মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! এমাসের টেলিফোন বিলটা বড্ড বেশী এসেছে । বিলটা হাতে পাবার পর দুশ্চিন্তায় অনেক্ষন ঝিম মেরে বসে ছিলাম।
গত মাসেরও বিলটা দেয়া হয়নি, দু’মাস মিলিয়ে প্রায় ন’শ ডলার । আমার রুমমেট বন্ধু ডিসিসান নিয়েছে বাসাটা এমাসেই ছেড়ে দিবে।
দুজনের জন্য এতবড় বাসার কোন প্রয়োজন নেই।
আমিও তার সাথে একমত । সেহেতু বাসা ছাড়ার আগে বিল-টিল সব চুকিয়ে ফেলতে হবে । ইস এতগুলো টাকা হাত গলে বেরিয়ে যাবে ভাবতেই কস্ট হচ্ছে।
সামনের মাস থেকে হিসেব করে চলতে হবে। নিজের মনে শপথ করলাম মাসে চারবারের বেশী ওর সাথে কথা বলবনা।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একবার ফোন ধরলে সে ছাড়তে চায়না।
অবশ্য কথা বলতে আমারও বেশ লাগে কিন্তু বিলের কথা ভাবলেই বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে, চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে বলতেও পারিনা যে টেলিফোন রাখি!’
-তাহলে ও কি ভাববে?
-আমি কৃপন কিংবা আমার ভালবাসা কমে যাচ্ছে? অসম্ভব এটা আমি বলতেই পারিনা!
...কাল বাসা ছেড়ে দিচ্ছি -। সব বাধাছাদা প্রায় শেষ। বিলটা এ’কদিন দিব দিব করে দেয়া হয়নি ।
কি আর করার কাল সকাল সকাল দিতে হবে কিংবা বাড়িওয়ালী বুড়ির কাছে বুঝিয়ে দিব।
এ বাড়িতে শেষ দিনটা ইচ্ছে মত উপভোগ করার জন্য বন্ধুদের আসতে বলেছি। সারারাত জম্পেস আড্ডা হবে। বাজার সদাই থেকে শুরু করে রান্না বান্না ওরাই করবে। আমরা ঝাড়া হাত পা।
প্রবাসে ব্যাচেলারদের বাড়িতে সব বন্ধুরা একত্রিত হলে গেস্ট-হোস্ট বোঝার উপায় থাকেনা।
সন্ধ্যে থেকেই বন্ধুরা এক এক করে আসতে শুরু করল। সবাই আগে থেকে ফোন করে বলেছে যে কখন আসবে। ডোর বেলের আওয়াজ হলেই আমরা বুঝতে পারি কে এসেছে। তাছাড়া আমরা ডোরবেলের মাধ্যমে কিছু সংকেত ব্যাবহার করি। যেগুলো এই ভয়ঙ্কর শহরে আমাদের নিরাপত্তার জন্য জরুরী।
একবার বেল বাজালে বুঝতে হবে সাথে পুলিশ আছে। দুইবারে হুলিগান কিংবা অবাঞ্চিত কেউ। তিনবারে নির্ঝঞ্জাট।
চারবারে আরো ভয়ঙ্কর কিছু । আগে থেকে সময় জানিয়ে রাখা, তার পরে তিনবার বেল বাজলেও আমরা নিশ্চিন্ত হইনা যে সেই এসেছে।
পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে আতি সর্ন্তপনে ... চোখ রেখে দেখি কে?
অনেক্ষন নিরিখ করি তার চেহারায় কোন চাপা উত্তেজনা আছে কি। আতি কস্টে এদিক ওদিক চোখ চোখ ঘুরিয়ে লক্ষ্য করি আশেপাশে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা?
সেখানেই শেষ-নয় আরো বেশী নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সে বন্ধুর সাংকেতিক নাম ধরে মৃদু স্বরে ডাকি? সে যদি বাংলা য়উত্তর দেয় তাহলে সমস্যা নেই কিন্তু রুশ ভাষা বললেই বুঝি 'ডালমে কুছ কালা হ্যায়। '
এরপর শুরু হয় দরজা খোলা পর্ব। প্রথমে ভারী লোহার দরজাখানা খান তিনেক চাবি দিয়ে ঘুরিয়ে পেচিয়ে খুলে সেফটি লক আটকানো অবস্থায় অপ্রসর ফাক দিয়ে হাত গলিয়ে বাইরের দরজা খুলি । বন্ধুর হাসিমুখ দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সেফটি লকে হাত দেই।
ভিতরে ঢুকে সে যেন হাফ ছেড়ে বাচেঁ। তবে কেউ বিন্দুমাত্র রাগ করেনা । কেননা এমন সিস্টেমে সবাই অভ্যস্ত । অনেকের বাসায়তো কোন বহিরাগত, সে যত ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোকনা কেন প্রবেশ নিষিদ্ধ! আবার কেউ আগে থেকে ফোন করে সময় ও সংকেত না জেনে নিলে বন্ধ দরজার ওপাশে দাড়িয়ে সারাদিন মাথা কুটলেও সেটা খুলবে না। সে তুলনায় আমরা একটু কেয়ারলেস!
রাত আটটা বাজতেই রান্না বান্না খানা-পিনা তাস খেলা সরস গল্প ফোক গান হৈ-হুল্লোড় আর হাসি-ঠাট্টায় জমে উঠল আড্ডা ।
ফাকে ফাকে চলল স্মৃতি চারন । এর আগে কতবার এখানে আড্ডা হয়েছে কোনটা জমেছে সবচেয়ে বেশী তখন কে ছিল এখন কে নেই এসব নিয়ে । তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করছিল আজকেরটার মত নাকি কখনই জমেনি। ভাবলাম শেষবার বলেই হয়তো।
তখুনি বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল।
রাতটা পোহালেই গাট্টি-বোচকা কাধে নিয়ে চলে যেতে হবে অন্য কোন নতুন আলয়ে। আবার কি জমবে মেলা সেই হাটখোলা বটতলাতে। মনের ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল কোরাশ সেই গান ‘আবার জমবে মেলা হাটখোলা বটতলা। ’
কেউ কি জানবে কখনো কতগুলো বঙ সন্তান তাদের দেশে পোতা নাড়ীর বন্ধন কেটে এই ঘরটাতে বসে মেতে উঠেছিল হাসিঠাট্টা গানে গল্পে? কেউ কেদেছে নিঃশব্দে কেউ উচ্চস্বরে! কেউবা নতুন সপ্নের জাল বুনেছে-কেউ ভেঙ্গে যাওয়া সপ্নগুলোকে জোড়া লাগাতে ব্যাস্ত থেকেছে। কত দুরন্ত প্রেমের শুরু আর সমাপ্তি হয়েছে এখানেই!
ওই যে টেলিফোনটা হাজার হাজার মাইল দুর থেকে বয়ে এনেছে কত সুসংবাদ।
কখনোবা প্রিয়জনের মৃত্যুর মত দুঃসংবাদ!
খবর পেয়ে তখুনি ছুটে যেতে পারিনি অন্ধ আক্রোশ আর তীক্ষ্ণ ক্রদন চার দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে নিজেকে আরো বেশী কস্ট দিয়েছে । প্রিয়তমার কন্ঠে কতরাত আপ্লুত হয়েছি কতনা সপ্ন দেখেছি কিংবা রঙ্গীন সপ্নের জাল বুনেছি।
‘আর মাত্র কটা মাস অপেক্ষা কর তারপরই ব্যাস...... । ’সেই কটা মাস আর শেষ হয়না। মাস গড়িয়ে বছর গেল কত।
কখনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ঝগড়া , আবার পরক্ষনেই গলা জড়িয়ে ধরে উচ্চ স্বরে গান গাওয়া । কিংবা ঘনিস্ট জনের কথা মনে করে কারো কান্না তাকে সান্তনা দিয়েছি নিজের দুঃখ বুকে চেপে । কেউ জানবেনা বা জানতে চাইবেনা আমাদের স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়া সেই দিনগুলোর কথা।
রাত প্রায় দুটো বাজে কিন্তু কারো ক্লান্তি নেই! রাত্রি যেন সবে তার যৌবনে পদার্পন করল। সবাই চাইছে গানে গল্পে কেটে যাক সারাটা রাত।
আমরাও এর ব্যাতিক্রম নই । ..আচমকা তারস্বরে ডোরবেল চেচিয়ে উঠল । যেন বিদ্যুত বয়ে গেল আমাদের দেহে , এক লহমায় সবাই চুপ। প্রথমে ভেবেছিলাম শোনার ভুল কিংবা কেউ ভুল করে বাজিয়েছে। কিন্তু পরক্ষনেই আবার ঘন ঘন দুবার বেজে উঠতেই সবার মুখ শুকিয়ে গেল ।
ভয়ার্ত চোখে নিঃশব্দে এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। পরক্ষনেই সাহসী দুয়েকজন নিজেদের সামলে নিয়ে শর্ট মিটিংয়ে বসল ‘কি করা যায় ?
গুরুত্বপূর্ন মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত হল দুজন গিয়ে প্যাসেজের লাইট অফ করে প্রথমে দেখবে কে এসছে । আমাদের অন্য কোন বন্ধু যদি গভীর রাতে আমাদের ঘাবড়ে দেয়ার জন্য ফাজলামী করে তাহলে এককথা- আর যদি অপরিচিত কেউ হয় তাহলে কোন মতেই দরজা খোলা হবেনা । পারলে দরজা ভেঙ্গে ঢুকবে।
দুজনে এগিয়ে প্যাসেজ ধরে দরজা অভিমুখে ।
সামান্য ক্ষন পরে তারা ফিরে এসে ফিসফিস করে আতংকিত কন্ঠে বলল ‘মিলিশিয়া'(পুলিশ)
‘অ্যা ক‘জন ?
ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না মনে হয় ‘দু’জন।
...১ম পর্ব শেষ
পরের পর্বের জন্য;
Click This Link
ফুটনোটঃ 'কাগদা তো-ভ রাশিয়া'র ইংরেজী অনুবাদ 'Once upon a time in Russia' আর সহজ বাংলায় হবে হয়তো 'কোন একদিন রাশিয়ায়।
অফটপিকঃ'আলকাশ' গল্পের আপাতত বিরতি। পরে কোন একসময় বাকি গল্পটুকু বলব। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।