আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-৬(দ্বীতিয় খন্ড প্রথম পর্ব)

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! তখন আমি মলদোভিয়ার ‘কৃষিনেভে’ ছিলাম(‘আলকাশ’ কাহিনীর সুত্রপাত যে শহরে। আগের ঘটনাটা ঘটবার ছ’বছর আগের কথা। ) শহরটাতে অল্প কিছু বাঙ্গালী থাকায় সবার মধ্যেই যথেস্ট আন্তরিকতা ছিল। প্রতি সপ্তাহেই দু’য়েকটা দাওয়াত থাকত। বউ বাচ্চা কারো নেই-বেশীর ভাগই ব্যাচেলার বিধায় গিফট নেয়ার ঝামেলা নেই।

বাবলু ভাই দাওয়াত দিয়ে হয়তো বলতো, আসার পথে আধাকেজি পিয়াজ কিংবা এক কেজি ডাল নিয়ে এস। কখনো পোয়াষ্টেক মাখন বা দু’খানা মুর্গী। ব্যাস ওটুকুই। সস্তার দেশে গায়ে লাগেনা! কখনও বা এমনিতেই বাজার সদাই নিয়ে হাজির হতাম কারো বাসায়। একসাথে রান্না করে হৈ হুল্লোড় করে খাব বলে - সাথে চলবে কার্ড খেলা আর বরারবরের মত জম্পেস আড্ডা।

পকেটে পয়সার টান থাকলে এমনিতে গিয়েই সিন্দাবাদের ভুতের মত ঘাড়ে চেপে বসতাম! তবে কেউ কখনই নাখোশ তো হতই না উল্টো খুশীতে যেন ফেটে পড়তে চাইত। বিদেশ বিভুঁইয়ে কাজকর্ম সেরে আড্ডার নেশায় ডুবে যেতে কেনা চায়? ছোট্ট এই কৃষিনেভ শহরে রিক্রেয়েশনের এত বেশি অভাব ছিল যে,নিজেদের মধ্যে আড্ডা না মেরে উপায় ছিলনা। আচমকা জরুরী কাজে মস্কোতে ডাক পড়। ব্যাপারটা এতটাই সিরিয়াস ছিল যে, কোনরকম তালবাহানা করার উপায় ছিলনা। তবে সুখের বিষয় যে'আমার মতই বাধ্য হয় আমার সাথে বাধ্য হয়ে জুটে গেল আরেক হরিহর আত্মার বন্ধু।

বড় কষ্ট হয়েছিল সেবার ওই শহরটা ছেড়ে আসতে। মোটোর উপর দশ-বারজন থেকে দু'জন কমে যাওয়ায় ওরাও মনে হয় কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়েছিল। তাইতো বিদায় দিতে সবাই মিলে ষ্টেশনে এসে উপস্থিত হল। কিষিনেভ থেকে মস্কো প্রায় দু'দিনের ট্রেন জার্নি। দু’বন্ধু মিলে প্রথম শ্রেনীর কুপে একটা বুক করে আয়েশ করে চড়ে বসলাম।

একা একা এই ভ্রমনটা ভীষন রকমেরএকঘেয়ে। কিন্তু বন্ধুটা সাথে থাকায় ঘুম গল্প আর প্রকৃতি দেখে একটু ধীরে হলেও সময়টা কেটে যাবে সাচ্ছন্দে! খুব বেশী বিরক্তিবোধ হলে সারাট্রেন ঘুরে ফিরে ভ্রমনরত যাত্রীদের দেখার পছন্দতো রইলই। খাবার-দাবারে সমস্যা নেই। বুফেতে বললে ঝটপট এসে হাজির হবে যখন যেটা চাই। রান্না যে খুব একটা আহামরি তা নয় তবে এ দু’বছেরে এদের দেশীয় খাবারে অভ্যাস্ত হয়ে গেছি।

অন্য কিছু মুখে না রুচলে চা-পাউরুটি আর ডিম সেদ্ধতো আছেই। ট্রেনে উঠে দৃস্টির সীমাবদ্ধতা দিয়ে শেষবারের মত চারিদেকে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিলাম। জানিনা এই শহরে আবার আসা হবে কিনা? ছোট্ট এই শহরটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম। হয়তো এ শহরে আর কোনদিন ফিরে আসবনা। বেশ অনেকগুলো দিন এখানে ছিলাম।

কত স্মৃতিই না জড়িয়ে আছে আস্টেপৃস্টেইে শহরটাকে ঘিরে। বন্ধুরা বিষন্ন মুখে ক্লিস্ট হেসে হাত নেড়ে বিদায় দিল। বিদায় বন্ধু আবার দেখা হবে। হাত তুলে ওদের বিদায় দিলাম। শেষ মুহুর্তে আবেগের অতিশয্যে হুলস্থুল নয় মোটেও একটু রয়ে-সয়েই দু'চার ফোঁটা জল্ অক্ষিগোলকের মায়া ছেড়ে এদিক ওদিক গড়িয়ে পড়ল।

তীক্ষ হুইসেল দিয়ে বিশাল ট্রেনখানা আড়মোড় ভাঙল! ট্রেন চলছে দুরন্ত গতিতে । জানালার পর্দা টেনে দু’বন্ধু গল্পে মশগুল। এমনিতেই আমরা প্রায় সারাদিন একসঙ্গে আড্ডা দেই। তবুও কথা যেন ফুরোয় না। তবে আজকের গল্পের মুল বিষয়বস্তু ছিল কৃষিনেভে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারন।

ঘন্টা দু’য়েক পর খিদে লাগলে ট্রেনের স্টুয়ার্টকে ডেকে মাখন রুটি আর চায়ের অর্ডার দিয়েছি। গল্প করতে করতে রাত গভীর হলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত বিছানায় গড়া গড়ি দিয়ে নাস্তা সেরে দুজনে মিলে বের হয়ে সারা ট্রেন টহল দিয়ে নিজেদের বগিতে এসে মাঝ বয়েসি মহিলা স্টুয়ার্টের সাথে গল্প জুড়ে দিলাম দুপুর তক। লাঞ্চ সেরে প্যাসেজে গিয়ে দাড়িয়ে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে যাত্রীদের যাওয়া আসা দেখলাম। এক সময় ট্রেন কিয়েভে এসে পৌছুল।

কিয়েভের সুবিশাল স্টেশনে নেমে আশে পাশে ঘুরে ফিরে দেখে এদের আর্থিক সামাজিক বর্তমান অবস্থাটা অনুভব করার চেস্টা করলাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর সব শহরেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা প্রকট ভাবে চোখে পড়ে। ডলারের বিপরিতে এদের মুদ্রার অস্বাভাবিক অবমুল্যায়ন ঠেকিয়ে রাখার কোন পথ এদের জানা নেই। দ্রব্যের উচ্চমুল্য অনেক আগেই মধ্যবিত্তের নাগালের সীমা অতিক্রম করেছে এখন ধনীদেরও নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম! সরকার ও কালোবাজারীরা একইসাথে লক্ষ কোটি কুপন( ইউক্রেন তখন রুবলের পরিবর্তে তাদের স্থানীয় অর্থের নাম দিয়েছিল) ছেপে বাজার সয়লাব করে দিয়েছে । আসল আর নকল মুদ্রার পার্থক্য করা মুশকিল-কেননা একেতো সস্তা কাগজ তার উপরে ছাপা অতি নিন্মমানের।

আমাদের গলির মোরের ছাপাখানাও এর থেকে উঁচুমানের টাকা ছাপাতে পারবে। (এই নিয়ে রুস্কাইয়া ব্লুদা’র এক পর্বে লিখেছিলাম)একডলারে পাওয়া যায় ত্রিশ পয়ত্রিশ হাজার কুপন । সাধারন লোকের সৎভাবে টাকা আয়ের কোন পথ নেই । সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর কলকারখানা গুলোতে চাকরিরত স্থানীয় অধিবাসীরা বছর খানেক বেতন ভাতা পায়না কবে পাবে তারও নিশ্চয়তা নেই। এরা জানেনা ব্যাবসায়ের পলিসি ছলচাতুরী।

কৃষিকাজ আর সরকারী চাকুরী ছাড়া অন্য কোন উপায়ে টাকা কামাই করা যায় এটা এদের জানা নেই। যে ক’জন জানে এ মুহুর্তে সবকিছুই তাদের হাতের মুঠোয় । অর্থনৈতিক এহেন দুরবস্থায় শহরতো বটেই গ্রামগঞ্জ থেকেও মানুষ তাদের মুল্যবান মুল্যহীন সবকিছুই নিয়ে ছুটে আসছে বাজারে বিকোবে বলে। ক্রেতার সাথে কি ভাবে দরাদরি করতে হয় তাও এদের জানা নেই। আমরা রাস্তা ঘাটে ঘুরে ঘুরে এদের বোকামী দেখি আর হেসে গড়াগড়ি যাই।

যুবতীরা ছুটে যাছে দেশ থেকে দেশান্তরে নিজের যৌবনের চটক বিলিয়ে দুটো পয়সা ঘরে আনতে। মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে অন্য কারো আমানতে রেখে বেরিয়ে পড়ছে ওই একই পথে। আর যুবকরা চরম আক্রোশে অর্থবান সামর্থবানদের কাছ থেকে তাদের শক্তি ক্ষয় করে সবকিছু ছিনিয়ে নিতে চাইছে। প্রায়শই এদের আক্রমনের লক্ষ্য বস্তু হচ্ছি আমরা দুর্বল বিদেশীরা। টাইসনের আদলে দুটো পাঞ্চ কষলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে পকেটের সবকিছু বের করে দেই।

সবাই যেন কেমন উৎভ্রান্ত দিকভ্রান্ত! কিয়েভ থেকে মস্কো যেতে প্রায় ছাব্বিস ঘন্টার মত লাগে। ট্রেন চলছে মস্কোর পথে । দু বন্ধু রাতের খাবার খেয়ে গল্প করতে করতে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ‘রিবেয়েতা ( কারো দৃস্টি আকর্ষন করার জন্য শব্দটা ব্যাবহার করা হয় ) আতক্রিইচে দ্বিভির ’( দরজা খুলুন) জলদগম্ভীর কন্ঠের উচ্চকন্ঠের ডাক সেই সাথে দরজা পেটানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল! ...প্রথম পর্ব সমাপ্ত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।