এখানে পিকেটার ভাড়া পাওয়া যায়!
জব্বার আলী এখন পিকে জব্বার নামেই বেশি পরিচিত। গাড়ির ব্যবসা ছিল তার। বেশ রমরমিয়ে চলছিল সে ব্যবসা। ৮টি বড় বাস, ১০টি মাইক্রোবাস ও ৬টি প্রাইভেট কার ছিল। এগুলো ভাড়া দিয়ে তার মাসিক আয় ছিল কয়েক লাখ টাকা।
কিন্তু ব্যবসায় মন্দা আসতে বেশি সময় লাগলো না।
দেশের পরিস্থিতি বদলেছে, বদলেছে আব্দুল জব্বারের ব্যবসাও। গাড়িগুলোর কোনোটা এখন ভাঙাড়ির দোকান, কোনোটি গ্যারেজে পড়ে রয়েছে। কিন্তু ব্যবসা তো চালানো চাই।
তামাটে রঙের আঁটসাঁট বলিষ্ঠ শরীরের জব্বার সাহসীও বটে।
খাঁটি ব্যবসায়ী মেধা তার। গাড়ির ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলি। সন্তানের মতো যত্ন করা গাড়িগুলোর কঙ্কালসার দেহ দেখতে মোটেও ভালো লাগে না জব্বারের। দেশের পরিবর্তমান পরিস্থিতির অসহায় শিকার তার গাড়ি। হরতাল-অবরোধে রাস্তায় চলা গাড়িগুলোকেও মৃত মনে করে যেন শ্মশানে পুড়িয়ে কঙ্কালসার করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন হরতাল-অবরোধের পক্ষের শক্তি।
এরা পিকেটার হিসেবেই বেশি পরিচিত।
বুদ্ধিমান জব্বার আলী দেখলো গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর যখন তার বুক ফেটে যায় কান্নায়, ঘামে শরীর ভিজে হয় নিস্তেজ, ক্রোধে চোখজোড়া হয় কুকো পাখির মতো রক্তাভ তখন পিকেটাররা উল্লাসে ফেটে পড়ে, বুক উঁচিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করে। জব্বার এই উল্লাস পুঁজি করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো অন্যভাবে। মুহূর্তেই তার মাথায় এলো ব্যবসার নতুন প্লট।
যে কোনো কাজে উৎসাহটাই বড় কথা এটা নিজেকে দিয়েই প্রমাণ পেয়েছেন জব্বার।
আর সঙ্গে যদি থাকে অদম্য সাহস, তাহলে তো কথাই নেই!
জব্বার সাহেব ভালো পর্যবেক্ষণ করেছেন গাড়ি, দোকান ভাঙচুর, ট্রেনে আগুন, রেললাইন উপড়ে ফেলার সময় তাদের চোখমুখের ভঙ্গি। তখন তাদের মনের মধ্যে যেন বাজতে থাকতে ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’ অথবা ‘ভেঙেছি পিঞ্জর, মেলেছি ডানা’। এই ডানায় ভেসে বেড়ানো অতিউৎসাহী মানুষগুলোকে তিনি পিঞ্জরবদ্ধ করলেন অন্যভাবে।
তিনি ভাবলেন তার গাড়ি যখন এভাবে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো তখন দেশে কোনো গাড়িই আর রাখবেন না। দেশ গাড়িমুক্ত হবে।
হেঁটে চলাচল করবে মানুষ, বাড়বে আয়ু। ডায়াবেটিস রোগিদের চিকিৎসা খরচ কমে যাবে। হর্টের রোগিরা ভালো হয়ে যাবেন। ডায়েট কন্ট্রোল করে কারো আর খাওয়া কমানো লাগবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মরবে না।
নাক-কান-গলার রোগ থেকেও মানুষ অনেকটা মুক্তি পাবে।
এক কথায় মানুষকে শান্তি দিতে চান জব্বার। যদিও এর পেছনে তার স্বার্থ আছে, তবু তো মানুষ শান্তিতে থাকবে!
যে কথা সেই কাজ। জব্বার কাজ শুরু করলেন। হয়তো কোনোদিন শান্তিতে নোবেল পাওয়ার জন্য মনোনীত হবেন।
নোবেল পেয়েও যেতে পারেন ভেবে। ।
প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে তিনি একটি পিকেটার তৈরির কারখানা গড়ে তুললেন। সেখানে পিকেটার তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়। দেশ থেকে গাড়ি নির্মূল করে শান্তি ফিরিয়ে আনার এটিই একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছে জব্বার আলীর কাছে।
কারণ একমাত্র দেশের কৃতী সন্তান পিকেটাররাই পারে জ্যাম, দুর্ঘটনা, তৎজনিত মৃত্যু থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে!
‘এখানে পিকেটার ভাড়া পাওয়া যায়’ লেখা বিশাল সাইনবোর্ডসহ নতুনধাঁচের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখে প্রথমে মানুষ একটু ঘাবড়ে গেলেও অবাক হলেন না। বাঙালি এখন কোনো কিছুতেই খুব বেশি অবাক হয় না, ঘাবড়ে যায় না, বরং অনুপ্রাণিত হয়।
জব্বার আলী একটি কারখানা খুলেছেন। যেখানে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, ট্রেনে আগুন প্রভৃতি উদ্দীপনা মূলক! কাজে কর্মী তৈরি হয়। শুধু তৈরি করা নয়, কর্মীদের দেশের মহৎ কাজে নিয়োগ করতে ভাড়া দিয়ে অর্থও উপার্জন করবেন তিনি!
ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল তার ব্যবসায় অল্পদিনের মধ্যেই।
তিনি তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করলেন তার নিজ হাতে সন্তানের মতো লালন করে তৈরি করা কর্মীদের।
ক্যাটাগরি ১: সাধারণ পিকেটার। এরা হরতাল অবরোধে মিছিল করতে সক্ষম। স্লোগান যেন ভালো দিতে পারে সেজন্য প্রতিদিন তাদের সারগম চর্চা করানো হয় ভোর ৫টায় উঠে। সারাদিন কম কথা বলে তারা।
নিয়মিত আদা, লবঙ্গ মুখে রাখে। আইসক্রিম খাওয়া নিষিদ্ধ। তবে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা হাতে লাঠিও বহন করতে পারে। স্লোগানে প্রাথমিক আতঙ্ক সৃষ্টি করাই এদের প্রধান যোগ্যতা। এদের দেখে পথে গাড়ি বের হতে সাহস পাবে।
ক্যাটাগরি ২: দক্ষ, মারদাঙ্গা পিকেটার। এরা গাড়ি ভাঙতে ওস্তাদ। রেলের স্লিপার উপড়াতে বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত! ইট, পাথর এদের প্রধান অস্ত্র। প্রতিদিন সকালে নদীর পাড়ে তাদের ট্রেনিং হয়। বাহুবল বাড়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে সোলা ছুড়তে হয় তাদের।
তারপর পর্যায়ক্রমে ইট পাথর। দৌড়াতেও এরা বিশেষভাবে দক্ষ। সব দল এদের নিজেদের কর্মী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কারণ গাড়ি ভেঙে এরা চোখের পলকে পালিয়ে যেতে পারে।
ক্যাটাগরি ৩: জব্বার আলীর ব্যবসার সবচেয়ে বড় অস্ত্র জ্বালাও-পোড়াও পিকেটার।
দেশ থেকে গাড়ি নির্মূল করতে এরাই রাখতে পারে সবচেয়ে বেশি। ইদানিং এদের চাহিদাও বেশি। হরতালে দলগুলো যখন ব্যানার ধরার লোক পায় না, তখনও এরা ৩জন ব্যানার ধরে মিছিল নিয়ে চোখেমুখে রাজ্যের ভয় নিয়েও গাড়িতে পেট্রোল বোমা মারতে কিংবা গান পাউডার বা পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগাতে ওস্তাদ। এরা সহজে ধরা পড়ে না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি হয় ভস্মীভূত।
এদের নিয়মিত হাউজ অব ডেথ গেমসের ম্যাজিশিয়ন পর্বটি খেলানো হয়; পড়ানো হয় রূপকথার জাদুকরদের গল্প।
এক্সক্লুসিভ ক্যাটাগরি: এই ক্যাটগরিতে রয়েছেন নারী কর্মী। গায়ে জোর কম হলেও সাহসের কমতি নেই নারী পিকেটারদের। ঝাঁটা, দা, বটি হাতে এরা বেরিয়ে পড়তে ওস্তাদ। মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত বিদ্যুতের ক্ষতি করা অটোরিকশা ভাঙতে ওস্তাদ।
তাদের যেহেতু গৃহে বেশি থাকতে হয়, সেহেতু বিদ্যুৎ-খেকো এসব ব্যাটারিচালিত অটো ধ্বংস করে তারা দেশের উপকারে বদ্ধপরিকর!
দেশের স্বার্থে ব্যবসায় হস্তক্ষেপ কোনো সরকারই করে না। কারণ সরকারের প্রয়োজনে আবার ব্যবসায়ীরাই এগিয়ে আসে। ফলে পিকে জব্বারের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠল। এগিয়ে যেতে থাকলো তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। সারা দেশে খোলা হলো জব্বারের ব্যবসার শাখা।
তার উদ্দেশ্য সফল হলো অনেকটা। গাড়ি ভেঙে, পুড়িয়ে দেশ অনেকটা শান্ত হলো। মৃত্যু হার কমে গেল, মানুষের আয়ু বেড়ে গেল, মানুষ নির্মল নিঃশ্বাস গ্রহণ করার সুযোগ পেল; জব্বার আলী দেশের প্রতিনিধি হিসেবে, বহু দেশের হেভিওয়েট রাষ্ট্রপ্রধানকে হারিয়ে মনোনয়ন পেল নোবেল। নোবেল কমিটি তো এমন মানুষই আগে খোঁজে শান্তিতে মনোনয়নের জন্য। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।