেছে যে, দুজন কেন পঞ্চাশজন লোক-ও এই দরজা খুলতে পারত না(অপরিসর সেই টয়লেটের দরজার পাল্লাটা বাইরের দিকে খুলতে হত। )
টেনে টুনে চেয়ারদুটো সরিয়ে টয়লেটের দরজা খুলতেই সেও আমার মত হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে গেল সেদিক পানে যেখানটায় পাসপোর্ট ছিল।
ফিরে আসল মুখে একরাশ প্রশান্তি নিয়ে।
আমাদের ফ্লাটের মুল দরজাটা হাট করে খোলা। মানবিক মুল্যবোধসম্পন্ন ডাকাতরা বুদ্ধি করে দরজা খুলে রেখে গেছে! ওরাও জানে এ দরজা একবার চাপালেই অটমেটিক লক হয়ে যাবে বাইরে থেকে চাবি ছাড়া আর খোলা সম্ভন না। এ দরজা ভাংতে বুলডোজার ডাকতে হবে।
ওরা ভেবেছিল হয়তো আমরা আর বাইরে বেরুতে পারবনা। আমাদের প্রতিবেশী বা শুভাকাঙ্খী এসে যাতে উদ্ধার করতে পারে সেজন্যই ওরা এভাবে কপাটটা খোলা রেখেছে।
পাসপোর্টের ধাক্কা সামলে উঠে এবার অন্য জিনিসের শোক উথলে উঠল!
ঘরের মধ্যে সবকিছু ওলট পালট করা। সারাঘর তন্ন তন্ন করে খুজে একটি টাকাও পেলামনা। সব ঝেড়ে পুছে নিয়ে গেছে।
শুধু টাকা পয়সা সোনা দানা নয় আমাদের সব ভাল ভাল পোষাক আর দামী ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলো পর্যন্ত ওরা নিয়ে গেছে! পোষাক ও যন্ত্রপাতিগুলো আমার নতুন একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে গেছে।
তাড়াহুড়ো করে খালি না করায় সেই ব্যাগের সাথে আমি এমন কিছু হারালাম যা টাকার বিনিময়ে এজীবনে আর পাওয়া সম্ভব নয়!
টেলিফোনের রিসিভার তোলা ছিল।
সেটা আবার যথা স্থানে রাখতেই ফোন বেজে উঠল । তুলতেই ভেসে এল এক রুশ রমনীর কন্ঠ ‘সের্গেই আছে?’
ভীষন ক্লান্ত বিধ্বস্ত কন্ঠে আমি বললাম‘স্যরি সের্গেই নামে কেউ এখানে থাকেনা। ’
রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই মনে হল মেয়েটা যেন হাসল। আবার ফের কানে তুলতেই ওপাশ থেকে রিসিভার রেখে দেয়ার শব্দ পেলাম। (আমার কেন যেন মনে হল ওরা কনফার্ম হতে চাইছিল আমরা বেরিয়েছি কিনা? কিংবা কোন অঘটন ছাড়াইওদের লুটপাট শেষ হয়েছে কিনা?)
মিনিট খানেক পর আবার ফোন।
ক্লান্ত হাতে রিসিভার তুলে বললাম ‘হ্যালো। ’
‘কি ব্যাপার এতক্ষন টেলিফোন ব্যাস্ত ক্যান?’ আমার খুব ঘনিস্ট বন্ধু একজন গতরাতে একসাথে ছিল ।
‘আনিস ভাই একটা অঘটন ঘটে গেছে। ’
‘কি হইছে?’ তার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর। সে এতক্ষনে বুঝে গেছে বড়সড় কোন অঘটন ঘটে গেছে।
আমি চেস্টা করলাম সংক্ষেপে ঘটনাটা বলতে। বলতে কস্ট হচ্ছিল ‘শারিরিক ও মানসিক ভাবে তখন আমি ভীষন ক্লান্ত!’
‘পুলিশকে বলবেন?’
আপনার কি মনে হয় বলা উচিত?
সে একটুক্ষন চিন্তা করে বলল ‘যা গ্যাছে গ্যাছে এই নিয়ে পুলিশের ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই। বোঝেনইতো মস্কোর পুলিশ।
বাঘে ছুলে আঠার ঘা দেশের পুলিশে ছত্রিশ আর মস্কোর বাহাত্তর।
...................................................... প্রথম খন্ড শেষ।
ফুটনোট: প্রিয় ব্লগার, 'কাগদা তো-ভ রাশিয়ার' প্রথম অংশ পাঁচ পর্বে শেষ করলাম।
রাশিয়ায় আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব অঘটনের ক্ষুদ্রতম অংশ ছিল মাত্র!
ব্লগার পাঠকদের পড়ার আগ্রহ থাকলে বাকি পর্বগুলো খুব শিঘ্রই প্রকাশ করব বলে আশা রাখছি। আমি দারুনভাবে কৃতজ্ঞ সেই সব ব্লগার বন্ধুদের প্রতি যারা সমসাময়িক ঘটনার বাইরে খানিকটা অন্যরকম বিষয় নিয়ে লেখালেখির জন্য আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
আগের পর্বের জন্য; Click This Link
প্রথম পর্বের জন্য;
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।